বঙ্গসন্তান শারিফ হোসেনের সাফল্যে অক্সফোর্ডে ভারতের মুখ উজ্জ্বল
ফারুক আহমেদ
অক্সফোর্ড বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। শত শত আবেদনকারী। ৩৫টি দেশের মধ্যে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকা, মঙ্গোলিয়া, হংকং, ফিলিপাইন, কাজাখস্তান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ থেকে মাত্র ৫৫ জন নেতা নির্বাচিত করা হয়েছিল। সবাই বেসরকারি বা সরকারি খাতের নেতা। কোর্সের অন্যতম সবচেয়ে কম বয়সী নেতা ছিলেন পশ্চিমবাংলার পতাকা ব্র্যান্ড শিল্পগোষ্ঠীর ডিরেক্টর শারিফ হোসেন। মাইক্রোসফট, গুগল, লুরপাক, ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা, মেডিকেল কলেজের ডিন এবং সরকারি মন্ত্রণালয় ইত্যাদি থেকে অক্সফোর্ডের ৫৫ জন ছাত্র হলেন স্কলার তাঁদের মধ্যে শুধুমাত্র কয়েকজন ডিস্টিংশন পেয়েছেন। বঙ্গসন্তান শারিফ হোসেন ভারতের মুখ উজ্জ্বল করলেন, ডিস্টিংশন নিয়ে এই কঠিন সাফল্য অর্জনে হলেন স্কলার।
শারিফ হোসেন বলেন, ‘‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া কঠিন। আরও কঠিন তার পড়াশোনা। আর সব থেকে কঠিন ডিস্টিংশন পাওয়া। যা ৫৫ জনের মধ্যে মাত্র ৭/৮ জনই পেয়েছেন। আমি এই যাত্রা শুরু করলাম, আমার আব্বার স্বপ্ন থেকে, যিনি শিক্ষার প্রতি খুব গুরুত্ব দেন। উনি আমাদের শিখিয়েছেন ‘যে পথ কেউ চলেনি সেই পথে ভয় হওয়া স্বাভাবিক। পরিষ্কার নিয়তে পরিশ্রমের করতে থাকো, সফল অবশ্যই হবে।’ তিনি বলেন, ভাঙা পা নিয়ে আমি ক্লাস করেছি ও পরীক্ষা দিয়েছি। সেই শিক্ষা থেকে প্রত্যেকটি কঠিন পর্যায় আমি এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাই। আজ আমি গর্বিত থেকে বেশি বিনম্র, যে এই কঠিন যাত্রা আমার আব্বা, মা, পরিবার আর বিশিষ্ট শিক্ষক ও কলিগদের উৎসাহে সম্ভব হল।’’
জনৈক স্কলার Dominus IIIuminatio Mea এ ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে বলেছেন, After 1 year with 55 leaders of the world I finally completed my journey of becoming an Oxford Postgraduate Scholar with Distinction. Only a handful achieved distinction and I was the only one to have ever represented a rural mass market organisation. This proud and joyful occasion is owed to evry person who inspired me in life to challenge my abilities.
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম হিসেবে সর্বস্বীকৃত। ইংরেজি ভাষাভাষী জগতের সবচেয়ে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়। ধারণা করা হয়, একাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে অথবা দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমে এই বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঠিক তারিখ জানা না গেলেও অনুমান করা হয় একাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই অক্সফোর্ডে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল। তবে ১১৬৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা দ্বিতীয় হেনরি স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ ইংরেজ ছাত্রদের প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রথমদিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব, আইন, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও দর্শন বিভাগ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের কোনও ভবন ছিল না, ভাড়া করা হল অথবা চার্চে ক্লাস নেওয়া হত। ১৩৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাজার এক আদেশবলে বিশ্ববিদ্যালয়কে অক্সফোর্ড শহরে স্থান দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে কিন্তু পরবর্তীকালে রাজার দ্বিতীয় পুত্রের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির কলেবর বৃদ্ধি করা হয়। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মহিলা কলেজ লেডি মার্গারেট হল প্রতিষ্ঠিত হয়। বিংশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়টির আরও সংষ্কার করা হয়। বিজ্ঞানের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা হয় ও নতুন বিভাগ খোলা হয়।
বিশ্ববিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাইদের অক্সনিয়ান বলা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও নোবেলজয়ী শিক্ষা লাভ করেছেন। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৪ জন ইংরেজ রাজা, ৮ জন বিদেশি রাজা, ৪৭ জন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, ২৫ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ২৮ জন বিদেশি প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী, ৭ জন সেইন্ট বা সাধু, ১৮ জন কার্ডিনাল ও এক জন পোপ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন– জন ওয়েজলি, অস্কার ওয়াইল্ড, সেসিল রোডস, এডমন্ড হ্যালি, স্টিফেন হকিং, টিম বার্নার্স-লি, হিউ গ্রান্ট, রুপার্ট মার্ডক, মার্গারেট থ্যাচার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। রয়েছেন ভারতের দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ও মনমোহন সিং। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক।
বিভাজন পরবর্তী পশ্চিমবাংলার উপেক্ষিত জাতিসত্তার মর্যাদার অন্বেষক রূপকথার রাজপুত্র মোস্তাক হোসেন। ৬ জুলাই, ২০২৪ শারিফ হোসেনের বিশ্বজোড়া সাফল্য শিল্পপতি ও পতাকা গ্রুপের কর্ণধার, পিতা মোস্তাক হোসেন ও মা সানোয়ারা হোসেন, সহধর্মিনী সানজিদা জিনাতের জন্য প্রকৃতপক্ষে গর্বের দিন। গর্বের দিন, পুরো পতাকা পরিবারের জন্য। আর সেইসঙ্গে গৌরবের দিন বাংলার জন্যও। কারণ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই ধরনের কৃতিত্বের স্বীকৃতি কোনও সহজ বিষয় নয়। সত্যি বলতে কী, পশ্চিমবাংলার কেউ এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, অনেক অনুসন্ধান করেও তার কোনও নজির পাওয়া যায়নি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে ওই দিন এক বছরের কঠোর পরিশ্রম ও বুদ্ধিবৃত্তিক সফর পার হয়ে শরিফ হোসেন অক্সফোর্ড পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্কলার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই স্বীকৃতি পেয়েছেন ডিস্টিংশন নিয়ে। অক্সফোর্ডের এই প্রোগ্রামটি ছিল এক বছরের ইন্টেন্সিভ পোস্টগ্র্যাজুয়েশন, যা ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রের শীর্ষ লিডারদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আর ৩৫টি দেশের মধ্যে ভারতের শারিফ হোসেন নিজের মেধা ও কঠোর পরিশ্রমের স্বীকৃতি আদায় করে নিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শারিফ ছিলেন এই লিডারশিপের পরীক্ষায় সবথেকে তরুণদের একজন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন শ্রেষ্ঠ কোম্পানিগুলির সঙ্গে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে গ্রামীণ বিকাশ শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী পতাকা হাউসের জন্য এই বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। স্মরণীয়, এই একই প্ল্যাটফর্ম থেকে গুগল (সফটওয়্যার জায়ান্ট), ইন্টারটেক (মেশিনারি জায়ান্ট), লুরপাক (ডেয়ারি জায়ান্ট)-এর মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানিগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ভারতের এই উজ্জ্বল তারকা পতাকা হাউসের গ্রামীণ বিকাশ শিল্পের জন্য এই মর্যাদা আদায় করে নিয়েছেন।
শারিফ হোসেন বাংলার চলমান শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রদূত মোস্তাক হোসেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তাঁর পড়াশোনা শুরু কলকাতার সেন্ট জেমস স্কুল থেকে। এরপর তিনি লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যাচেলর্স ডিগ্রি লাভ করেন। এবং ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্ট্র্যাটেজি এবং মার্কেটিং-এ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। গবেষণা করেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অক্সফোর্ডে তাঁর এই সম্মান অর্জনের দিন উপস্থিত ছিলেন তাঁর পিতা মোস্তাক হোসেন, মা সানোয়ারা হোসেন ও স্ত্রী সানজিদা জিনাত। শারিফের এই বিরল সম্মান প্রাপ্তির সাক্ষী থাকলেন তাঁরাও। পতাকা গ্রুপের একজন অন্যতম ডিরেক্টর শারিফ হোসেনের লক্ষ্য হচ্ছে, সামাজিক দায়িত্ব পালনে সবাইকে অনুপ্রাণিত করা। ইতিমধ্যেই তিনি বিজনেস লিডার ও শিক্ষার প্রসারে এক অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
শারিফ হোসেনের বোন ও GD Hospital & Diabetes Institute এর CEO মুশরেফা হোসেন Albert Einstein এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “Wisdom is not a product of schooling but of the lifelong attempt to acquire it.” এবং দাদার সাফল্য সম্পর্কে বলেছেন, Can’t express how proud I am that my elder brother has proven this adage to be so true as he became an Oxford scholar very recently. As we revel in his joy I Can’t help but wonder what it would be like now for a Cambridge scholar (me) and an Oxford scholar (bhai) to live under the same roof. Especially since the rivalry between the two Universities runs for more than 8 centuries. So much so that they never allow one person to make applications to both places simultaneously. I guess all that matters, in the end, is the question : ‘light blues’ (Cambridge) or ‘dark blues’ (Oxford)?
শারিফ হোসেনের শিক্ষা ক্ষেত্রে এই বিশ্বমানের সাফল্য তাঁর ব্যক্তি পর্যায়ে, পরিবার বা কর্ম উদ্যোগে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তার প্রভাব পড়বে পতাকা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কর্ম ও পরিকল্পনা রূপায়ণে। প্রভাব পড়বে জিডি চ্যারিটেবল সোসাইটির জনবাদী প্রচেষ্টা, প্রসারে। প্রভাব পড়বে মোস্তাক হোসেন সাহেবের নির্দেশনায় স্বপ্ন পূরণের সঠিক বাস্তবায়নে। শারিফ হোসেনের এই সাফল্য বাংলার প্রতিটি প্রান্তে আলোচনার কেন্দ্রে দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণ অনগ্রসর সমাজের এগিয়ে যাওয়ার, ভবিষ্যতের আশা যেন নিরাপদ আশ্রয় লাভ করল। স্মরণীয়, আপন অর্জনে যোগ্য মানুষ না হলে কেউ যোগ্য সমাজ, যোগ্য মানুষ গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করেন না। পশ্চাদপদ বাংলা তাই আগামীর দুশ্চিন্তার মাঝে শারিফ হোসেনের ভাগ্যবিজয়কে নিজের ভবিষ্যৎ জয়ই মনে করছেন। আনন্দ-গৌরবে গর্ববোধ করছেন। আবার শারিফ হোসেনের এই সাফল্যে রয়েছে পতাকা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কাজের বিশ্বস্বীকৃতি। কারণ তিনি যে পেপার জমা দিয়েছিলেন তা ছিল, গ্রামীণ বিকাশ শিল্পে পতাকার ভূমিকা। স্বাভাবিক ভাবে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি শারিফ হোসেনকে আরও দায়িত্ব সচেতন উদ্যোগপতি হতে সাহায্য করবে। এবং জাতির প্রতি কর্তব্য পালনে যত্নবান করে তুলবে। যে কোনও দায়িত্ব, বিশেষ করে শিক্ষা অর্জিত দায়িত্ব মানুষকে নিষ্ঠাবান হতে সাহায্য করে। শারিফ হোসেন নিষ্ঠার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, আগামী দিনে তা গৌরবোজ্জ্বল সাফল্যে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
মোস্তাক হোসেন সাহেব প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে তাঁর শিল্প সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। যা প্রজন্মের কাছে দৃষ্টান্ত। পিতা গিয়াসউদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে ব্যবসার যেটুকু পেয়েছিলেন তা ছিল মূলত প্রেরণা। আপন প্রচেষ্টায় সেই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সাফল্যের শিখরে বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। সামান্য ব্যবসা হয়ে ওঠে শিল্প সাম্রাজ্য। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে পতাকার পতাকা উত্তোলিত হয়েছে চা শিল্প, রেশম শিল্প, নির্মাণ শিল্প থেকে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও। বাঙালির ব্যবসা বিমুখ অপবাদ তিনি ঘোচাতে পেরেছেন, অনেকটা। বাংলার মাটি থেকে তাঁর শিল্প প্রচেষ্টা ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের কোণে কোণে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মোস্তাক হোসেন সাহেবের এত সাফল্যের পরেও তাঁর মধ্যে ব্যবসায়ী মানসিকতা নেই। কোনও ব্যাপারেই তাঁর ব্যবসায়ী মানসিকতা দেখা যায় না। বাংলার শিল্প উজ্জীবনে তাঁর অবদানে মনে হতে পারে, লাভ ও লোভে ভরপুর তিনি এক ব্যবসায়ী চরিত্রের মানুষ। কিন্তু না। এরপরও দেশের জন্য তিনি ভাবতে পারেন। জাতির জন্য দুশ্চিন্তা করতে পারেন। গরিবের মাথায় আশ্রয় না থাকার জন্য উদ্বিগ্ন হতে পারেন। পিছিয়ে পড়া সমাজের ছেলেমেয়েদের জন্য নিজের আয় থেকে অকাতরে ব্যয় করতে পারেন। বলতে পারেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোর নীচে বিরাজ করছে যে সব অন্ধকার, স্থায়ী অন্ধকার, যে সব প্রত্যন্ত অঞ্চল এখনও সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করছে, আমরা সে সব অঞ্চলে যাব, পথ শিশুকে কোলে তুলব, তাকেও সূর্যের আলো দেখাব।
বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে মোস্তাক হোসেন সাহেব গরিব বাংলার শিক্ষা প্রসারে যে ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। হয়ে উঠেছেন একমাত্র আশ্রয়দাতা। রক্ষা করে চলেছেন ধারাবাহিকতা। নিয়মে বেঁধেছেন দান-অবদানের কৃত-কর্তব্য। তাতে তাঁর মরমী হৃদয়ের সমাজ চেতনা, দূরদৃষ্টি সর্বোপরি মানুষের জন্য তাঁর অন্তর্বেদনা উন্মোচিত। এই হৃদয় তিনি লাভ করেছেন ইসলামী দর্শন থেকে। একদা তিনি বলেছেন, ‘বিদ্যা আর জ্ঞানের প্রয়োগ চাই জীবনে। তার সর্বস্তরে। সর্বপ্রয়োগই পূর্ণ করবে ব্যক্তি ও সমাজের নির্মাণকে। একথা আমার নয়, মহাগ্রন্থ কোরাণ শরিফেরই নির্দেশ-যে ব্যক্তি, যে সমাজ বা যে জাতি যতক্ষণ নিজের পরিবর্তনে এগিয়ে আসে না, আল্লাহও তাঁদের অচলাবস্থা বদলান না। তাঁর মতে, ইসলামী সমাজ নিছক ব্যক্তি-নির্ভর নয়। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রের আলাদা গুরুত্ব নেই এখানে। শুধু একজন কিংবা মুষ্ঠিমেয় মানুষ খেতে পাবে, ভালো থাকবে, শিক্ষায় আলোকিত হবে, বাকিরা অন্ধকারে পড়ে থাকবে, অভুক্ত থাকবে, বৈষম্যের শিকার হবে, এই একপেশে নীতিকে হজরত (স:) বরদাস্ত করেননি। শিক্ষা-দৃষ্টিতেই বৃহত্তর এই নির্মাণের কাঠামো গড়েছেন তিনি। তাঁকে এবং আমার ধর্ম ইসলামকে আমি এইভাবেই বুঝি, বোঝার চেষ্টা করি। ‘এই বক্তব্য থেকে মোস্তাক হোসেন সাহেবের দর্শন-তত্ত্ব আমাদের নিকট অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং এই বক্তব্য থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, তিনি যেমন নিজ সন্তানদের-শারিফ হোসেন বা মুশরেফা হোসেনদের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি বা কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির স্কলার হিসাবে সাফল্য চেয়েছেন। তেমনি জাতির সুযোগ্য উত্তরসূরী গড়ে তুলতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মূলত, খারিজি মাদ্রাসার অনুকরণেই বাংলার আধুনিক শিক্ষার আবাসিক স্কুল গুলি পথচলা শুরু করে। এবং তা খুব দ্রুত মানুষের কাছে জনপ্রিয়-গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। কারণ খারিজি মাদ্রাসাগুলি সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। যেখানে রাষ্ট্র নির্ধারিত কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুযোগ নেই বললেই চলে। পিছিয়ে পড়া সমাজের শিক্ষার্থীদের নামকরা স্কুল বা বোর্ডিংয়ে থেকে পড়াশোনার স্বপ্নটি ছিল এক প্রকার অলীক কল্পনা। অন্যদিকে ধর্মীয় ঐতিহ্যবাহী মিশন স্কুল গুলিতে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরাই পড়াশোনার সুযোগ গ্রহণ করতে পারত। ফলে, দেশভাগ পরবর্তী বাংলায় পিছিয়ে পড়া সমাজে শিক্ষার ব্যাপারে যে হতাশা তৈরি হয়েছিল সেখানে একটা আশার আলো তৈরি করেছিল আবাসিক স্কুলের ধারণা। পশ্চিমবঙ্গের বুকে অনেকেই প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু তা অর্থ কষ্টে যেমন সাফল্যকে ছুঁতে পারেনি। তেমনি লক্ষ্যকেও স্পর্শ করতে পারেনি। প্রান্তিকভাবে বিক্ষিপ্ত এই প্রচেষ্টা যখন প্রচারের আলো ও মানুষের উৎসাহ থেকে বহু দূরে। মানুষকে তাদের উদ্যোগ-উদ্দেশ্য সম্পর্কে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে সহানুভূতি, সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষায় প্রহর গুনছে। ঠিক সেই সময় মোস্তাক হোসেন সাহেবের আশ্রয়দাতার ভূমিকা গ্রহণ, পুরো চিত্রটা বদলে দেয়। তাঁর নিজস্ব আয় থেকে অঢেল অর্থের যোগান অচিরেই প্রচেষ্টা অর্থবহ হয়ে ওঠে। আজ পঞ্চান্নটি আবাসিক স্কুল তাঁর জিডি চ্যারিটেবল সোসাইটির ছত্রছায়ায় বাংলার শিক্ষা প্রসারে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। মোস্তাক হোসেন সাহেবের শিক্ষার প্রতি দরদ থেকেই জাতির প্রতি এই মমত্ব, ইতিহাসের উপাদান হয়ে উঠেছে। শিক্ষার ওপর অনুরাগ থেকেই তিনি অক্সফোর্ডের সমাবর্তনে উপস্থিত হয়েছেন, সপরিবারে। উপস্থিত হয়েছেন উৎসাহী পিতা হিসাবে।
এই নিবন্ধের মুখ্য বার্তা একটাই, মোস্তাক হোসেন সাহেবের পুত্র শারিফ হোসেন বা কন্যা মুশরেফা হোসেন অক্সফোর্ডে ইউনিভার্সিটি বা কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। আর তিনি যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাতে, আগামী দিনে অনগ্রসর পরিবারগুলির ছেলেমেয়েরাও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির স্কলার হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। স্বাভাবিক ভাবে, শারিফ হোসেনদের সাফল্য অনুপ্রেরণার বার্তাবাহক। স্মরণীয়, মোস্তাক হোসেন সাহেবের আশ্চর্য হৃদয়ের উদারতায় চালচুলোহীন গরিব, কৃষক, দিন মজুর, শ্রমিক, কারিগরের সন্তানরা সমাজের প্রথম সারির জীবিকা তথা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, আধিকারিক, প্রশাসক পদে ব্রতী হচ্ছেন। এমনকি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরমাণু গবেষণায় তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। বাংলাভাগ পরবর্তী বাংলার সামাজিক রং বদলের রূপকার মোস্তাক হোসেন সামাজিক দায়িত্বের যে ইতিহাস গড়ে চলেছেন তা গবেষণার বিষয়বস্তু। ঐতিহাসিক সুরজিৎ দাশগুপ্ত বলেছেন,’তাঁরা ভাগ্যবান যাঁদের মধ্যে মোস্তাক হোসেন-এর মতো মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। দেশে আরও অনেক মানুষ আছেন যাঁরা সম্পদে তাঁর চেয়েও বহুগুণ বেশি সবল। তাঁরাও শিক্ষার জন্য প্রচুর কাজ করেন, তাঁদের নামে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, তবে সেসব প্রতিষ্ঠান তাঁদেরই মতো বলীয়ান ব্যক্তির বা পরিবারের সন্তান-সন্তুতির জন্য। মোস্তাক হোসেন-এর বিশেষত্ব এখানে যে তিনি তাঁদেরই দক্ষ ও যোগ্য করে তোলার জন্য শিক্ষার প্রদানে ও প্রসারে সচেষ্ট যাঁরা আর্থিক ভাবে দুর্বল। তিনি সংযোগে ও সম্পদে দুর্বলদের বলীয়ান করে তোলার মকসদ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এখানেই তাঁর মহত্ব।’
আনন্দবাজার পত্রিকা বহু আগে (ঘরের কাছে পরশ পাথর, এপ্রিল, ২০০২) বলেছে,’অন্য দেশের, অন্য রাজ্যের বিনিয়োগ আনতে রাজ্য সরকারের চেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু নিজের তাগিদে এবং নিজের জোরে লক্ষ্মীর সাধনায় এগিয়ে চলেছেন মুর্শিদাবাদের মোস্তাক হোসেন। মোস্তাক হোসেন এই রাজ্যের বাণিজ্যজগতের তৃণমূল স্তর থেকে উঠে আসা এক দেশজ উদ্যোগী। মনে রাখতে হবে, মোস্তাক হোসেন অনেক আগে থেকে অনেক পরের কথা ভাবতে পারেন, ভেবে দেখিয়ে দিয়েছেন।’ শুধুমাত্র ব্যবসার ক্ষেত্রে নয়, জাতির কল্যাণকামী ভাবনা ও তার রূপায়ণে মোস্তাক হোসেন সাহেব তাঁর দূরদর্শিতার প্রমাণ রেখেছেন। শারিফ হোসেন, মুশরেফা হোসেনদের সাফল্য তাই তাঁর মনোবল বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। বাংলার পশ্চাদপদ সমাজের ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বপ্নকে বাস্তবায়নে ভরসা যোগাবে। শারিফ হোসেনদের সাফল্যের বহু আগে তিনি বলেছেন, ‘বিদ্যা ও জীবনের সাফল্য কারো একার হয় না। যিনি জ্ঞানী, তিনি যেমন ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন, তেমনি তাঁর বিদ্যা প্রতিবেশি, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন সকলকেই উৎসাহী করে তোলে বিদ্যার্জনের জন্য।’ শারিফ হোসেনও সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর সাফল্যের অংশীদার করেছেন বাংলার মানুষকে। তাঁর এই সাফল্য তাই পতাকা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য শুধু নয়, অবনত সমাজের জন্যও গর্বের নয়া মাইলফলক।