ডাক হরকরা বর্ষা

Spread the love

ডাক হরকরা বর্ষা

শম্পা মহান্তি নাথ।

  কলেজ ছেড়ে আসার পর আর কোনোদিনও সাহিত্যের বই খোলা হয়নি সুব্রতর। সাহিত্য তার আসে না। কল্পনার জগতে তার দৌড় ওই প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত। সুব্রতর ছেলে এই ফ্রেব্রুয়ারীতে ১০ এ পা দেবে। তার স্কুল থেকে বর্ষা নিয়ে স্বরচিত একটি  কবিতা লিখতে বলেছে। যথারীতি সুব্রতর ছেলে সুপ্রিয় বাবাকে পাকড়ে ধরেছে। বাবা বাবা আমাকে বর্ষা নিয়ে একটা কবিতা লিখে দাও। ছেলেকে খুশি করার জন্যে খাতা কলম নিয়ে সুব্রত  বসেছিল ঠিকই, কিন্তু ওই পর্যন্তই। একটা লাইনও মাথা থেকে বেরোচ্ছে না। মনে পড়ে গেলো ছোটবেলার কথা।

তখন সুব্রত ১৯ আর সুপ্রীতিও ১৯, দুজনেই আনন্দময়ী বিদ্যাধর কলেজে পড়ে। কলেজ থেকে বন্ধুত্ব তারপরে প্রেমালাপ। কিন্তু একটি প্রেমপত্রও সুব্রত নিজে লেখেনি। সুপ্রীতি কিন্তু এদিক থেকে বেশ গোছালো। শব্দের বাঁধন আর শব্দ চয়ন এত সুন্দর। তার প্রতিটি প্রেমপত্র ছিলো যেন বাঁধানো ছবি। সেগুলি পড়লে মনে হতো, কোনো নিপুন শিল্পী যেন তার মনের ক্যানভাসে রামধনুর রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। সুপ্রীতি কিন্তু খুব নরম মনের। তার কবিতার খাতায় ঘুরে ফিরে বেড়াত সুব্রতর নাম। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শঙ্খ ঘোষ, গাং চিল, শরতের আকাশ, নীল প্রজাপতি আর নদীর ঝরনা।

 সুব্রত আজ একজন শেয়ার ব্রোকার। শেয়ারের ওঠা নামা থার্মোমিটারের পারদের উত্থান পতনের মতো কম্পিউটারের নীল সাদা পর্দায় আন্দোলন তার দৈনন্দিন জীবনের কর্ম। কারোর ভাগ্য গড়ে আবার কারোর লাখ টাকা চলে যাওয়ার দৈনন্দিনের সুব্রত একজন সাক্ষী মাত্র।

ছেলে ভালো স্কুলে পড়ে। মাসে ১০,০০০ টাকা শুধু ছেলের পড়াশোনাতেই খরচ হয়। ছেলেটাও কিন্তু মায়ের মতই হয়েছে। বাবা ছাড়া কিছুই জানে না। ঘুম থেকে ওঠার পর বাবা ডাক দিয়ে শুরু হয় তার সকাল। তার রাত্রে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরা। এইভাবে বাবা ছেলের দিব্যি কেটে যায়।

ও বলা হয়নি সুপ্রীতির কি হলো। আসলে সুপ্রীতি দু বছর আগেই করোনাতে চলে গেছে। অনেক চেষ্টা করেছিল সুব্রত লাভ হয়নি। মর্গ থেকে সুপ্রীততিকে বের করে শুধু মুখটা দেখিয়েছিল তারা। প্লাস্টিকে মোড়া ছিল সুপ্রীতির নিথর শরীরটা। ওই শেষ ……
তখন মনে পড়েছিল সুপ্রীতির লেখা একটা কবিতা। কি যেন লাইনটা ছিল। আজ কিছুতেই সেই কবিতাটা মনে পড়ছে না সুব্রতর। সবকিছু যেন ভুলে যাচ্ছে সে। কোন গভীর অন্ধকার যেন তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। সাহিত্য তার আসে না। কিন্তু চোখের সামনে মাকড়শার জালে আটকে যাওয়া পোকাটা যেভাবে ছটফট করছে। তিল তিল করে যেভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে…….
না উঠে পড়ল সুব্রত। বাক্সটা খুলে একটা পুরানো লাল মলাটের খাতা বের করল। তার শেষ পাতায় লেখা …. সুব্রত এটা আমার শেষ কবিতা। চললাম ভালো থেকো।

ফিরে আসবো সেই দিন
যে দিন আবার বাজবে বীণা।
রুদ্ধ দারে বদ্ধ ঘরে
স্বপ্ন গুলো নিদ্রীত হয়ে থাকবে না।
এ নয় সমাপ্তির গান
আজ প্রণয়ের যাত্রা শুরু।
পাশে থেকে ভালোবেসে ছিলে এতোদিন
পূর্বরাগের যাত্রা আজ থেকে হোক শুরু।
দুজনের নাম লিখে একদিন
কাগজের নৌকায় ভাসিয়ে ছিলে ভেলা।
দিনটা ছিলো ঘনঘোর বর্ষার
আর ছিলো প্রকৃতি পুরুষের খেলা।
কোথায় গেলে পাবে আমাকে
এটাই বড় প্রশ্ন? তবে শোনো,
আকাশ থেকে আসবো আমি নেমে
যেদিন ভিজবে আবার মাটি।
বর্ষার রথে করে ফিরবো আমি
রোখো ভরসা।
যেনো ওপার এপারের,
ডাক হরকরা হলো বর্ষা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *