‘প্রেম হোক প্রতিবাদ’- ধরা পড়ল প্রেমের বিভিন্ন রূপ
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুভূতি আলাদা হলেও 'প্রেম' শব্দ বন্ধনী যেকোনো বয়সী কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে দিয়ে যায় বসন্তের দোলা। রঙিন ফাগের মত মন হয়ে ওঠে সাতরঙা রামধনুর মত রঙিন। খোলা ছাদে রোমান্টিক মুডে প্রেমিকার হাত ধরে পূর্ণিমার চাঁদ এনে দিতে প্রেমিকের মন চায়। গঙ্গার তীরে বসে প্রেমিকার কোলে মাথা রেখে বাদাম খেতে খেতে গঙ্গার ঢেউ গুণতে গুণতে যুগল ভেসে যায় অন্য প্রেমের জগতে। এরকম অসংখ্য কল্পদৃশ্য ভেসে ওঠে প্রেমিক-প্রেমিকার চোখে। কাব্যরসিক পাঠক মুহূর্তে পৌঁছে যায় সেখানে।
কিন্তু কোনো কাব্যের শিরোনাম যদি হয় 'প্রেম হোক প্রতিবাদ' তখন পাঠকের ভাবনা প্রেমের চির পরিচিত পথ ছেড়ে অন্য খাতে বইতে বাধ্য হবে। দক্ষ স্রষ্টা তার লেখনির হাত ধরে পাঠকের মনে নিশ্চিতরূপে অন্য ভাবনা এনে দেবেন। যেমন দিলেন বেলেঘাটার সঙ্গীতা কর।
প্রেম থাকবে অথচ রবীন্দ্রনাথ থাকবেনা, তাই কখনো হয়! আসলে 'রবীন্দ্রকাব্য' ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মত। প্রেম থেকে শুরু করে বিরহ কাব্যজগতের সমস্ত কাহিনী ধরা পড়েছে তাঁর কলমে। সেই রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই শুরু হয়েছে কাব্যসংকলন 'প্রেম হোক প্রতিবাদ'। তাঁর কাছে একটা উপন্যাস লেখার আবেদন করলেন কবি সঙ্গীতা। কাদম্বরী, বিনোদনীদের কথা উল্লেখ করে 'সাহসী প্রেমে পুরুষ বরাবর পরাজিত' লিখেও তিনি লিখলেন 'প্রেম রাজ্যে নারী হবে সত্যিকারের জয়ী'। গভীর ভাবনায় পড়তে পাঠক বাধ্য।
ওদিকে 'লালসা ভরা প্রেমহীন মোহের পরিচয়' নিয়ে 'মিলন পিয়াসী' নারী হতে চায়নি রোমিও, জুলিয়েটদের মত অমর প্রেমিক-প্রেমিকা। বরং
‘প্রকৃত নারী খুঁজে ফেরে শ্রদ্ধেয় পুরুষ একরত্তি’।
'সিঁথি ভর্তি সিঁদুর' এর মধ্যে 'পরাধীনতার স্পষ্ট ছাপ' ও 'স্বামীর অবাধ যৌনতা' খুঁজে পেলেও নারীর ব্যভিচারিতা নিয়ে কবি নীরবতাকে হিরন্ময় বলে মনে করেন। ফলে সহজেই কবির গায়ে 'নারীবাদী' বিশেষণ সাঁটিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু 'আমাদের প্রেমের বীজ পরিণত হোক অমর মহীরুঢ়ে' - ভাবনায় ফেলে দেয় পাঠককে। মনে আসে দ্বিধা। সেই দ্বিধা আরও বেড়ে যায় 'কামনার সাধ মেটাতে পাড়ি দিই ভিন্ন পুরুষের সাথে' - নারী যে নিজেও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছে!
জন্মের পর থেকেই 'পুরুষের উদগ্র কামনার সামগ্রী' নারীকে 'লালসার আগুনে পোড়ায় সমাজ'। স্বামী, সন্তান - কেউ দেয়না প্রাপ্য সম্মান। নারীকে আহ্বান জানিয়ে কবি লেখেন 'জাগো নারী, নিজ ক্ষমতায় নাও যোগ্য আসন' - এতো সমস্ত অবহেলিতদের প্রতি সার্বিক আহ্বান।
প্রেমিকের কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে প্রেমিকা যখন বলে ওঠে ঐশ্বর্যের সমাধিতে তাকে বন্দী না করে 'সবার তরে বিলিয়ে দিও যা আছে তোমার' - ধরা পড়ে মমতাময়ী রূপ।
ওদিকে যুবতী হওয়ার আগেই কানের সামনে বেজে ওঠে সাবধান বাণী 'সামলে রেখো এবার নিজেকে যত্ন করে'। কারণ 'বাড়ন্ত শরীরের ভাঁজে ভাঁজে বহমান খরস্রোত' ইঙ্গিত দিচ্ছে 'বীজ বপনে হতে হবে অতি সতর্ক'।
যদিও 'আদরের রাজকন্যা দুয়োরাণীতে পরিণত হয়' তাও অবহেলিতাদের মনে সাহস জুগিয়ে কবি ইচ্ছে প্রকাশ করেন 'দেখিস আবার আসব ফিরে, সেই জনমে লক্ষী নয় মা, জেনে রাখিস মহাকালী রূপে'।
'এইবেশ ভাল আছি' কবির কলমে ফুটে ওঠে 'পৃথিবীতে আর নেই আমি, নেই আমার কবিতা'। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় 'হে রবি, তোমাকেই চাই জীবনের প্রতি ক্ষণে ক্ষণে'- কাব্যজগতে এই রবি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ এবং জীবজগতে সূর্য, দুটোই আমাদের প্রয়োজন।
এইভাবে সংকলনটির ভিন্ন স্বাদের ৪২ টি কবিতার মধ্যে ধরা পড়েছে প্রেমের বিভিন্ন রূপ। সেই রূপ আস্বাদন করতে হলে অলস সময়ে অবশ্যই সংকলনটি পাঠ করতে হবে।
যতই মশলা থাকুক রাধুনী দক্ষ নাহলে তরকারি সুস্বাদু হয়ে ওঠে। সঙ্গীতা করের লেখা কবিতাগুলি নিঃসন্দেহে অসাধারণ। সেগুলি অনবদ্য দক্ষতায় সঠিকভাবে পরপর সাজিয়ে প্রকাশিকা মধুমিতা ধূত সংকলনটিকে অন্যমাত্রা এনে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রশংসার দাবি রাখতে পারেন।
সবমিলিয়ে বলা যায়, সঙ্গীতার কবিতাগুলি সত্যিই কাব্যসঙ্গীত ছড়িয়েছে সেটি অস্বীকার করা যায়না।