খায়রুল আনাম,
বীরভূম : চৈত্রের ঝিরঝিরে বৃষ্টিস্নাত সকাল। আশপাশে এখন আর নেই আদিবাসী মহল্লার রমণীদের খোঁপায় গোঁজা অনামী বনফুলের বাহার ছড়িয়ে পেটানো শরীর নিয়ে ক্ষেতের পথে চলে যাওয়া চোখের আরামের দৃশ্যপট। দূরে দাঁড়িয়ে আছে রামকিঙ্করের বালি-কাঁকড়ের মিশ্রণের সাঁওতাল পরিবার আর কলের ডাকের জগতজোড়া খ্যাতির দৃশ্যপট। তবুও যে সবকিছু হারিয়ে যায়নি, আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও যে এখনও আম্রকুঞ্জের বইরেও জীবন্ত, তা জীবন ছেঁচে সামনে নিয়ে এলো বোলপুরের কনীনিকা নৃত্য মন্দির। তাঁদের শতাধিক শিল্পীর নাচের ছন্দ, পায়ের পাতার ওঠানামা আর শরীরের বিভঙ্ক মোচড়ে এখানকার সায়রবীথি মঞ্চে অন্যমাত্রায় পাওয়া গেল বসন্ত উৎসবের এক বর্ণালী বৃষ্টিভেজা সকাল। আহা! এ কি আনন্দ আজ আকাশে- বাতাসে। আমাদের ঠোঁটের ডলায় বাসাবেঁধে থাকা বিষোদগারের বিষপুঁটুলি সরিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত-নৃত্যের তালে রাতের বদলেও দিনের আলোয় পাওয়া গেল মায়াবী সকাল। এমন সকাল তো পায়নি বহুদিন। একদিন এই সায়রবীথির পাশে দাঁড়িয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতাদেবী দু-হাতের করতল বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, দেখ, আমার শান্তিনিকেতনের ছাত্রী জীবনের সেই লালমাটি ধোয়া ধারা জলের ছোঁওয়া এখনও পাবি। সেদিন মনে হয়েছিল কী, ‘হাজার চুরাশির মা’ তুমি কী ধরে রাখতে পারবে ‘অরণ্যের অধিকার ‘? কিন্তু এদিন কনীনিকা নৃত্য মন্দিরের বসন্ত উৎসব উদযাপন মুছে দিলো অনেক অনেক গ্লানি। কনীনিকা নৃত্য মন্দিরের নন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায় যে বৈঠকখানা ঘরে বসা অভিজাত পরিবারের অনন্যা হয়ে হাতের বাউটিতে শব্দ তুলে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কথা বলেন না, তাও স্পষ্ট হয়েছে তাঁর সমবেত প্রচেষ্টার সফল উপস্থাপনায় রবীন্দ্রনাথের ‘চণ্ডালিকা’ র মধ্যে দিয়ে। তিনি সম-সময়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এক অর্জুন হয়ে গুরু দ্রোণাচার্যের মতো বলতে পেরেছেন, সমাজের এই অবক্ষয় আর আমাদের যাপিত-জীবনের মূলস্রোতটা ধরে রাখতে তো আমরা রবীন্দ্রনাথেরই পথে হাঁটার প্রয়াসটা চালিয়ে যেতে চাইছি। অবক্ষয়িত এই সময়-যাপনে আপনাকে কুর্নিশ।