কদমডাঙ্গার পথে ছোট আলুন্দা

Spread the love

খায়রুল আনাম,

কদমডাঙ্গার পথে ছোট আলুন্দা
নেশামুক্ত গ্রাম গড়ার ডাক আরও উচ্চগ্রামে পৌঁছক
   
জেলা বীরভূমের সদর শহর সিউড়ি থেকে  জেলার বাণিজ্যিক শহর সাঁইথিয়া যাওয়ার  পাকা  সড়কের পাশে বর্ধিঞ্চু গ্রাম ছোট আলুন্দা।  যে গ্রামের যুব সম্প্রদায় থেকে অন্য বয়সের মানুষেরাও এখন মাদকের নেশায় বুঁঁদ।  নিত্য অশান্তি বহু পরিবারে।  পরিবারের লোকজনদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে পরিবারের লোকই সেই অর্থ তুলে দিচ্ছে মাদক কারবারিদের হাতে। কেউ নেশাদ্রব্য যেমন বাইরে থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসছেন তেমনি, রয়েছে ‘হোম   ডেলিভারির’ ব্যবস্থাও। মাদক আসক্তদের মৌ-তাতে সমস্যা নেই কোনও দিক থেকেই। আশপাশের  কাখুড়িয়া, কুখুডিহি, ইটাগড়িয়ার মতো গ্রামের মানুষ গ্রামে মাদক বিক্রি নিষিদ্ধ করার ফলে মাদক কারবারিরা  ছোট আলুন্দা গ্রামের ক্যানেলপাড়ে  এসে, এখানকার মাদক কারবারি ও মাদক গ্রহণকারীদের হাতে তা তুলে দিচ্ছিল। সেই মাদকই ছড়িয়ে পড়ছে ছোট আলুন্দা গ্রামে। ইতিমধ্যেই ছোট আলুন্দা গ্রামের ১০ জন যুবকের মৃত্যু হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে।    মাদকের কারণে গ্রামের গোটা ত্রিশ পরিবার এখন  সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব। অনেক পরিবারে সব গহনা বিক্রি হয়ে গিয়েছে এই মাদকের গ্রাসে পড়ে।       বর্ধিঞ্চু ছোট আলুন্দা গ্রামের যুব সম্প্রদায়ের এই পরিনতি রুখতে এবার এগিয়ে এসেছেন গ্রামের মানুষ এবং গ্রামের  ৬টি মসজিদের  ইমামরাও। মসজিদের নামাজিদেরও  বলা হয়েছে,  যে কোনও ভাবেই হোক, গ্রামকে নেশামুক্ত করে ছোট আলুন্দা গ্রামকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।  এজন্য  মসজিদের মাইক থেকে প্রচার করা ছাড়াও  টোটোয় মাইক বেঁধে  গ্রামের যে সব পাড়ায় মাদকাসক্তের  সংখ্যা বেশি,  সেই সাহাপাড়া,  মাহারাপাড়া, ডোমপাড়া, বেলতলা বাসস্ট্যাণ্ড আর বাগ্দীপাড়ায় জোর প্রচার কর্মসূচীও নেওয়া  হয়েছে।  গ্রামের বড় মসজিদের ইমাম মৌলানা  আবুল লতিফ জানিয়েছেন, এবার আমরা নেশামুক্তিতে নেমেছি। তাতে সফলতাও আসছে।  তবে, এই সফলতাকে আরও সাফল্যের জায়গায় নিয়ে যেতে হলে, মাদক বিরোধী কর্মসূচীর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। গ্রামে মাদক কারবারের সহযোগী হিসেবে যে ১০ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের উপরে সর্বদা নজরদারি চালানো হচ্ছে। কেউ মাদক সেবন করলে বা বিক্রিতে  সহায়তা করলে তার জরিমানা করার সাথে সাথে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে।  আর কেউ যদি মাদক কারবারিকে হাতেনাতে ধরতে পারে তাহলে তাকে  ২ হাজার টাকা পুরষ্কার দেওয়ার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে।  গ্রামের একটি ক্লাবের সদস্যরা গোটা গ্রাম জুড়ে নজরদারিও চালাচ্ছেন।  কেবলমাত্র কিছু সরকারী প্রকল্প রূপায়ন আর সকলকে স্কুলে পাঠানোর মধ্যে দিয়ে যে একটি গ্রাম কোনওভাবেই আদর্শ গ্রাম হয়ে উঠতে পারে না, সেটাই এখন উপলব্ধি করছেন গ্রামের মানুষজন।  আদর্শ গ্রাম গড়ে তুলতে হলে, সবার আগে  বর্তমান সময়ে যে সঙ্কট তৈরী হয়েছে সেই মাদকের নেশামুক্ত গ্রাম গড়ে তুলতে না পারলে যে, কোনও সাফল্যই আসবে না, সেটাই উপলব্ধি করছেন ছোট আলুন্দা গ্রামের মানুষজন। তাই এখন গ্রামে চলছে প্রাণ বাঁচাতে মাদকের বিরুদ্ধে  প্রাণপন লড়াই।           এমনই একটা সময় দেখা গিয়েছে, জেলার খয়রাশোলের কদমডাঙা গ্রামে। যে গ্রাম শুধুমাত্র মাদকের বিরুদ্ধেই লড়াই করেনি, তারা একটা সময় গ্রামে মুক্ত শৌচকর্ম বন্ধ করতে বহুবিধ প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছে। গ্রামের বাইরে কেউ জঙ্গলে বা পুকুরপাড়ে মুক্ত শৌচকর্ম করলে, সেখানে গ্রামের পরিবেশ প্রেমী মানুষেরা দাঁড়িয়ে থেকেছেন কোদাল হাতে। কেউ মুক্ত জায়গায় মলত্যাগ করলে তা কোদালে মাটি তুলে ঢাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।  গ্রামে বন্ধ করা হয়েছে  প্লাস্টিকের ব্যবহার। গ্রামে কেউ প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ নিয়ে প্রবেশ করলে তার সেই প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ নিয়ে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে কাপড় বা কাগজের ব্যাগ। কোনও পরিবারের কেউ মাদক গ্রহণ করলে, সেখানে হয়েছে নিঃশব্দ প্রতিবাদ। রাত্রে ঘর ছেড়ে বাড়ির মহিলারা এসে বসেছেন গ্রামের আটচালায়। তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন গ্রামের মানুষজন। একটা সময় দেখা গিয়েছে, গ্রামের আটচালায় মহিলাদের ভীড় বাড়লেও, ধীরে ধীরে তা ফিকে হয়েছে।  সব মহিলাই রাত্রে  ফিরে গিয়েছেন নেশামু্ক্ত পরিবারের মানুষের কাছে। সেই সময় ওই গ্রামের  মানুষের আত্মোপলব্ধির শরীক হয়ে দৈনিক স্টেটসম্যান-এ ‘ভারতের সব গ্রাম কদমডাঙা হোক’ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরে চলচ্চিত্র জগতের সব্যসাচী চক্রবর্তী যেমন কদমডাঙা গ্রামে চলে এসেছিলেন তেমনি, বিহার বিধানসভার একটি প্রতিনিধি দল কদমডাঙা গ্রামে এসে এতটাই মুগ্ধ আর আপ্লুত হয়েছিলেন যে, তাঁরা  রাজ্যে মুক্ত শৌচকর্ম বন্ধ আর মাদকের নেশামুক্ত হওয়ার  কদমডাঙা গ্রামকে তাঁদের কাছে মডেল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে বলে জানিয়ে গিয়েছিলেন। এই কদমডাঙা গ্রামেই আয়োজন করা হয়েছিলো তালের বড়া আর তালের বিভিন্ন স্বাদের   পিঠের সমাহারে। যা চেখে দেখতে কদমডাঙায় হাজির হয়েছিলেন জেলা প্রশাসনের বহু আধিকারিক। প্লাস্টিক আর মাদক বর্জনের বার্তা নিয়ে কদমডাঙার যুবকেরা হাজির হয়েছিলেন দীঘার সমুদ্র তীরে। সেই মাদক বর্জনের বার্তা নিয়ে এবার জেগে উঠতে চাইছে জেলার আরেক গ্রাম ছোট আলুন্দা। এভাবেই তৈরী হবে স্বপ্নের গ্রাম ভারত–এমন প্রত্যাশা নিয়েই আমাদের বেঁঁচেবর্তে থাকার স্বপ্ন পূরণের পথ প্রশস্ত হবে বলেই তো, বিশ্বাসের সাথে আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি ।।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *