বেহালাতে জীবন্ত লাইব্রেরি: বই আর মানুষের এক মহোৎসব

Spread the love

বেহালাতে জীবন্ত লাইব্রেরি: বই আর মানুষের এক মহোৎসব

রাজকুমার দাস
আজকের পৃথিবীটা যেন কেবল স্ক্রিনের বন্দি। সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল গেমস, নেটফ্লিক্সের রঙিন জগতে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। বই পড়ার অভ্যাস দ্রুত ভেঙে পড়ছে। পাঠকের অভাবে পত্রিকা বন্ধ হচ্ছে, প্রকাশনাগুলো দম নিতে পারছে না। এক সময় বাংলার প্রতিটি পাড়ায়-পাড়ায় যে লাইব্রেরি আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল, আজ সেই লাইব্রেরিগুলো নিস্তব্ধ। কোটি টাকার বই ধুলোয় ঢেকে নষ্ট হচ্ছে।

কিন্তু এই অন্ধকার সময়ে এক মানুষ স্বপ্ন দেখলেন অন্যভাবে। তিনি হলেন লেখক পিন্টু পোহান। যিনি বেহালা চৌরাস্তার মদনমোহনতলায় ফুটপাতে বসে ছোট্ট একটা পানের দোকান সামলাতে সামলাতেই ২৫ বছর ধরে নিরলস সাহিত্যচর্চা ও পড়াশোনা করে দৃষ্টান্তমূলক প্রেরণায় নিদর্শন হিসেবে উঠে এসেছেন ভারতবাসীর কাছে। তিনি বুঝলেন, কেবল বক্তৃতা বা প্রচার দিয়ে নয়, বইকে ঘিরে করতে হবে উৎসব। বানাতেই হবে নতুন পাঠক সমাজ। আর সেই ভাবনা থেকেই শুরু হল একের পর এক অভিনব উদ্যোগ—যা আজ বাংলার মানুষকে অবাক করে দিচ্ছে।

বইপুজো: বইয়ের পূজা

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে বেহালার মদনমোহনতলায় টানা ৭২ ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক অভূতপূর্ব অনুষ্ঠান—বইপুজো। এখানে বই বিক্রি হয়নি, কোনো মেলা হয়নি। কেবল বইকে ঘিরে পাঠ, আবৃত্তি, আড্ডা আর পূজার মতো নিবেদন। বইকে জ্ঞানের দেবতা হিসেবে সম্মান জানানোর এই প্রতীকী আয়োজন বাঙালি সংস্কৃতিতে এক নতুন দিশা দেখায়।

বইবরণ: নতুন বছরকে বইয়ের সঙ্গে স্বাগত

২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম রাত। যখন সারা দুনিয়া আতশবাজি আর পার্টিতে মেতেছে, পিন্টু পোহান, বিপুল অধিকারী, সুবিমল দাস আর তাঁর সঙ্গীরা নতুন বছরকে বরণ করলেন বই হাতে। বইবরণ নাম পেল এই অনুষ্ঠান। ঘড়ির কাঁটা বারোটা বাজতেই পাঠকেরা বই খুলে পড়তে শুরু করলেন—যেন নতুন সময়ের প্রথম নিশ্বাসটিই বইয়ের পাতায় বাঁধা থাকুক।

স্রষ্টাবরণ: লেখকদের সম্মান

শুধু বই নয়, বইয়ের স্রষ্টাদেরও সম্মান জানাতে হবে—এই উপলব্ধি থেকেই ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ ‘স্রষ্টাবরণ’ অনুষ্ঠিত হয়। বেহালার কলাভবনে লেখক, কবি, শিল্পী ও চিন্তকদের বরণ করা হয়। পাঠক ও লেখকের মধ্যে সেই সেতুবন্ধন আবারও দৃঢ় হয়ে ওঠে।

বই নববর্ষ ও বইয়ের জন্য প্রভাতফেরি

১৪৩১ সালের ১লা বৈশাখে বইপ্রেমীরা ঘোষণা করলেন—এটাই হবে বই নববর্ষ। কোনো বাণিজ্যিক আয়োজন নয়, শুধু বই আর বইপ্রেমীদের নিয়ে প্রভাতফেরি। সেই শোভাযাত্রা ছড়িয়ে দিল বইয়ের সুবাস মানুষের ঘরে ঘরে।

জীবন্ত লাইব্রেরি: প্রতিটা মানুষও একেকটা বই

এবার এল সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ—জীবন্ত লাইব্রেরি।
২০২৫ সালের ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বর বেহালা চৌরাস্তায় এক অভিনব দৃশ্যের সাক্ষী রইল কলকাতা। রাস্তার দুদিকের ফুটপাতের টেবিলে ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য বই, যেকোনো মানুষ বিনামূল্যে বই নিয়ে পড়তে পারলেন। কিন্তু আশ্চর্য এখানেই শেষ নয়—এখানে প্রতিটি মানুষও একেকটা বই।

বিপুল অধিকারী, সুবিমল দাস, তন্ময় সর্দার সহ আরও বহু বইপ্রেমী নিজেদের জীবনের গল্প, অভিজ্ঞতা, সঞ্চিত জ্ঞান অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন। কলকাতা কর্পোরেশনের ১২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রূপক গাঙ্গুলী সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে পরপর দুদিন-ই অংশ নিয়েছিলেন এই আয়োজনে। অংশ নিয়েছিলেন বেহালার বিশেষ করে মদনমোহনতলার সাধারণ মানুষেরা।
হাজারেরও বেশি মানুষ এতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। বইয়ের পাশাপাশি মানুষ মানুষকে পড়ল, মানুষ মানুষকে জানল।

এই ‘জীবন্ত লাইব্রেরি’র মূল দর্শন একটাই
“মানুষকে মানুষের কাছে, মানুষকে বইয়ের কাছে আনা।”

বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি

পিন্টু পোহানের এই আয়োজন কোনো নস্টালজিয়া নয়। এটা ভবিষ্যতের জন্য এক সংগ্রাম। সংস্কৃতি, জ্ঞান আর মানবিক সম্পর্ক বাঁচানোর লড়াই। বইকে কেবল পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নয়, জীবনের সঙ্গী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস।
পৌর প্রতিনিধি রূপক গাঙ্গুলী ও অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে “আমরা বইপ্রেমী” সংগঠনের ছাতার তলায় অজয় পাল, বিপুল অধিকারী, সুবিমল দাস ও তন্ময় সর্দারের মতো বন্ধুদের হাত ধরে বেহালায় যে জীবন্ত লাইব্রেরি তিনি করলেন তাও এক ইতিহাস সৃষ্টি করল।

শেষকথা

আজকের দিনে যখন যন্ত্রের নেশা মানুষকে একা করে দিচ্ছে, তখন বইকে কেন্দ্র করে এই সামাজিক উৎসব এক নতুন আশার আলো।
বইপুজো থেকে জীবন্ত লাইব্রেরি—সব মিলিয়ে এটি এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব।
এ কারণেই বলা যায়—
পিন্টু পোহান কোনো সংগঠন তৈরি করেননি, তিনি তৈরি করছেন এক জীবন্ত উৎসব। আর সেই উৎসবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ রইল আমাদের সকলের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *