মোল্লা জসিমউদ্দিন,
গত শনিবার রাতে দিল্লিতে ইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন বাঁকুড়ার আইসি অশোক মিশ্র। যিনি কয়লা পাচার মামলায় যোগসূত্রকারী ‘ফেরার’ বিনয় মিশ্রের নিকটাত্মীয়।রাজ্য পুলিশের কোন অফিসার সর্বপ্রথম গ্রেপ্তার হলেন এই কয়লা পাচার মামলায়। তবে ইডির হাতে আগেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বিনয় মিশ্রের ভাই বিকাশ মিশ্র। যিনি প্রথম দফায় ইডির হেফাজতে থেকে বর্তমানে জেল হেফাজতে রয়েছেন। এরেই মধ্যে অবশ্য কয়লা পাচার মামলায় অভিযুক্ত বিনয় মিশ্র কলকাতা হাইকোর্টের দারস্থ হয়েছেন,তার বিরুদ্ধে এফআইআর খারিজের দাবিতে । বিনয় মিশ্রের দাখিল করা এই মামলার শুনানি রয়েছে আগামী সপ্তাহে কলকাতা হাইকোর্টে। তবে সুপ্রিম কোর্ট থেকে আইনী রক্ষাকবচ (৬ এপ্রিল অবধি) পাওয়া কয়লা পাচার মামলায় মূল অভিযুক্ত অনুপ মাঝি ওরফে লালা কে বেশ কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করার পরেই গ্রেপ্তার হলেন রাজ্য পুলিশের ইন্সপেক্টর পদমর্যাদা পূর্ণ অফিসার। যা নিয়ে পুলিশ মহলে চাপানউতোর তৈরি হয়েছে। এরপর ইডির নিশানায় কারা,সে নিয়ে চলছে জোড় চর্চা।কয়লা পাচার মামলায় একাধারে সিবিআই তদন্ত চালাচ্ছে,পাশাপাশি ইডিও এই মামলার আর্থিক দুর্নীতির তদন্তে।সিবিআইয়ের তরফে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জেরাপর্ব চলেছে বেশ কয়েক মাস ধরে।সেখানে কয়লা পাচার মামলায় মূল অভিযুক্ত অনুপ মাঝি ওরফে লালার কোন সন্ধান মিলেনি।তবে সুপ্রিম কোর্ট এই অভিযুক্তের দাখিল করা পিটিশনে আগামী ৬ এপ্রিল অবধি আইনী রক্ষাকবচ দেয়।আর এতেই জনসমুক্ষে এসে সিবিআই অফিসে জেরাপর্বে আসেন লালা।বেশ কয়েক টি জেরাতেই বেশ কিছু সুত্র মেলে বলে দাবি সিবিআইয়ের। কয়লা পাচার মামলায় যোগসূত্রকারী ‘ফেরার’ বিনয় মিশ্রের নিকটাত্মীয় বাঁকুড়ার আইসি অশোক মিশ্রের ভূমিকা নিয়ে বরবরই অসন্তুষ্ট ছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থারা।কয়েক টি অডিও প্রকাশ্যে আসাতেই গত শনিবার রাতে ইডির হাতে গ্রেপ্তার হলেন এই পুলিশ অফিসার। ইতিমধ্যেই, আসানসোলের এক প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার, রানীগঞ্জের প্রাক্তন ওসি,অন্ডালের প্রাক্তন ওসির কয়লা পাচারে ভূমিকা নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই ইডি।ধৃত বাঁকুড়ার আইসি অশোক মিশ্র নিয়ে ইডির অভিযোগ – ‘ কয়লা পাচারে নগদ টাকা তিনি কলকাতায় পুলিশের গাড়িতে পাচার করতেন’ । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ অফিসার জানাচ্ছেন – ‘ দুর্গাপুর থেকে পালসিট উপর দিয়ে ডানকুনি হয়ে কলকাতায় হাওলা টাকার পাচার টা হত বেশি’।ইতিমধ্যেই বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী কয়লা ও গরু পাচার চক্রে ৯০০ কোটি টাকার লুটতরাজের অভিযোগ তুলেছেন। তবে অপরদিকে তৃনমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ প্রশ্ন তুলেছেন অভিযোগকারী সেসময়কার দলীয় পর্যবেক্ষক পদে ওইসব এলাকায় দায়িত্বে ছিলেন বলে।ঘটনা যাইহোক কয়লা পাচার মামলায় বাঁকুড়ার আইসি গ্রেপ্তারে বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসার আতঙ্কে রয়েছেন। একুশে বিধানসভা নির্বাচনে সবথেকে বড় ইস্যু হিসাবে পরিচিতি পাচ্ছে কয়লা ও গরু পাচার মামলা।গরু পাচারের মামলায় মূল অভিযুক্ত এনামুল হক অবশ্য জেল হেফাজতে রয়েছেন। তার উপর সম্প্রতি সিবিআইয়ের কলকাতা শাখা অফিস থেকে লালার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য সহযোগিতা চেয়ে চার জেলার এসপি এবং ডিএম সাহেবদের চিঠি দিয়েছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, উত্তর ২৪ পরগণা এবং পশ্চিম বর্ধমান জেলার পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের অবগত করে ৭০ জায়গায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবার উদ্যোগ নিয়েছে এই মামলার তদন্তকারী কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই। গত ১৮ ই ফেব্রুয়ারিতে আসানসোলের সিবিআই এজলাসে ফেরার কয়লা মাফিয়া লালার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবার নির্দেশ জারি হয়েছিল। ইতিমধ্যেই এই মামলায় আরেক কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি রাজ্যের ১২ টি জায়গায় অভিযান চালিয়েছিলো কেন্দ্রীয় বাহিনী সাথে নিয়ে।কয়লা পাচার মামলায় যোগসূত্রকারী ‘ফেরার’ বিনয় মিশ্রের তথাকথিত আত্মীয় বাঁকুড়ার আইসি মিশ্র বাবু কে দফায় দফায় জেরা করে সিবিআই সন্তুষ্ট নয়।উল্লেখ্য, এই মামলায় দশের বেশি পুলিশ অফিসার সিবিআইয়ের জেরা করার ডাক পেয়েছেন। কেউ কেউ এই ডাক (জেরা) পাওয়ার নোটিশ কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টেরও দারস্থ হয়েছিলেন। তবে কোন নির্দেশ এখনো হাইকোর্ট দেয়নি প্রেরিত নোটিশ এড়িয়ে যাওয়ার।ঘটনা যাই হোক, পশ্চিম বর্ধমান জেলা পুলিশ মহলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পুলিশ অফিসার জানাচ্ছেন – ” গত তিন থেকে চারমাসে পুলিশের বদলী গুলিকে আতশকাঁচে রাখলে অনেককিছুই মিলবে, যা সিবিআই/ইডি আশা করতে পারবেনা “। আবার কেউ কেউ জানাচ্ছেন নাম গোপন রাখার শর্তে – ” বর্ধমান শহরের দুটি আবাসন নগরীতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট গুলি বেনামে কারা রেখেছে তা খতিয়ে দেখুক ইডি”। বিশেষ সুত্রে প্রকাশ, পশ্চিম বর্ধমান জেলায় কয়লা মাফিয়া অনুপ মাঝি ওরফে লালার মূল বাণিজ্যকেন্দ্র এলাকার এক আইসি বদলী করে নেন লালার বসতবাড়ি এলাকায়।যাতে মান্থলী পেমেন্ট চালু থাকে! আবার লালার বেনামে থাকা দুর্গাপুরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এলাকার এক পুলিশ অফিসার প্রমোশন পেয়েও থানা ছাড়ছেন না।তাঁকে অবশ্য থানাতেই পাওয়া যায়না বেশিরভাগ সময়।বিভিন্ন সাহেবের কাছে থাকেন তিনি আবার।পশ্চিম বর্ধমান জেলার কয়লার ‘আতুরঘর’ থানার এক পুলিশ অফিসার বদলীর নির্দেশের পর অতিরিক্ত দুমাস কাটিয়ে দেন। স্থানীয় সুত্রে প্রকাশ, ওই থানায় মাসে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার লেনদেন নাকি চলে।তিনি প্রমোশন পেয়ে পূর্ব বর্ধমান জেলায় পোস্টিং পেয়েও অন্য জেলার গরু পাচারের মূল কেন্দ্র এলাকাতে থানার দায়িত্ব নেন।মাঝখানের পদটি তিনি দায়িত্বভার না নিয়েই চলে যান বর্তমান জায়গায়।এতেই তাঁর হাত কতদূর তার প্রমাণ মেলে।যদিও পুলিশের তরফে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পুলিশ অফিসারদের দাবি – ‘ সিবিআই যদি সংশ্লিষ্ট থানা গুলির ওসি /আইসি পদে থাকা পুলিশ অফিসারদের ট্যাক্স দেখা লোকদের চিহ্নিত করে থাকে । তাহলে তাদের মাধ্যমে কয়লা ও গরু পাচার মামলায় হাওলা সম্পত্তি গুলির সন্ধান পেতে পারে’। আবার কেউ কেউ বলছেন – ‘ বেআইনী নগদ টাকা পুলিশের কেউ কেউ স্থানীয় মহাজনদের কাছে ‘ইনভেস্ট’ করে টাকার রাশি দুর্দান্তগতিতে এগিয়ে নিয়ে যান!’ পশ্চিম বর্ধমান এবং পূর্ব বর্ধমান জেলার গত তিন থেকে চারমাসে পুলিশের বদলী ঘিরে প্রশ্ন দেখা গেছে। রাজ্যের এডিজি ( আইনশৃঙ্খলা) দ্বারা আইসি পোস্টিং এর নির্দেশ জারি যেমন করা হয়েছে, আবার তেমনি তা বাতিল ঘোষণাও করা হয়েছে নোটিশের মাধ্যমে। যেসব থানার আইসি পোস্টিং হয়েছিল একসময়, তার সিংহভাগ থানায় ওসিরাই দায়িত্ব সামলাছেন আবার!তবে ব্যতিক্রমী হিসাবে কেউ কেউ থানায় আইসি দায়িত্বভার নিয়ে নেন জটচলদি। এখন দেখার সিবিআইয়ের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন এইসব বিষয়ে মাথা ঘামায় কিনা? তবে ইডির হাতে রাজ্য পুলিশের ইন্সপেক্টর পদমর্যাদা পূর্ণ অফিসার গ্রেপ্তার হওয়ায় পশ্চিম বর্ধমান এবং বাঁকুড়া জেলায় কয়লা অধ্যুষিত থানার ওসি /আইসিরা চরম আতঙ্কে ভুগছেন বলে পুলিশের একাংশ সুত্র মারফত জানা গেছে।