কাবুলিওয়ালা – মুগ্ধ নাট্যপ্রেমী গুসকরাবাসী
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
শত পরিবর্তনের মধ্যেও বাৎসল্য প্রেম যে দেশ ও কালের সীমা অতিক্রম করে যুগ যুগ ধরে শ্বাশত ও অমলিন থেকে গেছে তার একটা নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের 'কাবুলিওয়ালা' গল্পে। ধর্ম বা ভাষা সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সেই কাহিনীকেই অসাধারণ অভিনয় দক্ষতায় উপস্থিত দর্শকদের সামনে জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন শিশু শিল্পী বিহান চ্যাটার্জ্জী ও ডা. বাসুদেব মুখোপাধ্যায় সহ নাটকের অন্যান্য শিল্পীরা।
হল ভর্তি দর্শকদের সামনে ৭ ই জানুয়ারি 'থিয়েটার প্রাকটিশনারস' -এর প্রযোজনায় ও 'হ-য-ব-র-ল' এর পরিবেশনায় গুসকরা বিদ্যাসাগর মেমোরিয়াল হলে আয়োজিত হয় 'কাবুলিওয়ালা'। গল্পটির নাট্যরূপ দিয়েছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়।
গল্পের প্রধান চরিত্র রহমত সুদূর আফগানিস্থান থেকে কলকাতায় ব্যবসা করতে আসে। দশজন পিতার মতো তার হৃদয়েও সন্তান বাৎসল্যের কোমল স্নিগ্ধতা বিরাজিত। তাইতো কলকাতায় আসার সময়
ভূষো কালি মাখিয়ে মেয়ের হাতের ছাপ কাগজে নিয়ে আসে। তার মধ্যেই মেয়ের অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করে। সেই হাতের ছাপের স্পর্শ বাবা-মেয়ের মধ্যেকার দূরত্বকে কমিয়ে দেয়।
গল্পের অপর চরিত্র মিনি একদিন তার বাড়ির সামনে দিয়ে কাবুলিওয়ালাকে যেতে দেখে ‘কাবুলিওয়ালা ও 'কাবুলিওয়ালা’ বলে ডাক দেয়। তার আকুল ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের মেয়ের কথা ভেবে ব্যাকুল হয়ে রহমত তার ঘরে যায়। মিনিকে দেখার পর কন্যা স্নেহে বুভুক্ষু পিতৃহৃদয় মিনির মধ্যে মরু পর্বত বেষ্টিত সুদূর আফগানিস্থানে রেখে আসা নিজের মেয়ের ছবি দেখতে পায়। রহমত তার বিরহী পিতৃহৃদয়ের জ্বালা জুড়োতে মিনির ক্ষুদ্র হৃদয়ের অনেকখানি জয় করে নেয়। দুই অসমবয়সীর মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে দু'জনের মধ্যে জন্ম নেয় যুগযুগান্তরের বাৎসল্য প্রেম।
নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কাহিনী এগিয়ে চলে। রহমতের জেল হয়। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমেই ছুটে আসে মিনির কাছে। বধূবেশিনী মিনিকে দেখে সে থতমত খেয়ে যায়। বুঝতে চায়নি তার ‘খোঁকী’ মিনি অনেক বড় হয়ে গেছে।
রহমত যখন আবেগ ঘন কণ্ঠে বলে 'আপনার যেমন একটি লড়কী আছে তেমনি তারও দেশে লড়কী আছে', অথবা 'ভূষো কালি মাখানো হাতের ছাপ যখন দেখায়' দর্শক চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা। মিনির সেই আকুল কণ্ঠের ‘কাবুলিওয়ালা' ও 'কাবুলিওয়ালা’ ডাক শুনে রহমতের চমকে ওঠা দেখে দর্শক মুগ্ধ হয়ে ওঠে।
নাট্যকারের বিমূর্ত ভাবনা তখনই মূর্ত হয়ে ওঠে যখন নাটকের চরিত্ররা সেগুলির বাস্তব রূপ দিতে সমর্থ হয়। এখানেই কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন ‘কাবুলিওয়ালা’ ডা. বাসুদেব মুখোপাধ্যায় ও ‘মিনি’ বিহান চ্যাটার্জ্জী। তাদের প্রতিটি সংলাপের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ফুটে উঠেছে। কখনোই অতিরঞ্জিত মনে হয়নি। ৯ বছরের শিশু শিল্পী বিহান তো অসাধারণ। দু’জনের রসায়ন বারবার দর্শকদের মুগ্ধ করে।
মিনির বাবার চরিত্রে কৃষ্ণেন্দু ব্যানার্জ্জী ও মায়ের চরিত্রে রিমি ধর খুবই উচ্চমানের এবং স্বাভাবিক অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে যে দক্ষতায় রিমি দেবী অভিনয়ের মাধ্যমে নিজের চরিত্রের বিবর্তনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাতে কোনো প্রশংসায় যথেষ্ট নয়। শেষ দৃশ্যে একদিকে কাবুলিওয়ালা যখন নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছে এবং মঞ্চে মিনির মা-বাবার অভিনয় দেখে অনেক দর্শক চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। এখানেই নাটকের স্বার্থকতা।
নাটকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মঞ্চসজ্জা। নাটকের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট নাট্য সংস্থার মঞ্চসজ্জা ছিল যথাযথ। নাটকে শব্দ প্রক্ষেপণে জয়ন্তকৃষ্ণ পাল, আবহ সঙ্গীত স্বপন বন্দ্যোপাধায়, আলো সুব্রত সরকার –
নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক অভেদানন্দ থাণ্ডার, পূর্ব বর্ধমান জেলা তৃণমূলের সহ-সভানেত্রী মল্লিকা চোংদার, প্রবীণ চিকিৎসক ডা. শ্যামল দাস, গুসকরা শহর যুব তৃণমূল সভাপতি দেবব্রত শ্যাম, বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, ভাইস চেয়ারম্যান বেলি বেগম এবং চেয়ারম্যান কুশল মুখার্জ্জী সহ অনেক নাট্যপ্রেমী মানুষ।
এর আগে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন ডা. শ্যামল দাস। তাকে সহযোগিতা করেন অভেদানন্দ থাণ্ডার, মল্লিকা চোংদার ও বেলি বেগম। অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায় এবং পরে আরও একটি সঙ্গীত পরিবেশন করেন হ-য-ব-র-ল এর সদস্যরা। অনুষ্ঠানের শেষে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শিল্পীকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়।
বিশিষ্ট অভিনেত্রী তথা নাট্য নির্দেশিকা ইন্দ্রানী গুপ্ত বললেন - হৃদয়স্পর্শী গল্প হলো 'কাবুলিওয়ালা'। অভিনয়ের গুণে সেটা মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে। আশাকরি সবার অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করবে।
উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায় বললেন - নাট্যপ্রেমী মানুষদের কাছে একটি সুন্দর নাটক উপহার দিতে পেরে আমরা খুব খুশি। সবার ভাল লেগেছে জানতে পেরে আমরা আনন্দিত।