বরাণগর এবং এর নতুন নাটক
“লুল্লু “..বাস্তব ঘটনাকে খুব সুন্দর
ভাবে রূপায়িত করেছেন নির্দেশক
ইন্দ্রজিৎ আইচ
………………………………………….
বাংলা থিয়েটার এর জগতে “বরানগর এবং “এর নাম কম বেশি আমাদের সকলের জানা।
২০০২ সালে এই দল প্রতিষ্ঠা করেন পরিচালক সমিত দাস।
এই দলের উল্লেখযোগ্য নাটক গুলো হল চোখ, বেদেনী, অন্ধ গলির রাজা, নিখোঁজ শুভ্র, এক যে ছিলো হরবোলা, পাচু ওস্তাদ, গুপী বাঘা এবং। এই নাটক গুলো কলকাতা, সারা পশ্চিমবঙ্গ
সহ আসাম, দিল্লি, উত্তরবঙ্গতে মঞ্চস্থ হয়েছে।২০০৭ সালে তাদের নাটক “অন্ধ গলির রাজা”
পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমী পুরস্কার পায়। সেইবছর রাজ্য ছাত্র যুব উৎসবে এই নাটক দ্বিতীয় স্থান লাভ করে।
গত ১৮ ই ফেব্রুয়ারি রবিবার সন্ধায় বরানগর রবীন্দ্র ভবনে মঞ্চস্থ হয় বরানগর এবং এর
নতুন নাটক ” লুল্লু “। নাটকটি লিখেছেন স্বরাজ ঘোষ।নির্দেশনা
সমিত দাস। এক ঘণ্টার এই নাটকটি বাস্তব জীবনকে নিয়ে
করা।
এখন আমাদের সমাজে মোবাইল হয়ে উঠেছে আমাদের সকলের জীবন সঙ্গী। সেই মোবাইল আমাদের বাস্তব জীবনে কতটা ক্ষতি করছে এই নাটকে তার আভাস পাওয়া যায়।
এই নাটকে লুল্লু প্রধান চরিত্র।
সে থাকে ঝাঁপতলা হল্ট এর পাশে রেল লাইনের ধারে এক ঝুপড়িতে। তার মা সতি লোকের
বাড়ি কাজ করে। আর বাবা পোনা সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকে। নিজের বউয়ের ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে। প্রতিদিন এই অভাব অনটনের মধ্যে তাদের জীবন চলে। লুল্লু লেখাপড়া করে না, সারাদিন নিজের মতন ঘুরে বেড়ায়।
ঝাঁপতাল স্টেশনের পাশে চোকলা কাকার চায়ের দোকান।
সেখানে সবাই লুল্লুদের চেনে। সেই চায়ের দোকানে এসে আড্ডা দেয় তোতলা ননী।
আর চায়ের দোকানের পাশে বসে গান গেয়ে ভিক্ষে করে অন্ধ
ভিখারি অভিরাম। এই অভিরাম
ভালো গায়। গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে সে। লুল্লুদের সংসারে রোজ
অশান্তি হয়। লুল্লু র বাবা রোজ মদ খায় , মায়ের সাথে বাবার লাটালাটি, তাই নিয়ে বাঙ্গতক মনোভাব বা বিরূপ মন্তব্য আর কু নজরে দেখে চায়ের দোকানের
চোকলা কাকা আর তোতলা ননী। এদের নজর লুল্লু মায়ের দিকে। ভালোমন্দে কেটে যায় জীবন। একদিন ঐখানে এসে পড়ে ক্যান্ডি নামে এক ইউ টিউব ব্লগার। সে ভিখারি অভিরাম এর গান শুনে তাকে নিয়ে নানারকম
বল্গ করে মোবাইলে। তারফলে ফলোয়ার বারে, ভিউয়ার জন্য টাকা আসে। ক্যান্ডির এই কাজ দেখে আর অন্ধ অভিরাম এর গান শুনে লুল্লু ভাবে আমাকেও ওদের মতন হতে হবে। এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে রাতারাতি আমার নাম সহজেই যাতে জানতে পারে, মোবাইলে ভাইরাল হয়, ভিউয়ার হয়, এতে অনেক নাকি টাকা উপার্জন করা যায়। একবার নিজের নাম হলে আর অভাব থাকবে না।বাড়িতে সে রোজ দেখে বাবা মা এর ঝগড়া, কথা কাটাকাটি,মারামারি। মা বলতো লুল্লু কে নিজের পথ নিজে দেখে নে, নিজে রোজগার কর।এর একটাই কারণ সেটা হলো টাকা। যে কোনো ভাবেই টাকা রোজকার করতে হবে। না হলে এই সমাজে বাঁচা যাবে না, ছেলে মানুষ লুল্লু, যেমন ভাবা তেমন কাজ। একদিন বাড়িতে এসে মায়ের মোবাইল চুরি করে সে চলে যায় স্টেশনের পাশে চলন্ত ট্রেনের সামনে সেলফি তুলতে।
সেখানেই তার স্বপ্ন চুরমার। ট্রেনের ধাক্কায় মোবাইলে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রাণ হারায় লুল্লু। হায় সমাজ, এই মোবাইল কেড়ে নিলো একটি ছেলের প্রাণ। এই নাটক প্রশ্ন তোলে তাহলে লুল্লু আর কি করার ছিলো। লেখাপড়া? অর্থ নেই, পেটে ভাত নেই, সারাদিন ঘরে অশান্তি, যাবে
কোথায়, কি করবে সে? অভিরাম এর গান আর ক্যান্ডি র ব্লগ দেখে লুল্লু চেয়েছিলো কিছু একটা করতে। কিন্তু না, তাকে বোঝানোর কেউ ছিলো না, শেষমেশ লুল্লু র জীবনে এই পরিণাম। শেষমেশ লুল্লু র বাবা মা , চায়ের দোকানের চোখলা, ননী তোতলা সবাই বুঝতে পারে আমাদের সমাজ জীবন কতটা
কঠিন, কতটা নির্মম!
বরানগর এবং এর এই নাটক “লুল্লু”… হাঁসি,মজা, নাচ, গান আর শেষমেশ ব্যাথা বেদনা নিয়ে
দর্শকদের মন জয় করে নেবে।
বিশেষ করে এই নাটকের মজার সংলাপ গুলো দারুন। যেমন চায়ের দোকানের চোখলার ডায়লগ
” কচি না বিচি ” অর্থাৎ কম চিনি না বেশি চিনি। সেই সাথে ননির তোতলামো, লুল্লুর লুঙ্গি ড্যান্স, লুল্লু র বাবা মা পোনা – সতির ঝগরা। ক্যান্ডি র ব্লগ, শেষ দৃশ্যে ট্রেনের দুর্ঘটনা র ভিডিওগ্রাফি ও সেই সঙ্গে “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে ” এই রবীন্দ্র সঙ্গীত টি এই নাটকের শেষ দৃশ্যে অসাধারণ ভাবে মিলিয়েছেন এই নাটকের নির্দেশক সমিত দাস।সব মিলিয়ে এই নাটকে সব রসদ বর্তমান।
এই নাটকে চমৎকার অভিনয় করেছেন চোকলা কাকা( চায়ের দোকানের মালিক) বিশ্বনাথ দাস,
ননী (তোতলা) পার্থ সারথি বসু,
পোনা( উত্তম বণিক),ভিখারী/ অভিরাম (রনজিত ধর ),ক্যান্ডি (স্বরাজ ঘোষ) ,সতী (অনিমা দাস) , লুল্লু ( অর্ণব দাস)।
নেপথ্য শিল্পীদের মধ্যে মঞ্চ স্বরূপ দাস, আলো শংকর ভট্টাচার্য,আবহ সঙ্গীতে শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য ,ভিডিওগ্রাফি তে সায়ন্নিতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথাযথ। সবমিলিয়ে লুল্লু নাটক টিকে বর্তমান সমাজ ভাবনা, বাস্তব জীবনের চিরাচরিত ঘটনাকে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন বরানগর এবং এর পরিচালক সমিত দাস।