মোল্লা জসিমউদ্দিন (টিপু),
তিনি মুকুল রায়, বাংলার রাজনীতিতে চাণক্য নামেই পরিচিত। সর্বদায় খবরের বেড়াজালে থাকেন তিনি। তাঁর নীরবতার মাঝেও সংবাদমাধ্যমে আসে হেডলাইন। অতি সম্প্রতি বিজেপির সর্বভারতীয় কমিটিতে সহ সভাপতি পদে নিযুক্ত হয়েছেন। জোড়াফুল থেকে পদ্মফুলে দলবদলের পর এহেন পদপ্রাপ্তিযোগে যা না হইচই, তার থেকে বেশি ঘটছে পরপর দুটি মামলায় চার্জশিট দাখিলে মুকুল রায়ের নাম বাদ দেওয়া কে কেন্দ্র করে। একদা সারদা – নারদা মামলায় প্রতিবাদী তথা তৃনমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ জানিয়েছেন – ‘ মুকুল রায় তৃনমূলের এজেন্ট হিসাবে বিজেপিতে গেছেন, এবং পুরো বঙ্গ বিজেপি কে পকেটে পুরে নিবেন ‘। এহেন মন্তব্যর পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের দুটি তদন্তকারী সংস্থা ( সিআইডি এবং সিট) নদীয়ার বিধায়ক খুনের মামলায় এবং বেহালার আর্থিক প্রতারণা মামলায় মুকুল রায়ের নাম বাদ দেওয়াতে বিজেপির একাংশে মুকুলের প্রতি সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। বঙ্গ বিজেপির দাবি -‘ তৃনমূলের এহেন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র মুকুল রায় কে ঘিরে চালালেও তাতে পদ্ম শিবিরে ক্ষতি কিছুই হবেনা’। অপরদিকে আইনজীবী মহলে একাংশের দাবি – ‘ওই দুটি মামলায় মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে জোড়ালো কোন প্রমাণ নেই, যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে চার্জশিটে তদন্তকারী সংস্থারা মুকুল রায়ের নাম রাখে তাতে উচ্চ আদালতের কাছে মুখ পুড়তে পারে রাজ্যের’। উল্লেখ্য, মুকুল রায়ের দলবদলের পর ৪৮ টির বেশি মামলা রুজু হয়েছে। তাতে সবকটি মামলায় কমবেশি কলকাতা হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চে উঠেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইবিধ মামলায় রাজ্য পুলিশের ভুমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্নচিহ্ন দেখা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে তদন্তকারী পুলিশ অফিসার ভৎসনার মুখেও পড়েছেন৷ তাই আটঘাট না বেঁধে মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করলে পুনরায় আদালতের রোষের মুখে পড়বার সম্ভাবনা প্রবল। নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জ বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস খুনে মূল অভিযুক্ত হিসাবে মুকুল রায়ের নাম থাকলেও তা তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি চার্জশিট দাখিলে রাখেনি। তবে বিজেপির রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকারের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল হয়েছে। তিনি (জগন্নাথ সরকার) নিম্ন আদালত থেকে জামিনও নিয়েছেন। এই মামলায় বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি মুকুল রায়ের নাম অতিরিক্ত চার্জশিট পেশে রাখবার সম্ভাবনাও রেখেছে সিআইডি। পুরোপুরি মুকুল রায়ের নাম বাদ দেওয়াটাও হয়নি বিধায়ক খুনের মামলায়। অনুরুপভাবে বেহালার সরশুনায় রেলবোর্ডে স্থায়ী কমিটির সদস্য পাইয়ে দেওয়ার আর্থিক প্রতারণা মামলায় চার্জশিট দাখিলে মুকুল রায়ের নাম আপাতত বাদ রেখেছে লালবাজারের বিশেষ তদন্তকারী টিম ( সিট) । মুকুল রায়ের সংরক্ষিত গলার কন্ঠস্বর পাঠানো হয়েছে চন্ডিগড়ের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে। সেই রিপোর্ট এলে মুকুল রায়ের নাম অতিরিক্ত চার্জশিট দাখিলে থাকতে পারে। গত শুক্রবার কলকাতার আলিপুর আদালতে লালবাজারের সহকারী কমিশনার পার্থপ্রতিম দাসের নেতৃত্বে সিটের পক্ষ হতে রেলবোর্ডে স্থায়ী কমিটির সদস্য পাইয়ে দেওয়ার আর্থিক প্রতারণা মামলায় চার্জশিট দাখিল হয়। ৮ পাতার এই চার্জশিটে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সারবত্তা খুঁজে পেয়েছে তদন্তকারীরা। ইতিমধ্যে এই চারজনের মধ্যে তিনজন জামিনে মুক্ত রয়েছে। বাকি একজন মামলা রুজুর পর থেকেই পলাতক। চারটি মোবাইল সেট বাজেয়াপ্ত করা রয়েছে। তাতে কলহিস্ট্রি, ম্যাসেজ প্রভৃতি খতিয়ে দেখা হয়েছে। পাশাপাশি অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজনের গলার কন্ঠস্বর রেকর্ড করা আছে। পরবর্তীক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশে এই মামলার প্রথম দিকে ‘সাক্ষী’, পরবর্তীতে ‘অভিযুক্ত’ মুকুল রায়ের গলার কন্ঠস্বর রেকর্ড করা আছে। যা চন্ডিগড়ের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এলে যদি মোবাইলে ব্যবহৃত কন্ঠস্বরের সাথে মিলে যায় তাতে মুকুল রায়ের নাম অতিরিক্ত চার্জশিট পেশে থাকতে পারে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে রেলের এক আধিকারিকের কাছ থেকে নগদ ৮০ লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়। এই টাকা উদ্ধারের মামলায় মুকুল রায়ের নাম সাক্ষি হিসাবে থাকে। বারবার নোটিশ পাঠিয়েও কলকাতা পুলিশের তদন্তে মুকুল রায় কে পাওয়া যায়নি। মুকুল বাবুর যুক্তি ছিল – তিনি দিল্লির ভোটার ( বাসিন্দা) তাই দিল্লিতেই জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে তদন্তকারীদের। পরবর্তীতে দিল্লিতে মুকুল রায়ের বাড়িতে যায় তদন্তকারীরা। এই মামলায় সাক্ষি থেকে অভিযুক্ত হিসাবে নাম উঠে মুকুল রায়ের। ব্যাংকশাল আদালতে ওয়ারেন্ট জারী হয় বিজেপির এই নেতার বিরুদ্ধে। যা দিল্লি হাইকোর্টের নির্দেশে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজশেখর মান্থার সিঙ্গেল বেঞ্চে মামলাটি উঠে। ব্যাংকশাল আদালতের জারি করা ওয়ারেন্ট শর্তসাপেক্ষে খারিজ হয় কলকাতা হাইকোর্টে।এই মামলায় মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ বাবান ঘোষ, সাদ্দাম হোসেন গ্রেপ্তার হয়। পরে অবশ্য এরা জামিনে মুক্ত রয়েছে। তবে কামাল হোসেন আনসারী প্রথম থেকেই পলাতক রয়েছে। বেহালা থানায় জিজ্ঞাসাবাদে হাজিরও হয়েছিলেন মুকুল রায়। ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার কলকাতার আলিপুর আদালতে লালবাজারের সহকারী কমিশনার পার্থপ্রতিম দাসের নেতৃত্বে সিটের পক্ষ থেকে এই মামলায় চার্জশিট দাখিল হয়। যেখানে চারজন অভিযুক্তের নাম রয়েছে। তবে আরেক অভিযুক্ত তথা বিজেপির সর্বভারতী সহ সভাপতি মুকুল রায়ের নাম নেই। তবে তদন্তকারীরা চন্ডিগড়ের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো রেকর্ডেড কন্ঠস্বরের সাথে মুকুল রায়ের কন্ঠস্বর পরীক্ষার রিপোর্ট দেখেই অতিরিক্ত চার্জশিট দাখিলের পথ খোলা রেখেছে। তবে রাজনৈতিক মহলে মুকুল রায় কে নিয়ে করচা শুরু হয়েছে পরপর দুটি মামলায় চার্জশিট পেশে নাম বাদ দেওয়া নিয়ে। তৃনমূলের পক্ষ থেকে মুকুল রায়ের প্রতি নরম মনোভাব ( দলে পুনরায় যোগদান) দেখিয়ে বিজেপির অন্দরে চোরাস্রোত তৈরি করা হচ্ছে বলে গুঞ্জন উঠছে। তাতে কুণাল ঘোষ এর মত বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব ( তথা তৃনমূলের মুখপাত্র ) মুকুল রায় কে তৃনমূলের এজেন্ট বলে বঙ্গ বিজেপি কে পকেটে রাখবার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তুলে ধরায় মুকুল রায় কে নিয়ে বিতর্কর পারদ বহুগুণ বেড়েছে। তবে মুকুল রায় ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন -‘ যে তৃণমূল সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ৪৮ টি ফৌজদারি মামলা চালিয়ে জব্দ করার নোংরা খেলা খেলেছে, সেই সরকারের পতন আগামী বিধানসভার ভোটে তিনিই ঘটাবেন বিজেপির হয়ে। ‘ এখন দেখার নদীয়ার বিধায়ক খুনের মামলায় এবং বেহালার আর্থিক প্রতারণা মামলায় মুকুল রায়ের নাম অতিরিক্ত চার্জশিট দাখিলে রাখে কিনা তদন্তকারী সংস্থারা?