গল্প : সন্তানকে ঘোড়া বানাই
টুম্পা পাল (হিন্দমোটর,হুগলী)
গোধূলির সন্ধিক্ষণে পার্কে বসে আছি। দেখলাম ওই একই বেঞ্চের অন্য প্রান্তে একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। আরো একজন সবে মাত্রই এসে বসলেন। তিনিও প্রায় একই বয়সের চার সিটের বেঞ্চটিতে মাঝখানে একজন বসতে পারলেও তার আর উপায় নেই কারণ আমরা বেশ ছড়িয়ে বসে আছি। আমার পাশের ভদ্রলোককে দেখে উস্কো খুসকো ও চিন্তিত লাগছে। দুজনের কথা শুনে মনে হলো দুজন পুরনো বন্ধু।
কোণের লোকটিকে বলতে শুনলাম, “বৌদি গত হয়েছে শুনলাম। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা নেই আর এটাই চরম সত্য কাউকে আগে কাউকে পরে যেতে হবে। তখন আমি বাইরে ছিলাম , তাই দেখা করতে যেতে পারিনি। কিছুদিন হল ফিরলাম। কিন্তু তোর শরীর কেমন আছে? দেখে তো খুব একটা ভালো লাগছে না।
ভদ্রলোকের স্ত্রী মারা গেছে শুনতেই আমি কানটা একটু খাড়া করে দিলাম। বেশ মনোযোগ দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে কথাগুলি শুনতে থাকলাম। আমার আবার অন্য দিকে তাকালে মন সংযোগ নষ্ট হয়ে যায়। তবু শোনার চেষ্টা করলাম।
পাশের ভদ্রলোক উত্তর দিলেন শরীর তেমন একটা ভালো নেই। আর একা মানুষ বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে কোনরকমে প্রাণ বাঁচাচ্ছি। এবার মনে হচ্ছে প্রাণটা বেরিয়ে গেলেই ভালো।
-এসব কি বলিস? এসব কি আমাদের হাতে? উপরওয়ালার যখন ইচ্ছে হবে তখন ঠিক ডেকেই নেবেন। তোর ছেলে তো বিদেশে থাকে তাই না।
- হ্যাঁ
- তুই এখানে একা আছিস। তা ওর কাছে তো চলে যেতে পারিস?
- ওদের ঘরের খুব অসুবিধা। দুটি ঘর একটিতে ছেলে থাকে আর অন্যটিতে ওরা স্বামী স্ত্রী। আমি কোথায় থাকবো বল? তাই….
- বন্ধুটি একটা ব্যঙ্গের হাসি দিয়ে বললো, আর তোর এখানে তিনতলা এত বড় বাড়ি, অথচ লোক নেই। হায়রে নিয়তির পরিহাস। ভেবেছিলাম বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে শেষ সময়টুকু ছেলের কাছেই গিয়ে থাকবো। কিন্তু ছেলে রাজি হল না। বলল, ওরা দুজনে চাকরিজীবী, দুজনই সারাদিন বাইরে থাকে। ছেলেটাকে আয়া রেখে মানুষ করছে। তার ওপর আর আমার ঝামেলা নিতে পারবে না।
তাই একটা মেয়েকে রেখেছি বাসন ধুইয়ে, ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। আর হোম ডেলিভারির খাবার খেয়ে কোনরকম দিন কাটাই। এভাবেই চলছে।- এত বড় বাড়ি। ভাড়া দিয়ে দে। বাড়িতে লোক থাকলে সময় অসময়ে তোকে দেখতে পারবে।
- আমরা ভালোই আছি। আগে পরে কেউ নেই। আমরা ঠিক করেছি একজন চলে গেলে যে পড়ে থাকবে বাড়িঘর বিক্রি করে টাকা পয়সা নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে আমি চলে যাবো।
- সেটাই বেশ ভালো। তারও তো উপায় নেই আমার। তা করলে তো ছেলের সম্মানহানি হবে। আরেকটু হতাশা সুরে বলল শেষের দিকে চিত্রপটটা কেমন পাল্টে যায় তাই না? তোর সন্তান নেই তুইও যেমন আছিস। আমার সন্তান থেকেও আমিও তেমনই। অথচ দেখ কত যত্নেই ছেলে মানুষ করেছি। যখন যা চেয়েছে তাই দিয়েছি। ছেলের জন্য ভি আর এস পর্যন্ত নিয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠালাম।
- জানিস অশোক দোষটা আসলে আমাদেরই। আমরা সন্তানকে ঘোড়া বানাই। চোখে ঠুলি লাগাই। অনেক দূর ছুটতে শেখায়। তাই সে অনেক ছুটতে পারে, কিন্তু জীবনটাকে বাঁচতে পারে না। সে সোজা লম্বা রাস্তা দেখতে পায় আর সেই রাস্তা ধরেই হাঁটতে থাকে, ছুটতে থাকে, তাঁর আশেপাশে কে আছে, পেছনে কে আছে সে আর দেখতেই পায় না। তাঁর লেজের ঝটকায়, তাঁর লাথির ঘায়ে কে আহত হচ্ছে, কে পড়ে যাচ্ছে সে সেটাও দেখতে পায় না। আর আমরা বাবা মারাই তো তাদের পেছনে পড়ে থাকি শেষ পর্যন্ত আর অনেক কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করি, সেই কারণেই আমরাই লাথিটা তাদের বেশি খাই।
- হয়তো তুই ঠিকই বলেছিস সজল। অশোকের দীর্ঘশ্বাসে অজস্র ব্যর্থতা ঝরে পড়ল। দুই বন্ধুর কথাবার্তায় বিকেলটা ভারী হয়ে ওঠে।