জীবযুদ্ধে এক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন যুবকের লড়াইয়ের কাহিনী
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী, মঙ্গলকোট, পূর্ব বর্ধমান
গরীব আদিবাসী পরিবার। ঘরেতে অভাব লেগেই আছে। দিনমজুরী করে বহুকষ্টে কোনোরকমে সংসার চলে। এদিকে সন্তান জন্ম বিকলাঙ্গ। দু'পা অচল। লাঠির সাহায্যে হাঁটতে হয়। এই সন্তানকে নিয়ে খুব চিন্তিত বাবা-মা, স্বাভাবিক। যতই হোক সন্তান তো। তাদের অবর্তমানে কিভাবে দিন চলবে তার! কেইবা তার মুখে দু'মুঠো অন্ন তুলে দেবে! এইসব ভেবে ভেবে কার্যত দিশাহারা বাবা-মা। ভাবতে ভাবতে তাদের দিন কেটে যায়। ছেলের দিকে সেভাবে নজর দেওয়ার সময় ছিলনা। তাই হয়তো ছেলের সুপ্ত প্রতিভা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা গড়ে ওঠেনি।
হাজার হাজার দর্শক অবাক হয়ে দেখে শারীরিক দিক দিয়ে অক্ষম একটি ছেলে নিজেদের আদিবাসী সম্প্রদায়ের উৎসবে সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রবল উৎসাহে মাদল বাজাচ্ছে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে। অর্কেস্ট্রা দলের সঙ্গে মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে। এর বিনিময়ে সামান্য পরিমাণ হলেও তার কিছু আয় হচ্ছে এবং পরবর্তীকালে এটাই হয়ে ওঠে তার আয়ের একমাত্র উৎস। আর জোটে সামান্য সরকারি ভাতা।
জন্ম বিকলাঙ্গ এই ছেলেটি হলো লক্ষীরাম হেমরম। মঙ্গলকোট থানার চাণক অঞ্চলের কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা।
নামের সঙ্গে 'লক্ষী' শব্দ বন্ধনী যুক্ত থাকলেও লক্ষী অর্থাৎ ধনসম্পদ তার দরজায় এসে হাজির হয়নি। তবে 'রাম'-এর মত ধৈর্য্য ও বিপদেও নিজেকে হতাশার সাগরে সে ভাসিয়ে দেয়নি।
ইতিমধ্যে তার বিবাহ হয়। স্ত্রী সোনামণির কোল আলো করে একমাত্র সন্তান রঞ্জিত জন্ম নেয়। সংসারের হাল ধরে স্ত্রী। ছেলেকে 'মানুষ' করার জন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি করে।
কথায় আছে 'অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়।' সব কিছু ঠিকঠাক চললেও হঠাৎ লক্ষীর জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। স্ত্রী সোনামণি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। ওদিকে আর্থিক কারণে অষ্টম শ্রেণিতেই একমাত্র সন্তান রঞ্জিতের পড়াশোনার ছেদ পড়ে যায়।এই দুর্মূল্যের বাজারে কার্যত সংসার টানতে হিমশিম খেয়ে যায় লক্ষী।
ঠিক সেইসময় লক্ষীর সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ ঘটে মঙ্গলকোট থানার তৎকালীন আইসি পিণ্টু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। লক্ষীর ভাষায় 'উনি মানুষ নন, আমার জীবনে দেবতা হয়ে দেখা দেন।' লক্ষীর সমস্যার কথা শুনে পিণ্টুবাবু ওর জন্য একটি টোটোর ব্যবস্থা করে দেন। এই টোটোই হয়ে উঠেছে লক্ষীর আয়ের উৎস। শুধু তাই নয় লক্ষীর অসুস্থ স্ত্রীর জন্যেও আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এমনকি মঙ্গলকোট থানা থেকে বদলি হয়ে গেলেও এখনো সুযোগ পেলে তিনি লক্ষী ও তার পরিবারের খবর নেন।
আরও একজন লক্ষীর পাশে এসে দাঁড়ান। তিনি হলেন মঙ্গলকোটের বিধায়ক অপূর্ব চৌধুরী। নিজের সাধ্যমতো যতটা সম্ভব তিনি লক্ষীর পাশে থাকার চেষ্টা করেন। লক্ষীর ভাষায় – একজন যদি দেবতা হন, অপরজন হলেন দেবদূত। এদের দু’জনের জন্যেই আজ আমি পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে পারছি।
লক্ষী ভুলতে পারেনা তার অর্কেস্ট্রা দলের সদস্যদের অবদানের কথা। কখনো তারা তাকে অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দেয়নি। জীবনযুদ্ধে তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দলে সুযোগ দিয়েছে। উৎসাহ দিয়েছে।
'লক্ষী আমার এলাকার ছেলে। বিধায়ক হিসাবে নয়, একজন মানুষ হিসাবে তার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। সেটাই যদি না পারি তাহলে মানুষ হিসাবে জন্মটাই বৃথা'- এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া দিলেন অপূর্ব চৌধুরী।
অন্যদিকে পিণ্টুবাবু বললেন - একজন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে আমি আলাদা কোনো তাৎপর্য খুঁজে পাইনা। পেশার বাইরে আমার একটা নিজস্ব পরিচয় আছে, সেটা হলো আমি এই সমাজেরই একটা অংশ। সমাজের প্রতি আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে।
দুই ‘দেবতা’ উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে লক্ষীর বক্তব্য – এরা যদি আমার পাশে না দাঁড়াতেন তাহলে এই লক্ষী আজ হয়তো হারিয়ে যেত। ওদের জন্যেই আমার যেমন দু’মুঠো খাবার জুটছে তেমনি সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে পেরেছি। ঈশ্বর ওদের দীর্ঘজীবি করুন এবং আমার মত ‘লক্ষী’-রা যেন ওদের পাশে পায়।