এক্সিডেন্ট
দেবস্মিতা রায় দাস
।। ১।।
"একি আপনারো দেখছি একই বদভ্যেস আছে"..
চমকে উঠল স্বাতী একটি অজানা কন্ঠে। সবেই তাদের গ্রুপের একজনের লেখা খুব মনোযোগ সহকারে পড়ছিল ও। লেখালেখির একটা বেশ প্রচলিত গ্রুপ এটি। স্বাতী ও তার অনেকগুলি লেখা এখানে দিয়েছে। আজ এতো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও ওই লেখাগুলোতেই বাঁচার প্রেরণা পাচ্ছিল ও।
আজ প্রায় চার দিন হল স্বাতীর হাসব্যান্ড অরিন্দম আই সি ইউ তে। অফিস থেকে ফেরার পথে ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট হয়েছিল বুধবার রাতে। আজ রবিবার। এই কদিনেই চোখমুখ বসে গেছে তার। চার বছর হল বিয়ে হয়েছে তাদের.. অরিন্দম খুব বেড়াতে ভালবাসে। সেদিনও অফিস যাওয়ার আগে বলছিল জানুয়ারি মাসে বেড়াতে যাওয়ার কথা। সেদিনের কথা মনে আসতেই স্বাতীর চোখ ছলছল করে উঠল। একরাশ বাষ্প ভরা চোখে তাকালো পাশে বসা লোকটির দিকে। খুব অগোছালো পোশাক, চুল আর দাড়িগোঁফ এর মাঝখানে মুখের হাসিটি ভারি সুন্দর। এই অবস্থাতেও স্বাতীর কেমন মায়াই হল লোকটিকে দেখে। কেমন যেন মনে হয় নিজের খেয়ালটাও গুছিয়ে রাখতে পারেনা। তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই মানুষটি একটি অস্বস্তি ভরা হাসি হাসল..
“মানে ওই লেখালেখির অভ্যেস আর কি! আপনার তন্ময় হয়ে পড়া দেখেই মনে হল আপনিও লেখালেখি করেন। কি ঠিক বললাম তো??”
যতোই আন্তরিক সুরে কথাটা বলুক না কেন, এবারে স্বাতীর একটু রাগই হল এই গায়ে পড়ে নিজের থেকে কথা বলতে আসা মানুষটির উপর। একটু খর ভাবে বলল..
“আপনি কি করে জানলেন আমি লিখি? অন্যের লেখাও তো পড়তে পারি আমি?”
একটুও না রেগে ততোধিক নরম স্বরে লোকটি বলল,
“এই দেখেছেন, রাগিয়ে দিলাম তো! আমি ঠিকমতোন না গুছিয়ে কথাগুলো প্রকাশ করতে পারিনা। কি বলতে কি বলে ফেলি.. আর সকলে রেগে যায়”।
স্বাতী কটমট করে তাকাতে গিয়ে দেখে সামনে ডক্টর গুহ আসছেন অরিন্দমের বাবার সাথে। মা ওর ছোটবেলাতেই মারা গেছিলেন। অরিন্দম একমাত্র ছেলে। বিয়ের পাকাদেখার সময় তিনি স্বাতীকে বলেছিলেন..
“বৌমা করে না, মেয়ে করে তোকে নিয়ে যাচ্ছি ঘরে। নিজের মতোন করে গুছিয়ে নিস মা”।।
।। ২।।
গলার কাছটা কেমন ফুলে উঠল স্বাতীর অভিমানে। কতোদিন বলেছে অরিন্দমকে একটু আস্তে চালাতে। মাঝে মাঝে বেশ জোরে ড্রাইভ করত। স্বাতী ভয় পেয়ে গেলে বলত..
“এই স্পীডে চালানোর মধ্যে একটা অদ্ভুত মজা আছে জানো স্বাতী.. আশেপাশের সবকিছু অনেক ছোট আর আবছা লাগে”।
দুজনের মুখ দেখে স্বাতীর বুকটা বেশ একটু কেঁপেই ওঠে। খুব ভাল অবস্থা তো মনে হয় না। স্বাতীর বাবা মাও প্রায় রোজই আসছেন। আজও একটু পরেই তারা এসে যাবেন। আরো কিছুক্ষণ ডক্টর গুহর সাথে কথার পর অরিন্দমের বাবা পৃথ্বীশবাবু স্বাতীর পাশে এসে বসলেন। তার মুখ দেখে স্বাতীর চোখ ফেটে জল আসার উপক্রম হল। শুধু মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে পারলোনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন..
“আরো দুটো দিন না গেলে সেভাবে কিছু বলা যাবেনা। তুই মনের জোর রাখ মা, দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে”।
অশ্রুভরা সম্ভ্রমের চোখে স্বাতী তাকিয়ে থাকে এই পরমাশ্চর্য মানুষটার দিকে। তাকে কোনো সন্ন্যাসীর থেকে কম মনে হয় না স্বাতীর।
সেদিন বাড়ি ফিরেও প্রায় সারাক্ষণ স্বাতীর মন ভারাক্রান্ত হয়েই রইল। ঢুকে দেখল কৃষ্ণাদি ভালোই গুছিয়েই সব করে দিয়ে গেছে। এই কদিনে বৌদি যে কোনো দিকেই মাথা দিতে পারছে না সেটা বুঝেই সে যেন অনেকটাই নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। বাবাকে খেতে দিলেও নিজে সে বিশেষ কিছু খেতেই পারলোনা। কোনোমতে একটু মুখে দিতে পারলো। এক দুটো গল্প একটু দেখতে দেখতে কখন যে তার চোখদুটো লেগে এল স্বাতী নিজেই টের পেলোনা।।
।। ৩।।
বিয়ের আগে স্বাতী একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াতো। বিয়ের পরে যে এই বাড়ির থেকে একদম বারণ ছিল তা নয়, তবে এই কথা কোনোভাবে উঠলেই অরিন্দমের একটু অনিচ্ছাই যেন প্রকাশ পেত কোনোভাবে.. পৃথ্বীশবাবু কিন্তু তাকে সাহস জোগাতেন সবসময়..
“তুই তো বাড়িতে বসে থাকার মেয়ে নস মা.. বাইরে বেরোবি জগৎ দেখবি.. তবে না আসল বেঁচে থাকার মজা!!”
তাকে নিজের বাবার মতোনই শ্রদ্ধা করত স্বাতী।
পরেরদিন নার্সিংহোমে গিয়ে সেই আজব লোকটিকে আবার দেখতে পেল স্বাতী। সেও একবারেই তাকে দেখতে পেয়ে একটু সৌজন্যতামূলক হাসি বিনিময় করল। যদিও তাকে এড়িয়েই চলে যেতে চাইছিল স্বাতী.. তবু ওর মুখটা যেন আজ আরো বেশী দুখাতুর.. আরো স্পর্শকাতর! দেখলে সত্যিই কেমন মায়া হয়। পাশে গিয়ে বসল তার। নয়াম জানলো পলাশ। ভিসিটিং আওয়ার এখনো শুরু হয়নি, বসতে হবেই। আই সি ইউ তে কড়াকড়ি অনেক বেশী। যা জানতে পারলো, তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ! পলাশের স্ত্রী আজ একমাস হল এখানে ভর্তি। ব্রেন টিউমার। কোনো উন্নতির লক্ষণই নেই, বরং দিনে দিনে অবস্থা আরো বিগড়োচ্ছে। বাড়িতে বয়স্ক বাবা, আর কেউ নেই। সম্বল যা কিছু ছিল, কুড়িয়ে বাড়িয়ে এই কদিনে তা প্রায় শেষ। এতোকিছুতেও স্বাতী শুধু অবাক হয়ে দেখল তার সেই অমলিন মুখের হাসিটুকু কেউ ক্ষয় করতে পারেনি!
।। ৪।।
আই সি ইউ তে ঢুকলেই মনটা এমনিই কেমন বিষাদময় হয়ে আসে স্বাতীর। চতুর্দিকে যেন মৃত্যুর হাতছানি। পেশেন্ট এবং তাদের বাড়ির লোকদের অসহায় চাহনি যেন তাকে গ্রাস করে এখানে এলে। আজ যখন অরিন্দমের বেডের পাশে দাঁড়ালো,, মনটা যেন অন্য দিনের থেকেও অনেক বেশী ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল স্বাতীর! এখনও তেমন কোনো স্পন্দন নেই অরিন্দমের, আজ প্রায় পাঁচ দিন হল। পাঁচ দিন ধরে এমনি পড়ে আছে সে কোমায় নিথর, নিশ্চুপ। যদিও ডক্টর রা বলেছেন জ্ঞান ফিরতে আরো এক- দু দিন লাগতে পারে। স্বাতীও তার পাশে বসেই নিশ্চুপ বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে দিল। পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো খুব বেশী করে এসে আছড়ে পড়ছিল তার মনের তটে। অরিন্দম খুব মিষ্টি খেতে ভালোবাসতো। দুপুরে আর রাতে খাওয়ার পরে একটা করে চাইই চাই। কতো ঝগড়া করেছে স্বাতী। এতো বেশী খেওনা.. সুগার হয়ে যাবে! কে কার কথা শোনে। হো হো করে হেসে বলত..
“লাইফটা এনজয় করতে শেখো বুঝলে, নয়তো একদিন হঠাৎ করে চলে যাব.. তখন আর কিছুই হবেনা”।
দীর্ঘশ্বাস পড়ল স্বাতীর.. হঠাৎ করেই তো এমন ঘটনা ঘটল!! কি থেকে যে কি হয়ে গেল। এই পাঁচদিন আগে কি একবারও ভেবেছিল স্বাতী.. এমন কিছু হতে পারে?
পৃথ্বীশবাবু এসে পড়লেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। ওনার মধ্যে যেন কি অদ্ভুত এক প্রাণ আছে, বুঝতে পারে স্বাতী। এতো কিছুর মধ্যেও কি দুর্জয় মনের বল ওনার। এসে স্বাতীর মাথায় আলতো করে হাত রাখাতেই মনে অনেক বল পায় স্বাতী। আজ তার বাবা মাও এসেছে। সকলের সাথে বসে লবিতে ওয়েট করে সে ডক্টরের সাথে কথা বলবে বলে। ডক্টর গুহ কিছুক্ষণের মধ্যেই এলেন। সকলকে অবাক করে দিয়ে বেশ খুশি মুখেই বললেন উনি যে অরিন্দমকে উনি দেখে এসেছেন এবং আস্তে আস্তে রিকভারির সাইন উনি দেখতে পাচ্ছেন। আর এক দুই দিনের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকটা নিশ্চিন্ত হল স্বাতী সহ বাকি সকলে। বাইরে এসে খোলা আকাশের নীচে একটা বিশাল স্বস্তির শ্বাস ফেলে স্বাতী। হঠাৎ একটু দূরে রাস্তার ওপারে কিছু জনসমাগম তার নজর কাড়ে। ভাল করে দেখে বুঝতে পারে একটা এম্বুলেন্সে ডেড বডি তোলা হচ্ছে। হঠাৎ সেখানে পলাশকে দেখতে পেয়ে স্বাতীর বুকটা ছাঁৎ করে উঠল! তবে কি?? অদ্ভুত নিস্তব্ধ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। তার প্রাণহীন শুষ্ক মুখের দিয়ে তাকিয়ে চোখ ভরে যায় জলে স্বাতীর। সে হয়তো তার কেউ হয় না, তবে এই কদিনেই একই জায়গায় একরকম কষ্টের সাথে জড়িয়ে থাকার কারণে কেমন যেন মনের আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে। তার দিকে চোখ পড়তেই স্বাতীকে অবাক করে দিয়ে পলাশ ওই দিকে ডাকলো তাকে। ধীর পায়ে কাছে যেতে বলল..
“অনেক দিন লড়াই করেছিল দ্বিতি, আমার স্ত্রী, আর পেরে উঠলোনা। আজ সকালেও যখন কথা হল তোমার সাথে.. তখনো ভাবিনি আজই সব শেষ হয়ে যাবে”….
বাইরে খুব শক্ত থাকার চেষ্টা করলেও গলা ধরে আসে পলাশের..
“জানিনা তোমায় কেন এতো কথা বলি.. প্রথম দিন দেখার পর থেকেই তোমায় কেমন জানি আপন মনে হত, খুব কাছের মনে হত.. আর তাই তুমি রাগ করলেও কথা বলতাম তোমার সাথে”….
এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে স্বাতীর চোখ দিয়ে। সেও কি অস্বীকার করতে পারে এই কদিনে সত্যি পলাশের সাথে তারও কি এক প্রকার আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে.. তার মুখের ওই হাসিটুকু তাকে অনেকটাই মনের জোর প্রদান করে। তার আগামী দিনেও যে অনেক লড়াই আছে তা লড়তে সাহায্য করে। সূর্যের নব কিরণের মতোন পলাশের হাতে হাত রাখে স্বাতী, এক অমলিন আশ্বাসের মতোন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।।