দক্ষিণ আফ্রিকাকে পরাজিত করে বিশ্বকাপ জয়ী
‘উইমেন ইন ব্লু’ ব্রিগেড
সৌরভ দত্ত, মুম্বাই:২০০৫ সালের ফাইনালে হয়নি, ২০১৭ সালে হয়নি। কিন্তু সব ‘হয়নি’র শেষ আছে। তার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। হার না মানা মানসিকতা দরকার। একদিনে হয়নি, তবে একদিন ঠিক হল। নবি মুম্বইয়ে ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাল ভারত। ৫২ রানে জিতে বিশ্বজয় হরমনপ্রীত কৌরদের। এই প্রথমবার বিশ্বকাপ জিতল ‘উইমেন ইন ব্লু’।
মুম্বইকে বলা হয় মায়ানগরী। কত স্বপ্ন এখানে সফল হয়। এই মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ২০১১ সালে ২ এপ্রিল ওয়ানডে বিশ্বকাপ হাতে তুলেছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত। আবার ২০২৩ সালে এরকমই একটা নভেম্বর মাসে স্বপ্ন ভেঙেছিল রোহিত শর্মাদের। আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের সেই হার আজও দেশবাসীদের হৃদয়ে কাঁটার মতো বিঁধে আছে। কিন্তু প্রতিটি ১৯ নভেম্বরের বদলা একটা দোসরা থাকে। সেটা ২ এপ্রিল হতে পারে বা ২ নভেম্বর।
গোটা দেশের রং আজ একটাই- নীল। নবি মুম্বইয়ের ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে যে বৃষ্টিটা হল, তা যেন ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। সেটাই নীল রংয়ে ধুয়ে দিল ভারতকে। কারণ, বিশ্বজয়ের লড়াইয়ে নেমেছিলেন ভারতের মেয়েরা।
হরমনপ্রীতদের লড়াই দেখতে মাঠ ভরিয়েছিলেন দর্শকরা। তবে তাঁরা যা করলেন, তাতে ম্যাচ শুরুর আগেই চোখে জল আসে স্মৃতি-জেমাইমাদের। হরমনদের সঙ্গে গোটা স্টেডিয়াম একসঙ্গে গাইলেন দেশের জাতীয় সঙ্গীত। এহেন দৃশ্য অনুভব করে আবেগে ভাসেন ক্রিকেটাররা।
রবিবাসরীয় বিকেলে মুম্বইয়ের স্টেডিয়ামে রীতিমতো চাঁদের হাট। শচীন তেণ্ডুলকর থেকে ঝুলন গোস্বামী, কে নেই। শুরুতেই বিশ্বকাপের সমাপ্তি অনুষ্ঠান জমিয়ে দেন সুনিধি চৌহান। গত ৩০ সেপ্টেম্বর অসমের বর্ষাপাড়া স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একেবারে বাঙালি কন্যার সাজে সেজেছিলেন শ্রেয়া। এবার নীল লেহেঙ্গায় ধরা দিলেন সুনিধি।
মহিলাদের চূড়ান্ত লড়াই শুরুর আগে মাঠে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে প্রবেশ করেন মাস্টার ব্লাস্টার। সাদা শার্ট কালো ব্লেজারে শচীনকে আরও একবার মাঠে দেখে মুগ্ধ সমর্থকরা। সুনিধির সঙ্গেও কথা বলতে দেখা যায় তাঁকে।
ঘরের মাঠে স্ত্রী ঋতিকাকে নিয়ে খেলা দেখতে পৌঁছে গিয়েছিলেন ভারতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক রোহিত শর্মাও। শেফালি-দীপ্তিদের ব্যাটিং তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলেন তাঁরা।
ভিআইপি বক্সে শচীন তেণ্ডুলকরের সঙ্গে বসে ম্যাচ দেখলেন আইসিসি প্রেসিডেন্ট জয় শাহ, মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের মালকিন নীতা আম্বানিরা। দু’বার ফাইনালে পৌঁছেও ট্রফি হাতছাড়া হয়েছিল ভারতের। এবার জয়ের আশায় বুক বেঁধেছিলেন প্রত্যেকেই।
সঞ্চালনা ও ধারাভাষ্যের মাঝে ফুরফুরে মেজাজে ধরা দিলেন সঞ্জনা গণেশন, ঝুলন গোস্বামীরা। সবমিলিয়ে হরমনপ্রীতদের ফাইনাল ঘিরে জমজমাট ডিওয়াই পাটিল।
হরমনপ্রীত কৌর, স্মৃতি মন্ধানা, রিচা ঘোষদের জন্য দেশের প্রতিটা কোনায় গর্জন। অধরা স্বপ্নপূরণ করার লক্ষ্য ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করে ৭ উইকেট হারিয়ে ভারত করল ২৯৮ রান। দক্ষিণ আফ্রিকাকে আটকে দিল ‘উইমেন ইন ব্লু’।
টসের সময় যখন ভারত অধিনায়ক এগিয়ে এলেন তখন স্টেডিয়ামে প্রবল জনগর্জন। বছর দুয়েক আগে এই নভেম্বরে, আহমেদাবাদে রোহিত শর্মাদের জন্য এরকমই জনসমর্থন ছিল। স্টেডিয়াম ছিল ভিন্ন, কিন্তু আবেগ ছিল এক। সেমিফাইনালে অবিশ্বাস্য জয়ের পর তো স্বপ্ন দেখা আরও বেড়েছে। ফাইনালে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করতে যায় ভারত। বৃষ্টিভেজা মুম্বইয়ে ধীর লয়ে ইনিংস শুরু করেছিলেন স্মৃতি মন্ধানা ও শেফালি বর্মারা। তবে নিয়মিত রান রোটেট করছিলেন। পিচে খুব বিপজ্জনক কিছু নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে রানের গতিও বাড়ান দুজনে। ১৮ ওভারের মধ্যে ১০০ রানের পার্টনারশিপও গড়ে ফেলেন।
ক্লোয়ি ট্রায়নের বলে উইকেটকিপারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন স্মৃতি। তখন তিনি হাফসেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৫ রান দূরে। যদিও জেমাইমার সঙ্গে জুটিতে ভারতের ইনিংস এগিয়ে নিয়ে যান শেফালি। মাঝে ক্যাচ পড়ে জীবনদানও পেয়েছেন। কিন্তু ৭৮ বলে ৮৭ রানের যে ইনিংসটা ‘হরিয়ানা কি ছোড়ি’ খেলে গেলেন, সেটা রীতিমতো বাঁধিয়ে রাখার মতো ঝকঝকে। বহু বছর স্মৃতিতে ধরে রাখার মতো স্মরণীয়। কে বলবে, এই শেফালিই গত ৩ বছরে ওয়ানডে-তে একটাও হাফসেঞ্চুরি পাননি! আরও আশ্চর্যের বিশ্বকাপের প্রাথমিক দলেই ছিলেন না শেফালি। প্রতীকা রাওয়াল চোট পাওয়ায় আচমকা বিশ্বকাপের দরজা খুলে যায়। হাফসেঞ্চুরির পর হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পাওয়ায় চার-ছক্কার দিকেই ঝুঁকলেন। তবে সেঞ্চুরি পেলেন না সেটাই দুঃখের।
ভারতের ১৬৬ রানের মাথায় শেফালি আউট হওয়ার পর ফিরলেন জেমাইমাও। সেমিফাইনালের ‘মহানায়িকা’ ফিরলেন ২৪ রানে। ব্যর্থ হলেন অধিনায়ক হরমনপ্রীত (২০)। আচমকাই রানের গতি কিছুটা কমে যাওয়ায়। কিন্তু অলরাউন্ডার দীপ্তি শর্মা মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন। আমনজ্যোত (১২) আউট হওয়ার পর জুটি বাঁধলেন রিচা ঘোষের সঙ্গে। হাফসেঞ্চুরি করলেন দীপ্তি। আর রিচার ব্যাটে ঝড় ছাড়া কি ভারতের ইনিংস শেষ হয়? ২৪ বলে করলেন ৩৪ রান। ৭ নম্বরে নেমে ভারতকে পৌঁছে দিলেন ২৯৮ রানে। মারলেন ৩টি চার ও ২টি ছয়। দীপ্তি শর্মা আরেকটু ঝুঁকি নিলে হয়তো রানটা নিশ্চিত ভাবেই আরও বাড়ত। সেট হয়ে যাওয়ার পরও কেন রানের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করলেন না সেটাই আশ্চর্যের।
প্রথম থেকে মাটি কামড়ে পড়ে রইলেন। যদিও তাঁর ওপেনিং জুটি তাজমিন ব্রিটসের (২৩) রানআউটে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ধাক্কা পায়। কিছুক্ষণ পরেই আনেকে বশকে (০) ফেরান শ্রী চরণি। কিন্তু সুনে লুসকে নিয়ে দিব্যি দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন লরা। তাহলে উপায়? হরমনপ্রীত বোলিংয়ে নিয়ে এলেন শেফালিকে। ব্যাট হাতে সেঞ্চুরির কাছাকাছি গিয়েছিলেন। বোলিংয়ে প্রায় পরপর দুটি উইকেট তুললেন। সুনের উইকেটের পর ফেরালেন বিপজ্জনক মারিজান ক্যাপকে।
তারপরও বিপদ কমেনি। রাধা যাদবের ওভারে ১৭ রান উঠল। ড্রেকসেন রীতিমতো ঝড় তুলে দিলেন। অন্যদিকে লরা উলভার্ট সেঞ্চুরি তুলে দিলেন। ম্যাচ কি ভারতের হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে? সেই প্রশ্নের উত্তর ছিল অমনজ্যোতের হাতে। দীপ্তি শর্মা এর আগে ড্রেকসেনকে (৩৫) ফিরিয়েছেন। তারপর তাঁর বলকে আকাশে তুললেন লরা। সেটা সোজা অমনজ্যোতের হাতে। না, তিনি প্রথম সুযোগে ধরতে পারলেন না। হাত থেকে বল মিস হল, দ্বিতীয়বারও তাই। তৃতীয়বার এক হাতে বল ধরলেন। আসলে যেন ১৪০ কোটি ভারতবাসীর হৃদপিণ্ডটা লুফে নিলেন। লরা (১০১) ফিরে যাওয়ার পর আর তেমন কেউ ছিল না যিনি ভারতের রাস্তা আটকে পারেন। সেটা আর হয়ওনি। নভেম্বরে শাপমুক্তিতে বিশ্বজয় ভারতের।
