কালীপুজোয় মেতে উঠতে চলেছে আপামর বাঙালি
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
মাঝে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। তারপরই বাঙালি সমাজ মেতে উঠতে চলেছে কালী পুজোয়। পুরাণ অনুযায়ী পুরাকালে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই দৈত্য বিশ্বজুড়ে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। তাদের কাছে দেবতারাও পরাস্ত হয় ও দেবলোক ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যাশক্তি মা পার্বতীর তপস্যা করতে থাকেন। দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তার কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর শরীর থেকে অন্য এক দেবীর সৃষ্টি হয় যা ভক্তদের কাছে 'কৌশিকী' নামে পরিচিত। কালীপুজোর সেই শুরু।
আগে তাম্রপটে মায়ের মূর্তি এঁকে কালীপুজো করা হতো। জানা যায় সপ্তদশ শতকে নবদ্বীপের তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম কালীমূর্তি তৈরি করে বাংলায় কালী পুজোর প্রচলন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজের সৌজন্যে এই পুজো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরে তার পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার কয়েকজন ধনী জমিদারের হাত ধরে কালীপুজো আরও জনপ্রিয়তা লাভ কর। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, রামপ্রসাদ, বামাক্ষ্যাপা প্রমুখ সাধকদের সৌজন্যে বাঙালির ঘরে ঘরে কালীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে।
কালীপুজো অন্ধকার ও অশুভ শক্তির বিনাশের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। দুর্গাপুজোর পরের অমাবস্যাতে তন্ত্র মতে দীপান্বিতা কালী পুজো করা হয়। মহালয়ার সময় পূর্বপুরুষদের বিদেহী আত্মারা উত্তর পুরুষের হাতে জল গ্রহণের জন্য মর্ত্যে আসেন এবং দীপাবলি পর্যন্ত মর্ত্যেই থাকেন। বিশ্বাস দীপাবলির অমাবস্যা তিথিতে ফের আত্মারা ফিরে যান স্বর্গলোকে। অন্ধকারে তাদের ফিরে যেতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় তারজন্য তাদের পথ আলোকিত করে রাখতে ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালানো হয়।
আমরা মা কালীর চতুর্ভুজা রূপের দর্শন পাই। তার একদিকের এক হাতে আছে খড়গ ও অন্য হাতে কাটা মুণ্ড। অর্থাৎ তিনি অশুভ শক্তির বিনাশকারী। অন্যদিকের হাতে থাকে অভয় মুদ্রা ও বর মুদ্রা। অর্থাৎ সন্তানদের তিনি অভয় দান ও বর দান করেন। গলায় থাকে নরমুণ্ডের মালা। গায়ের রঙ কালো বর্ণের। রক্তবর্ণের লাল জিভ মুখ থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকে। তিনি এলোকেশি। মা কালীকে দেখা যায় শিবের বুকের উপর পা দিয়ে জিভ বার করে দাঁড়িয়ে আছেন। এককথায়, মা কালী দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেন।
শুধু বাঙালির ঘরে ঘরে নয়, রাজ্যের প্রতিটি থানায় কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয়। নিজেদের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি সমস্ত ধর্মের পুলিশ কর্মীরা কালীপুজোয় অংশগ্রহণ করে থাকেন। সাংস্কৃতিক ও প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সেবামূলক কাজও হয়।
তবে থানার মত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে কেন কালীপুজো হয় তার কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়না। এটা নিয়ে মাঝে মাঝে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। প্রবীণ পুলিশ আধিকারিকদের একাংশের মতে, আগেকার দিনে ডাকাতরা সফল হওয়ার জন্য ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে কালীর আরাধনা করত। ডাকাত দমনে পুলিশও যাতে সফল হয় তার জন্য থানাতে কালীপুজো শুরু হয়। তাছাড়া সাধারাণ মানুষ যাতে ভালো থাকেন, আইন শৃঙ্খলা বজায় থাকে, দুষ্কৃতিদের কড়া হাতে মোকাবিলা করা যায় তারজন্য পুলিশ থানায় শক্তির দেবী কালী মায়ের পুজোর আয়োজন করে থাকে।
থানায় কালীপুজোর আয়োজন জনিত বিতর্ক সম্পর্কে প্রবীণ দেবীদাস মঙ্গলকোটের প্রবীণ শ্যামল মুখার্জ্জী বললেন, এতে বিতর্কের কী আছে বুঝতে পারিনা! ওরা তো আমাদের বাড়ির সন্তান। সরকারি কর্মচারিদের একাংশ যখন দুর্গাপুজোর আনন্দে মেতে উঠেছে ওরা তো তখন নিজেদের দায়িত্ব পালন করে গেছে। থানায় কালীপুজোর আয়োজন করে ওরা যদি একটু আনন্দে মেতে ওঠে তাতে ক্ষতি কি? আমাদের উচিত ওদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।