উড়ান (পর্ব- ৭),
দেবস্মিতা রায় দাস,
পুরো এক হপ্তা টাইট স্কিডিউল গেল পালকের। যেন পলক ফেলারও সুযোগ পেল না। একাধারে অফিস এবং ট্রেনিং তাকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখল। ভালোই রইল, মাথায় কোনো আজেবাজে চিন্তা এসে বসার সময় পেল না। করণ এক দু বার তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও পালক বিশেষ একটা পাত্তা দেয় নি। রোহিত স্যারের সাথে স্যামের ক্লাস চলতে লাগলো রোজ। অনেক উন্নতি হল পালকের মাত্র কদিনেই। দু একটা স্যাম্পল টেস্টও নিল স্যাম ওর।
ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে রোজই পালকের। এক একদিন রাতে জিৎ খাবার নিয়ে চলে আসতো। দুজনে একসাথে ডিনার করত। বাকি দিন পালক কাছেই একটা হোম ডেলিভারি বলে দিয়েছিল। একা অতো রাতে ফিরে রান্না করতে আর ইচ্ছে করতোনা।
কম্পিটিশনে যে কোনো টপিকের ওপর নিজের মতোন করে বলতে হতে পারে জানানো হয়েছিল পালককে। একটু একটু এখনো নার্ভাস লাগছে তার, অবশ্য অনেকটাই আগের থেকে পরিবর্তন হয়েছে। মীরার সাথেও মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে, বেশ হেল্প করেছে তাকে।
ঠিক দুবাই যাওয়ার আগের দিন একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটল পালকের জীবনে। রোহিত রায় একবার ডাকলেন তাকে, গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পালকের বাড়িতে। একটু অবাক হয়েছিল পালক কিন্তু কোনো প্রশ্ন করেনি স্যারকে। গাড়ি গিয়ে থামলো নিউ টাউনে সোজা তার বিশাল বাংলো প্যাটার্ন বাড়ির সামনে। এই ব্লকটায় বেশ অনেকটা ছাড়া ছাড়া বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে। পালকের একটু গা ছমছম করছিল। গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন রোহিত। পালককে হাত ধরে নিয়ে এলেন ভিতরে।
ভিতরটা দারুণ সুন্দর করে সাজানো। একপাশে একটা বিশাল সোফা, নীচে ভেলভেটের কার্পেট বিছানো। সোফার মুখোমুখি বিশাল টিভি,, মাঝে একটা পার্টিশন করে ওপাশে বিশাল ডাইনিং টেবল আর গোটা আষ্টেক চেয়ার। পালকের অবাক ভাবটা কাটতে না কাটতেই রোহিত হাত ধরে ওকে ওপরে নিয়ে গেলেন। ওপরটাও ততোধিক সুন্দর। ওপরে তিনটে ঘর। নিজের বেডরুমে নিয়ে গিয়ে বসালেন পালককে।
পালকের মনে তখন এক অন্য ভয় উঁকি মারছিল। কিন্তু তার সেই ভয়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাকে তার সেই সুবৃহৎ খাটে বসিয়ে, নিজে বসলেন অনেক দূরে পালকের থেকে সামনের সোফায়। পালক জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকে তার দিকে। রোহিত বেশ কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভাবে তার দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা পেগ নিজের জন্য বানিয়ে পালককে একটা অফার করেন। পালক না করলেও সে কথা কানেই তোলেননা। বলেন আজ অনেক কথা বলার আছে তাকে। স্যারের কথায় না করতে পারে না পালক। আজ ওনাকে বড্ড টায়ার্ড আর ডিপ্রেসড লাগে পালকের। নিজের কথা একটু একটু করে বলতে শুরু করেন রোহিত। অবাক হয়ে বসে পালক শোনে আর ভাবে নিজেকে সে যতোটা পরিস্থিতির স্বীকার মনে করত, তার থেকেও আরো অনেক বেশী খারাপ পরিস্থিতি বাকিদেরও আছে।
রোহিত রায়ের বাবার প্রথম পক্ষের ছেলে রোহিত, পরে আর একটি বিয়ে থেকেও তার দুটি ছেলেমেয়ে আছে। মা অনেক ছোটো বয়সেই গত হয়েছেন।তাই রোহিতের জন্য শুধু টাকা ছাড়া তার দেওয়ার আর কিছু ছিল না। সেটা তার অঢেল ছিল। নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। না সময় না ভালোবাসা, কোনোটা ছিল তার জন্য। বিয়েতেও তেমন সুখী হননি রোহিত,, কয়েক বছরের মধ্যেই ডিভোর্স হয়। এখন এখানে একাই থাকেন। পালক একটু অবাক হল, স্যার ডিভোর্সি এটা সে জানতো না।
কথা বলতে বলতে ভালোই ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন তিনি, পালক উঠে গিয়ে তার পাশে বসে হাতটা ধরে। সাথে সাথেই কাউকে আঁকড়ে ধরার মতোন পালককে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। তারপর অনেক্ষণ কাঁদলেন তার কোলে মাথা রেখে। পালক তাকে ধরে নিয়ে এসে আস্তে আস্তে বিছানায় শুইয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অকাতরে ঘুমিয়ে পড়লেন, যেন কারুর সাথে তার বোঝাটা শেয়ার করে নিজেকে খালি করতে পেরেছেন। পালক হতভম্ব বসে রইল.. সেদিনের সেই রোহিত রায়কেই কি আজ দেখল? আর হঠাৎ তার সাথেই বা আজ তিনি এতো কথা শেয়ার করলেন কেন??
পরেরদিন খুব ভোরে ছিল তাদের ফ্লাইট। ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছে পালক দেখল বাকিরা সবাই পৌঁছে গেছে। মীরা তাকে একটা হাই করল। রোহিত রায় তখনো এসে পৌঁছাননি। বাকিদের মধ্যে আর জে রাহুল ছিল, যার সাথে পালকের সেই পার্টিতে দেখা হয়েছিল। আরো কারুর কারুর মুখ চেনা, কিন্তু সেভাবে আলাপ নেই। আর সে একদম নতুন আর এই কদিনেই চ্যানেলের ম্যানেজমেন্ট হেডের ক্লোস হওয়ার সুবাদে একটা ঈর্ষা আছেই অনেকের তার প্রতি। পালক মীরাকে ছেড়ে খুব একটা নড়ল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই রোহিত রায় আর রীনা ম্যাডাম এসে পড়লেন। হঠাৎ বিরক্তিতে পালকের মুখ কুঁচকে গেল। সে জানতো না করণও যাবে তাদের সাথে। করণের মুখে হাসি তাকে দেখে, পালক মুখ ফিরিয়ে রইল।
লাউঞ্জে মীরা কফি আনতে যেতেই পালককে ধরল করণ….
“হাই, গ্ল্যাড টু সি ইউ হিয়ার পালক.. ওয়ান্ট টু কনগ্র্যাচুলেট ইউ ফ্রম হার্ট!”
পালকের ইচ্ছা হল বলে তাতে তোমার কোনো ক্রেডিট নেই, রোহিত স্যারের জন্য আর আমার নিজের দমে হয়েছে। কিন্তু মুখে বলল..
“ইয়াহ, থ্যাংকস”।
বলেই তাকে কাটিয়ে কফি কাউন্টারে মীরার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। করণের মুখটা একটু শক্ত হল, কিন্তু মীরার পাশে যাওয়ার সাহস হল না। মীরাকে এখানে সবাই খুব শক্ত মেয়ে হিসাবেই জানে। একবার ম্যানেজমেন্টের কেউ জবরদস্তি করার চেষ্টা করায় কষিয়ে এক থাপ্পড় মেরেছিল সে। তারপর রেজিস্টারড মেইল থেকে ডিরেক্ট মেইল করে দেয় কর্ণধারকে। সেই লোক সাসপেন্ড হয়ে গিয়েছিল।
ফ্লাইটেও পালক মীরার পাশেই বসেছিল। তার জীবনে এই প্রথম ফ্লাইটে চড়া। ফ্লাইটটা যখন উপরে উঠছিল, তখন শক্ত করে মীরার হাতটা ধরেছিল পালক। মীরা হাসছিল। চোখ খোলার পর অতো উপর থেকে নীচেটা দেখতে দারুণ লাগছিল তার। সবকিছু যেন একদম ছোট, তার সমস্ত দুঃখ কষ্ট ছেড়ে যেন অনেক অনেক দূরে চলে এসেছে। রীনা ম্যাডাম সবাইকে কি খাবে বলতে বলায় একটা স্যান্ডউইচ নিল পালক।
ফ্লাইট থেকে নীচে নেমে এবার পালকের তাক লাগার পালা। বিশাল ঝাঁ চকচকে দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট তার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। চারপাশে তাকিয়ে দেখে অগুন্তি মানুষের ভিড় আর দুর্দান্ত সব আউটলেটস। সে নিজে একটা নর্মাল জিন্স টি আর শু পড়ে এসেছে। আশপাশের দুর্দান্ত সব পোশাক আশাক দেখে তার নিজেকে কেমন ‘আউট অফ প্লেস’ ফিল হতে লাগলো। মীরা তার মনোভাব কতোকটা বুঝেই তার কানে কানে বলল..
“কোনো চিন্তা কোরোনা পালক, হোটেলের স্পাতে নিয়ে যাব তোমায়.. তোমার একটু গ্রুমিং দরকার!”
পালক একটু হেসে তাকালো তার দিকে।
পাঁচতারা হোটেল তাজে পৌঁছে আর একবার তাক লাগার পালা পালকের। ঘরগুলো যেন দু তিনটে ঘরের সমান। এক একটা ঘরে দুজন করে। বাকিদের মনোভাব খুব একটা সুবিধের না বুঝে মীরার সাথেই তাকে রাখার সিদ্ধান্ত নেন রীনা ম্যাডাম। ঘরে কি নেই। বিশাল জানালা দিয়ে বুর্জ খলিফা দেখতে পাওয়া যায়। বিশাল ওয়াশরুম তাতে বিশাল বাথটাব বসানো। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে পালকের চোখে আবার জল এল, মার কথা ভেবে.. মা আজ তাকে এখানে দেখতে পেলে কতো খুশি হতেন।।
ক্রমশ