চুপ থাকার দেশচিত্র
বর্ষাতি মন (ঝাড়খণ্ড)
আমি আগে রাস্তায় নামতাম
কাঁধে ব্যানার মুখে স্লোগান হাতে প্ল্যাকার্ড
‘আমার শরীর, আমার অধিকার’
‘বিচার চাই, এখনই’
গলা ফেটে যেত তবু চেঁচাতাম
কারণ তখন ভাবতাম কেউ না কেউ শুনছে
রাষ্ট্র শুনছে
প্রশাসন ঘুমচোখে হলেও তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের পর্দায়
এক-আধটা শব্দ হয়তো পৌঁছচ্ছে মন্ত্রকের করিডোরে
এখন আমি জানি
রাষ্ট্রের কানে তুলো গোঁজা, চোখে কালো চশমা
সে শুধু শোনে নিজের ঢোল
চকচকে চোখে তাকিয়ে দেখে নিজের পোস্টার
আমি এখন চুপ করে থাকি।
ভোরে ফুল তুলে রাখি
রান্নাঘরে লবঙ্গ দারুচিনি খুঁজে না পেলে হতাশ হই
বাসে উঠি, জানালা দিয়ে আকাশ দেখি
পাশের সিটে এক কিশোরী কাঁপতে কাঁপতে বলে
উনি হাত দিলেন…
আমি চুপ করে থাকি।
আগে আমি চেঁচাতাম
শাস্তি চাই, ধর্ষকের ফাঁসি চাই, জনতার আদালত জিন্দাবাদ
এখন শুধু ভাবি
ওর মায়ের মন ঠিক কেমন করে ফেটে যাচ্ছে
আর আমি মাথা নিচু করে নেমে যাই
পেছনে কিশোরীর কাঁপুনি
সামনের রাস্তায় আমার নির্জন পিছু হাঁটা…
আমি এক চুপ করে থাকা নাগরিক।
আমার পরিচয় নম্বর ২৩৭৭৬৬১৯৬
আমার অভিযোগ নেই, দাবি নেই
আমার মেয়ে আছে বাড়িতে
তাকে কবিতা পড়াই, বলে দিই
চুপ থাকতে হয়
এই দেশ নারীকে ভালোবাসে না—শুধু ব্যবহার করে
তাকে দেবী বানায় উৎসবের দিনে
আমার দেশ স্বাধীন
আমার মেয়েরা নয়
আমি ন্যাপকিন কিনে বাড়ি ফিরি রক্তভেজা পথ দিয়ে
আমার দেশ আইন বানায়
যে আইনে ধর্ষক, খুনি, লম্পট—সবাই জামিন পায়
কিন্তু এক কবি, এক ছাত্র, এক মেয়ে
অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রবিরোধিতার নামে গায়েব হয়ে যায়
আমি চুপ করে থাকি।
কারণ কথা বললে পরিচয়পত্র বাতিল হতে পারে
চাকরি চলে যেতে পারে
বাড়িতে পুলিশ আসতে পারে
আমার মেয়েটির স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কেউ
চুপ করে থাকি।
আর ভিতরে ভিতরে ছাই হয়ে যেতে থাকি
আমার কবিতা হাইরোড পার হতে পারে না
আমার বুকের ভিতর বিস্ফোরণ হয়, তবু রক্ত ঝরে না
তবু
আজ লিখে রাখি এই জবানবন্দি
এই ব্যর্থতা, এই লজ্জা, এই খামচে ধরা অভিমান
হয়তো কোনো একদিন
মেয়েটি নিজেই জোরে চেঁচিয়ে বলবে—
আমার কোনো নাগরিক নম্বর নেই, আমি দেবী ও নই , আমি মানুষ।
