জঙ্গলে যত কান্ড
দীপান্বিতা পাত্র (কলকাতা)
আকাশ ভীষন ভ্রমণ পিপাসু। বরাবরই জঙ্গল ওকে টানে। এবার পুজোয় ও ঠিক করল বীরমুন্ডা গ্ৰামের জঙ্গলে বেড়াতে যাবে তবে এবার আর একা নয় সঙ্গে নেবে নীল আর কুশকে। যথারীতি ষষ্ঠীর দিন ওরা ট্রেন এ চড়ে গন্তব্যে রওনা দিল। এই প্রথমবার পুজোয় কলকাতার বাইরে যাচ্ছে ওরা তিনজনেই। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে তিনজনে ট্রেনে চেপে বসল। ঘন্টা পাঁচেক এর রাস্তা।
-‘মায়ের বোধন আজ’। আকাশ , নীল আর কুশকে বলল।
-‘ হ্যাঁ রে বাড়ি ছেড়ে যেতে মনটা সায় দিচ্ছিল না, কিন্তু জঙ্গল এ যাবার লোভ সামলাতে পারলাম না।’ নীল বলে উঠলো।
তিনজনেই গল্প ঠাট্টা করতে করতে কখন যে ওদের গন্তব্যের স্টেশন এসে গেছে বুঝতেই পারলো না।
স্টেশনে যখন ওরা নামলো তখন প্রায় বিকেল। গ্ৰামটি একেবারেই প্রত্যন্ত দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। ওরা তিনজনেই একটা ভ্যান থামিয়ে তাতে চড়ে বসল। আর চালককে আকাশ বলল, ‘ভাই এখানে দু দিন থাকতে চাই একটা ঘর দেখে দাও।’
ভ্যান চালক উত্তর এ বলে ‘ ঠিক আছে নিবারণ কাকার কাছে নিয়ে যাচ্ছি ওনার ঘর খালি আছে, তবে বাবু ওটা জঙ্গলের কাছে।’
নীল আর কুশ তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে ‘দারুণ ব্যাপার’। আর আকাশ তো খুব খুশি।
নিবারণ কাকার সাথে ওদের দেখা করিয়ে দিয়ে ভ্যান চালক ফিরে গেল। নিবারণ কাকা ওদের সাথে পরিচয় পর্ব সেরে ওনার একটা মাটির ঘরে ওদের থাকতে দেন। তবে নিবারণ কাকা প্রথমেই ওদের নিষেধ করে দেন জঙ্গলে না যেতে। ওরা তিনজনে সাথে সাথেই নিবারণ কাকাকে বলে যে ওরা এখানে জঙ্গল দেখতেই এসেছে।
-‘এ কী কাণ্ড! আপনারা ফিরে যান।’ নিবারণ কাকা বেশ বিরক্ত হয়ে বলেন ওদেরকে।
-‘ এ ভাবে ফিরিয়ে দেবেন না আমাদের।’ আকাশ অনুরোধ করে।
-‘ঠিক আছে পরশু অষ্টমীতে এই বীরমুন্ডা গ্ৰামে বিরাট করে বনদেবীর পুজো হয় । ওই দিনই না হয় … তবে সাবধান জঙ্গলে তেনারা থাকেন।’
নিবারণ কাকা কথা শেষ করার আগেই আকাশ শুধোয় ‘তেনারা কারা ! ‘
পাশ থেকে নীল আর কুশ মুচকি হাসে। নিবারণ কাকা কোন উত্তর দেন না।
সপ্তমী পার হয়ে অষ্টমী। রাত আটটা নাগাদ নিবারণ কাকা ওদের নিতে আসে জঙ্গলে যাবার জন্যে। নিবারণ কাকা ওদের আগেই বলে দেন ওখানে গিয়ে যেন কেউ পুজোর সময় মাটি ছেড়ে না ওঠে, মাটিতেই যেন বসে থাকে পুজো শেষ না হওয়া অবধি । এটাই নিয়ম,তা না হলেই হবে ঘোর অমঙ্গল। কিন্তু আকাশ , নীল আর কুশ কথাটায় পাত্তাই দেয় না।
ওরা জঙ্গলে পোঁছে দেখলো , বেশ গা ছমছমে পরিবেশ , বনদেবীর পুজোর স্থান এর সামনে সবাই জড়ো হয়ে বসে।তখনো পুজো শুরু হয়নি। ওরাও গিয়ে বসল একদম শেষে যাতে উঠলেও কেউ ঠাওর করতে না পারে। চারপাশে মশাল এর আলো জ্বলছে। পুজো শুরু হবার ঠিক আগে নিয়মানুযায়ী তান্ত্রিক সবাইকে কপালে সিঁদুর এর রক্ষা তিলক এঁকে দিচ্ছিলেন। আকাশ একমাত্র তিলক লাগায়। কুশ আর নীল কুসংস্কার বলে তিলক না লাগিয়ে তান্ত্রিক এর থেকে কিছুটা দূরে সরে যায়। মিনিট পাঁচেক পর কুশ সবার অলক্ষ্যে পুজোর জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে আসে । ওরা তিনজন এই যুক্তিই করেছিল যে ওরা জঙ্গল এর ভেতরে যাবে তেনাদের দেখতে, সেই মত বড় টর্চও নিয়ে আসে ওরা ব্যাগে ভরে।
কুশ একা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে নীল ও আকাশ এর জন্যে। হঠাৎ দুটো লোমশ হাত ওর গলা চেপে ধরলো। ও কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না।
খানিক বাদে নীল আর আকাশ এসে কুশকে দেখতে না পেয়ে খানিকটা চমকে ওঠে। ওরা জঙ্গলের ভিতরে প্রবেশ করে আর কুশ এর নাম ধরে চিৎকার করে । এমন সময় দু জনের শরীরেই যেন ঠান্ডা শীতল স্রোত বয়ে যায়। মনে হচ্ছে ওদের চারপাশে কেউ আছে। আকাশ চোখ ফিরিয়ে দেখে পাশে নীল নেই। ও চারপাশে টর্চ এর আলো ফেললো কেউ কোথাও নেই। আকাশ প্রাণপনে দৌড়াতে চেষ্টা করছে কিন্তু ওর শরীর অবশ লাগছে। জঙ্গলের মধ্যে থেকে চিৎকার করে কেউ যেন বলছে
‘ তোরা এখানে কেন এলি! আমাদের জাগিয়ে বিরক্ত করতে ‘ ! তারপর আকাশ এর আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরতে আকাশ দেখে ও নিবারণ কাকার বাড়ির দাওয়াতে শুয়ে। চারপাশে প্রচুর মানুষ জমে গেছে।
-‘বারণ করেছিলাম। শুনলেন না আপনারা…’নিবারণ কাকা আক্ষেপ এর সাথে বলে।
-‘ নীল আর কুশ কই?’ আকাশ নিবারণ কাকাকে শুধোয়।
নিবারণ কাকা আঙুল দেখিয়ে বলে ওরা আর নেই।
আকাশ কোনমতে জোর করে শরীরটা তুলে দাঁড়ায়, দূরে নীল আর কুশ এর মৃতদেহ দেখতে পায়।
আকাশ এর মাথায় বাজ পড়ার অবস্থা, নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
নিবারণ কাকা ওর পিঠে হাত রেখে বলে,
‘ তোমরা তেনাদের জাগিয়েছো! দু জনকে ওরা শেষ করতে পারলেও তোমার কপালে বনদেবীর তিলক ছিল তাই তুমি এ যাত্রায় রক্ষা পেলে, ওরা যদি তিলকটা পরে থাকতো।’
থানা পুলিশ সব হল। দুই বন্ধুর ডেড বডি সঙ্গে করে দশমীর দিন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আকাশ কলকাতায় পা রাখলো।
এই ঘটনার মাস পাঁচেক পরে আকাশ আচমকাই অসুস্থ হয় এবং ওর ও মৃত্যু ঘটে।
বীরমুন্ডা গ্ৰামের জঙ্গল পরিপূর্ণ, কারণ আজ তেনাদের সাথে যোগ দিয়েছে আকাশ, নীল ও কুশ।