পাঁচমুড়ার আয়েসি পুতুলের স্রষ্টা শিল্পী বিশিষ্ট শিক্ষক বিশ্বনাথ কুম্ভকার।
সাধন মন্ডল বাঁকুড়া:—–বাঁকুড়া জেলার পাঁচমুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া হাতি মনসার চালি পত্র-পত্রিকায় বহুল প্রচারিত। স্বর্গীয় রাসবিহারী কুম্ভকার হস্তশিল্পে পোড়ামাটির ঘোড়ায় রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ার পর এই শিল্পের প্রচার আরো বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। দেশের শিল্প রসিক মানুষজন পাঁচমুড়ার পোড়া মাটির কাজকর্মের প্রতি অনুসন্ধিৎসা বাড়ায়। এর পাশাপাশি পাঁচমুড়ার তৈরি পোড়ামাটির ছোটখাটো পুতুল ভাস্কর্য ব্যাপকভাবে বাজারে চালু আছে। দেশের মানুষ নদীয়ার কৃষ্ণনগরের পুতুল ভাস্কর্য ব্যাপকভাবে দেখতে অভ্যস্ত কিন্তু পাঁচমুড়ার পোড়ামাটির পুতুল কৃষ্ণনগরের থেকেও আলাদা। এই পুতুলের বৈশিষ্ট্য বাস্তবধর্মী ভাবধর্মিতা প্রকট হয়ে উঠেছে। সবচাইতে বড় কথাকে বা কারা সৃষ্টি করলেন পাঁচমুড়ার এই ছোট ছোট পুতুল ভাস্কর্য ? দেশ বা দশের কাছে এই কৌতূহল বেড়েই চলেছে। যদি খোঁজ নিই তাহলে দেখা যাবে, পাঁচমুড়ার রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত রাসবিহারী কুম্ভকারের মেজ সন্তান নিতাই পদ কুম্ভকারের পুত্র বিশ্বনাথ কুম্ভকার এই পুতুল ভাস্কর্য ১৯৯২ সালে প্রথম ৩৩ টি পুতুল ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছিলেন। এগুলির মধ্যে কলসি কাঁখে বধু ,মুরলীধর, রাধা কৃষ্ণ, ওয়ার্কিং মাদার, সানতাল, বাউল, পিকুলিয়ার ম্যান ও বাংলার অজস্র বাদ্যযন্ত্র দিয়ে বহু মানুষের ছবি। এই পোড়ামাটির পুতুল ছবিগুলো দেখে কেরালার বিখ্যাত পর্যটক সাহিত্যিক কে এন সাজি বিশ্বনাথ বাবুকে তার ৩৩ টি পুতুল ভাস্কর্য নিয়ে তেলাওয়াত ত্রিবান্দ্রম এ একটি এক্সিবিশনের আয়োজন করেছিলেন। কেরালার শিল্পবৃদ্ধ মানুষ ও বিখ্যাত কেরালার ভাস্কর্য শিল্পী মিস্টার কালাধরণ এগুলি খুব প্রশংসা করেন এবং বিক্রিবাটা ভালো হয়। ত্রিবান্দম এর এক্সিবিশন থেকে ফিরে বিশ্বনাথ বাবু সর্বপ্রথম ভারত সরকারের ডাকে দিল্লির প্রগতি ময়দানে যান । পুতুল গুলি নিয়ে তিনি এক্সিবিশন ওয়ার্কশপ করেন। একমাস পর দিল্লির ললিতকলা একাডেমিতে তিনি দশ দিনের জন্য সুযোগ পান। ভারত সরকারের সিসিআরটির সংস্থার সুভাষ বাবু পরবর্তীকালে বিশ্বনাথ বাবু কে দিল্লির কটেজ ইন্ডাস্ট্রিতে পাঠান। এই পুতুল নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য। কটেজ কেনার খুবই আগ্রহ দেখায় এবং তারা বহুবার মাল কেনে। দিল্লির কটেজ মালকানাই এই পুতুলের চাহিদা শুধু দেশ নয় দেশের বাইরেও বেড়ে যায়। পরবর্তীকালে কলকাতার মঞ্জুসার ডিজাইনার আশিস পানের তত্ত্বাবধানে ইন্ডিয়া ডট কম নামে একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সংস্থার সঙ্গে পুতুল বিক্রি জন্য ডিরেক্টর কুমার সাহেবের সঙ্গে তিনি চুক্তিবদ্ধ হন। এই সংস্থা বিশ্বনাথ বাবুর পুতুলগুলোকে রাশিয়া ইউকে হাভানা এবং ইংল্যান্ডের কিছু কিছু জায়গায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিক্রি করে। এরফলে চাহিদা বাড়তে থাকে। পরবর্তীকালে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যেমন মধুসূদন মঞ্চ, সল্টলেক ও কলকাতা ময়দানের এক্সিবিশন ও এই পুতুল গুলির চাহিদা তীব্র বাড়তে থাকে। প্রথমেই পুতুলগুলি অধিকাংশই কালো রঙের তৈরি করা হতো। তারপর কালো লাল দুই রঙের পুতুলের চাহিদায় বাড়তে থাকলো। বর্তমানে সর্বত্রই ড্রয়িং রুমে এই পুতুল গুলি পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ বা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দুর্গাপূজা কালীপূজা বিশ্বকর্মা পূজা জগধাত্রী পূজা প্যান্ডেল ডেকোরেশন ও সৌন্দর্যায়নে এর কাজে এই পুতুলগুলি অধিক সংখ্যায় ব্যবহৃত হয়। একার পক্ষে এত বড় চাহিদা মেটানো সম্ভব হতো না যদি পাঁচমুড়ার কুম্ভকাররা সবাই একসাথে এই ধরনের না করতেন। শুধুমাত্র পাথরই নয় বিবড়দা ও বাঁকুড়ার বিভিন্ন জায়গায় এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে এই পুতুলের আরফানটি নিয়ে পুতুল তৈরি হচ্ছে আকছlর ভাবে। সকলেই শিল্পী বানাচ্ছেন মানুষের চাহিদাও পূরণ করছেন। বর্তমান ইন্টারনেট এবং ফেসবুকের যুগে শিল্পী তার নিজস্ব শিল্পকর্মকে ও সৃষ্টিকে মানুষের কাছে তুলে ধরার অবশ্যই চেষ্টা করবেন। তাই ২৮/১২/২০২৪ তারিখে, অনেক শিল্প-বুদ্ধা মানুষের অনুরোধে, বিশ্বনাথ কুম্ভকার যেহেতু এই পুতুলের স্রষ্টা তাই তিনি এই পুতুলটির নাম রেখেছেন “পাঁচমুড়ার আয়েশি পুতুল”। তাই বর্তমানে এই পুতুলটি পাঁচমুড়ার তথাকথিত পোড়ামাটির ঘরানাতে একটি নতুন পালক যোগ করল। বিশ্বনাথ বাবুকে তার এই পুতুল তৈরীর কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে একাত্ম হয়ে কাজ করে চলেছেন তার সহধর্মিনী সুতপা কুম্ভকার। এখানে উল্লেখ্য প্রয়াত রাসবিহারী কুম্ভকার বাবুর হাত ধরেই পাঁচমুড়ার টেরাকোটা আজ বিশ্ব বন্দিত।