তিস্তার অববাহিকায় (প্রথম অংশ)

Spread the love

তিস্তার অববাহিকায় (প্রথম অংশ)

শোভনা মিশ্র (পুণে, মহারাষ্ট্র)

 এমনি করেই বোধহয় বেরিয়ে পড়া ভালো। খুব বেশি চিন্তাভাবনা আর পরিকল্পনা করে বেড়াতে যেতে অর্ণব কোনদিনই পছন্দ করে না। হাতে দু'দিন মাত্র সময় আছে, তাতে কি , ট্রেনের টিকিটটা পেলেই হলো । তিতানের পাহাড় দেখার খুব শখ, তিতান হলো গিয়ে অর্ণব আর অনিতার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে।  

   আট বছর হলো অর্ণব মুম্বাইতে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। অনিতা স্কুলে পড়ায়। তাই তিতান একটু বড় হওয়ার পর থেকেই ওরা জুন আর ডিসেম্বরের ছুটিতে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু ওই দু'দিন আগেই ঠিক করে কোথায় বেড়াতে যাবে। এবারে তিতান তার আধো আধো গলায় বললো,  "বাবাই এবার পাহাড়ে যাবো , জঙ্গলে যাবো, হাতি দেখবো, হরিণ দেখবো"। 

ওরা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই জুহু বিচ না হয় মেরিন ড্রাইভ ঘুরে আসে। পাহাড়ের কথা উঠতেই  অনিতা চিৎকার করে উঠল দার্জিলিং। কথাটা শুনেই যেন অর্ণব আঁতকে উঠল, মুখ শুকিয়ে গেল, চোখের সামনে যেন অসংখ্য ছবি, মনের ভিতরটা কুঁকড়ে কাঁদতে শুরু করেছে। 

  কোনোভাবে সামলে নিয়ে বললো, "উটি গেলে কেমন হয়? পাহাড় আছে, চা বাগান আছে। মধুমালাই জঙ্গলে বাস থেকেই বনজ প্রাণী যেমন হাতি, হরিণ সব দেখা যায়। তাছাড়া জঙ্গল সাফারিতে যাওয়া যায়। তিতানের খুব ভালো লাগবে"।

   অনিতা অগত্যা রাজি হলো। কিন্তু মনে একটা খটকা থেকেই গেল অর্ণবের আচরণে। এখনো স্বাভাবিক হতে পারছে না কেন!

 কেবল উটি কেন মহীশূরের রাজবাড়ী ও কুর্গ ঘুরে আসারও অনিতা ইচ্ছা প্রকাশ করলো। সব মিলিয়ে আট দশ দিনের একটা ভ্রমণ হবে মোটামুটি। ব্যাগ সব গুছিয়ে নিল। কিছু শীত বস্ত্র, ওষুধপত্র, তিতানের জন্য কিছু খেলনা,  জামাকাপড় আর কিছু শুকনো খাবার।

 যাত্রা শুরু। অনেক অজানা জিনিস জানতে তিতানের মন অস্থির। অদেখা জিনিস দেখতে দেখতে ছোট্ট তিতানের দুই চোখ জ্বলজ্বল করছে। আর প্রতিনিয়ত একটার পর একটা প্রশ্ন বাবা-মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে।

  ট্রেন সঠিক সময়েই ব্যাঙ্গালোরে পৌঁছালো।

তারপর ওখান থেকে ভোলভো বাসে চেপে বিকেলের মধ্যে মহিশূরের হোটেলে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বৃন্দাবন গার্ডেনের দিকে রওনা দিল। ওখানের মনোরম দৃশ্য এবং লাইট এন্ড সাউন্ড শো সবাইকে বেশ আনন্দ দিল। পরেরদিন চামুন্ডেশ্বরী মন্দিরে সকাল সকাল পুজো দিয়ে টিপু সুলতানের সমাধিস্থল হয়ে ফোর্ট দেখে রাজবাড়ীতে এলাম। রাজবাড়ির শিল্পকলা, চিত্রকলা সবাইকে এতটাই অভিভূত করেছে যে ছোট্ট তিতানও এতটা হেঁটে ঘুরতে কষ্ট বোধ করেনি। দু’দিন বেশ আনন্দেই কাটলো।

 এবার তারা ভারতের স্কটল্যান্ড 'কুর্গ' এর পথে রওনা হল। কর্ণাটকের বাস সার্ভিস বেশ ভালো। শহরগুলোকে বাস যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক কাছের করে দিয়েছে। বেগবতী কাবেরী নদীর স্নিগ্ধ শীতল জল দেখে অর্ণবের আর এক নদীর কথা খুব মনে পড়ে গেল। সে নদী যে তার খুব কাছের ছিল কিন্তু এত শান্ত ছিল না। তার অস্থিরতার জন্যই সে খুব কম দিনে কাছের হয়ে গিয়েছিল। একাগ্রচিত্তে অর্ণব যখন পরিষ্কার জলের দিকে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন তার হারিয়ে যাওয়া অতীতকে সে জলের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোলকাতায় থাকাকালীন অর্ণব গঙ্গার ধারে অনেকবার বসেছে কিন্তু কোনদিনই অনিতা অর্ণবের চোখ মুখের এই রকম ভাব লক্ষ্য করেনি। 

 অনেকদিন আগের সে কথা। অশোক মিত্র হলেন গিয়ে অর্ণবের বাবা, দার্জিলিংয়ে এক চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন। কোলকাতাতে আদি বাড়ি তাদের। পড়াশোনাও তার কোলকাতাতেই। কিন্তু পাহাড়ের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ থাকায় ওখানেই প্রথম থেকে চাকরি করতে শুরু করেন।

অর্ণবের জন্ম থেকে স্কুলের পড়াশোনা সব দার্জিলিংয়েই। বেশ বুদ্ধিমান ছাত্র ছিল অর্ণব। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর নিয়ে পাস করলো। স্বভাবতই পশ্চিমবাংলার জয়েন্টে ভালো স্থান লাভ করে জলপাইগুড়ি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করলো।

   দীপা, অর্ণবের মা, যেমন লম্বা ছিলেন তেমনি সুশ্রী। ফর্সা রঙের অধিকারিনী ছিলেন। এককথায় ডাকসাইটে সুন্দরী। অর্ণব মায়ের সব গুনগুলোই পেয়েছে। মায়ের মতোই সে মিষ্টি গলায় গানও গাইতে পারতো।

 কলেজে ঢোকার পর থেকেই অর্ণবের পিছনে লাগার লোকের অভাব ছিল না। কেন লাগবে না - চেহারা, বুদ্ধি, খেলা, গান সবকিছুতেই যেন সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোন মেয়েকেই ওর সেভাবে মনে ধরে নি। কেননা চঞ্চল চপলা বন্য নদী তিস্তার মতোই কেউ তাকে তখন মোহিনী রূপ নিয়ে ডাকছে।

    কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। সবার শেষ হতে না হতেই সব বন্ধুরা মিলে ঠিক করলো দু-চারটে  দিন তারা তিস্তা নদীর অববাহিকা ধরে বেশ কিছু জায়গা ঘুরে দেখবে।জলপাইগুড়ি থেকে কালিম্পং, দার্জিলিং হয়ে গ্যাংটক যাবে- এই ভাবনা নিয়ে সব বেরিয়ে পড়লো। অর্ণবের মোটামুটি সব জায়গাই ঘোরা।  দার্জিলিংয়ে থাকার জন্য বন্ধুরা আসানসোল ও বর্ধমান থেকে এসেছে তাই ওদের উদ্দীপনার শেষ নেই।

 কালিম্পঙে তিস্তা ও রঙ্গিতের মিলনস্থলে বসে সবাই যখন অর্ণবকে গান গাইতে অনুরোধ করলো তখন নিরুপায় হয়ে গাইতে শুরু করলো। গান শেষের মুখে তখন দূর থেকে কোন মেয়ের সুরেলা কন্ঠের গান ভেসে আসছে। অর্ণব তাড়াতাড়ি গান থামিয়ে অধীর আগ্রহে গানটি শোনার চেষ্টা করছে। কে ওই মেয়ে, এত মধুর আওয়াজ! একদিকে প্রকৃতির অপরূপ শোভা আর অন্য দিক থেকে কি মিষ্টি আওয়াজ। অর্ণব পাগল হতে চলেছে , পা পিছলে নদীতে পড়ে না যায় । 

   বন্ধুদের ডাকে অর্ণব স্তম্ভিত ফিরে পেল। বলে উঠল- "না না চল কিছু হয় নি, এবার আমরা দার্জিলিংয়ের দিকে রওনা হবো "।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *