উদ্বোধনীতে ভিন্ন আঙ্গিক দ্যাখা যায় আউসগ্রামের দুর্গাপুজোয়
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী, আউসগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান-:
বারোয়ারি বা ব্যক্তিগত, যাইহোক না কেন বর্তমানে দুর্গাপুজো উদ্বোধনের বড় ফ্যাশন হলো সেলিব্রিটিদের আগমন। তখন লক্ষ্যের থেকে উপলক্ষ্য বড় হয়ে ওঠে। পুজোর পরিবর্তে সেলিব্রিটিদের দ্যাখার ভিড় বেশি হয়। এরা মূলত চলচ্চিত্র বা সিরিয়াল জগতের সঙ্গে যুক্ত।
কিন্তু জঙ্গলঘেরা আউসগ্রামের সেলিব্রিটি হলো সেইসব মহিলারা যারা সমাজের চোখে ঘৃণিতা। ওদের কেউ বলে পতিতা, বারাঙ্গনা বা বেশ্যা। অথচ পতিতালয়ের মাটি ছাড়া দুর্গাপুজো নাহলেও কেউ ওদের পুজো উদ্বোধনে ডাকেনা।
এখানেই বছরের পর বছর ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে চলেছে আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের অজয় নদের তীরে অবস্থিত পাশাপাশি দুটি গ্রাম গোপালপুর-উল্লাসপুর। এখানে পুজোর উদ্বোধন করতে আসেন সমাজের চোখে ঘৃণিত বৃহন্নলা বা পতিতা মহিলারা। উদ্বোধনী মঞ্চেই পুজো করা হয় তাদের। এর আগে গ্রামের দুজন কৃষককে পুজোর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল পুজো। জানা যাচ্ছে এবার পুজোর উদ্বোধনে দু'জন দেহজীবির পুজো করা হবে।
কেন দেহজীবিদের এনে পুজো করা হয়? গ্রামের বাসিন্দা লেখক-গবেষক রাধামাধব মণ্ডল বলেন, তন্ত্র ও যুদ্ধের এই দেবী অশুভ শক্তির বিনাশে পুজিতা হতেন। ছলনার আশ্রয় নিয়ে ছালনাময়ী দেবী রূপাতিত হয়ে দুই অসুর শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করেন। রূপ পরিবর্তনের জন্যেই হয়তো দেহজীবিদের এনে পুজো করা হয়। এছাড়া একসময় বাংলার বহু গ্রামে ডাকাত দলের হাতেও দেবী পূজিতা হতেন। শোনা যায় নকশাল আন্দোলনের সময় নকশাল অধ্যুষিত এই গ্রামের সমাজ বিচ্যুত নকশালপন্থীদের অনেকেই ডাকাতদলে যোগ দিয়ে এই দেবীর পুজো করতেন। আজও বহু ডাকাতকালী আছে গ্রামে এবং তারা বেশ জনপ্রিয়।
গ্রামে কেন ও কীভাবে পুজো শুরু হয় সেই কাহিনী জানা গ্যালো রাধামাধব বাবুর কাছে। তার উদ্যোগেই গ্রামে সর্বজনীন দুর্গা পুজো শুরু হয়। জানা যাচ্ছে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরীব ক্ষেতমজুর। দুর্গাপুজোর মত ব্যয়বহুল পুজোর আয়োজন করার মত আর্থিক সামর্থ্য তাদের ছিলনা। ওদিকে পাশের গ্রামে জমিদারদের আড়ম্বর সহকারে পুজো হলেও সেখানে এই গ্রামের বাসিন্দারা অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেতনা। কেউ ভালবেসে তাদের হাতে তুলে দেয়নি এক টুকরো প্রসাদের ফল। পুজোর দিনে মন খারাপ করে তারা গ্রামে ফিরে আসে। তারপর ওই ক্ষেততমজুরা তাদের একদিনের আয় দিয়ে অনাড়ম্বর পরিবেশে কষ্ট করেই শুরু করেন পুজো। এখন আবশ্য আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উদ্যোগে গত কয়েক বছর ধরে তারা সরকারি সাহায্য পাচ্ছেন। ফলে বেশ জাঁকজমক করেই পুজো হয়।
মোটামুটি পুজোর প্রায় দুই মাস আগে থেকেই এখানে দেবী প্রতিমা তৈরি করার কাজ শুরু করে দেন বীরভূমের মল্লারপুরের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মৃৎশিল্পী নিতাই সুত্রধর। এবার পুজোর থিম গুহার মধ্যে দেবীর পুজো। ফলে গুহা নির্মাণের কাজও শুরু হয়ে গ্যাছে।
প্রতি বছরের মত এবছরও চতুর্থীর দিন বিকালে পুজোর উদ্বোধন হবে। এবারও মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি।আসবেন দু'জন দেহজীবী মা। প্রচলিত রীতি মেনে থালায় বসিয়ে তাদের পুজো করবেন গ্রামের মানুষ। তারপরই সেই শুরু হবে দুর্গা পুজো।
রাজ্যস্তরের বহু সফল ও কৃতী মানুষ এখানে পুজো দেখতে আসেন। পুজোর সময় আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ধরনের লোক অনুষ্ঠানের। জানা যাচ্ছে বাংলার প্রচলিত রায়বেশে, বহুরূপী, বোলান, ভাদু দলের পাশাপাশি এবার রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্যের অনুষ্ঠানও হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় উপেক্ষা করে যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে চলছে সবকিছুর প্রস্তুতি। হাতে যে একেবারেই সময় নাই।
পুজো কমিটির অন্যতমা সদস্যা রাখী মণ্ডল বলেন, বন্যা ও মহামারীর আঘাতে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে আমাদের এই দুটি ছোট্ট গ্রাম। প্রাণরক্ষার তাগিদে বহুমানুষ আশ্রয় নিয়েছেন বীরভূমের বিভিন্ন গ্রামে। ১৮ পাড়ার গ্রাম আজ পাঁচ পাড়াতে পরিণত হয়ে মাত্র ৫৬ টি পরিবারের বাসস্থান হয়ে উঠেছে। তবুও কালসোনা মেটে, অজয় মেটে, পরিধন কর্মকার, নিমাই মেটে, প্রদীপ ঘোষ, রতন কর্মকার, মিতালী, তুলিকা মণ্ডল প্রমুখদের সৌজন্যে চলে আসছে পুজো। এই পুজো আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের। সত্যিই এএক গর্বের বিষয়।