মোল্লা জসিমউদ্দিন (টিপু)
রাজনৈতিক মহলে মঙ্গলকোট অতি পরিচিত এলাকার নাম। বিগত বাম জমানায় নিহত সিপিএম নেতা ফাল্গুনী মুখার্জি খুন নিয়ে যেমন বরাবর উত্তপ্ত হয়েছিল মঙ্গলকোট। ঠিক তেমনি বর্তমান তৃনমূল সরকারের আমলেও শাসকদলের আভ্যন্তরীণ বিবাদে রক্তাক্ত হয়েছে মঙ্গলকোট। বিধায়ক বনাম ব্লক তৃণমূল সভাপতির লড়াই এখনও অব্যাহত। তার উপর এই বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূলের অভিভাবক আবার অনুব্রত মন্ডল মহাশয়! তাই খবরের শিরোনামে মঙ্গলকোট প্রায়শই থাকে। সামনে বিধানসভা ভোট। তাই প্রাক প্রস্তুতি চলছে সব মহলেই। থেমে নেই তৃনমূলের দুই যুযুধান শিবিরও। রাজনৈতিক লড়াইয়ে বাংলায় মুখোমুখি বিজেপি থাকায় ধর্মীয় বিভাজনের ভোটটাই আসল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। ২০১৬ সালে মুসলিম ধর্মীয় গুরু সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর জন্য লোকসভার মার্জিনের ২৪ হাজারের কাছাকাছি ভোট পাইনি তৃনমূল। যদিও ৩৬ হাজারের সম্ভাব্য মার্জিনে না জেতে মাত্র ১২ হাজারের জয়লাভ পেয়েছিলেন তৃনমূল প্রার্থী। ২০১১ সালে দলীয় অন্তর্ঘাতে মাত্র দেড়শো ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন সেসময়কার তৃনমূল প্রার্থী অপূর্ব চৌধুরী। গোটা রাজ্যজুড়ে তুমুল পরিবর্তনের ঝড় দেখা গেলেও মঙ্গলকোটে দলীয় এক নেতার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে সেই পরিবর্তনের স্বাদ মঙ্গলকোটে পাইনি তৃনমূল। এইরূপ অভিযোগে সরগরম ছিল মঙ্গলকোটের রাজনীতি। ২০১১ সালে একাংশ দলীয় বিশ্বাসঘাতকতায় জিতেও হেরেছিল তৃণমূল। তাই ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে প্রবল আশাবাদী ছিলেন গতবারের তৃণমূল প্রার্থী অপূর্ব চৌধুরী । তবে জমিয়ত উলেমা হিন্দের সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর রাজ্যজুড়ে একশো আসনে প্রার্থী দেওয়ার ভাবনায় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নতে ডেকে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী কে একপ্রকার বাধ্য হয়েই মঙ্গলকোটে প্রার্থীপদ দেন মুসলিম ভোটব্যাংকের হিসাব-নিকাশ করে। ২০১৪ সালের লোকসভার ভোটের মার্জিনে মঙ্গলকোটে ৩৬ হাজার ভোটে জেতার দরকার ছিল সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর। এক্ষেত্রে জয়ের ব্যবধান কমে যায় অর্ধেকের বেশি। ১২ হাজারে কাছাকাছি ভোটে জেতেন তিনি। এই ব্যবধান কমাতে উগ্র হিন্দু ভোট দায়ী ছিল বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে। জেতার পর থেকেই বিরোধী দল সিপিএম – বিজেপি অপেক্ষা দলের ক্ষমতাসীন গ্রুপের বিরুদ্ধে সরব হতে থাকেন সিদ্দিকুল্লাহ। ভূমিপুত্র তথা তৃনমূলের জন্মলগ্ন থেকে দল করা অপূর্ব চৌধুরীর বিরুদ্ধে এহেন দলীয় বিভাজন তৃনমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব কখনই মান্যতা দেয়নি। যার সর্বশেষ প্রমাণ মেলে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের দলীয় প্রতীক বিলিতে। কখনো ফিরহাদ হাকিম, কখনো বা পার্থ চাটার্জী আবার কখনোবা অরুপ বিশ্বাস কে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে দেখা যায়। কার্যক্ষেত্রে অনুব্রত অনুগামী অপূর্ব চৌধুরীর প্রতিনিধিরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে থাকে। বিরোধীশুন্য মঙ্গলকোটে বর্তমান যা পরিস্থিতি তাতে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী কে পুনরায় প্রার্থী করলে বিপুল কট্টর হিন্দুত্ব ভোট বিজেপির দিকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। এখন যা পরিস্থিতি তাতে পশ্চিম মঙ্গলকোটের ৩ টি, উত্তরপূর্ব মঙ্গলকোটে ২ টি এবং দক্ষিণপূর্ব মঙ্গলকোটে ৩ টি সর্বমোট ৮ টি অঞ্চলে (১৫ টি অঞ্চলের মধ্যে) বিজেপির প্রভাব ক্রমশ শক্তিশালীর দিকে। তাই একাধারে উগ্র হিন্দুত্ব ভোট অপরদিকে আদি তৃনমূল কর্মী সমর্থকদের বড় অংশের কথা ভেবে ‘বঞ্চিত’ অপূর্ব চৌধুরী কে এবার মঙ্গলকোটের বিধানসভা নির্বাচনে তৃনমূল প্রার্থী হিসেবে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।তবে মঙ্গলকোটের বর্তমান বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী জানিয়েছেন – ” দল যেখানে প্রার্থী করবে সেখানেই দাঁড়াবো। তবে মঙ্গলকোটের অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি “। অপরদিকে মঙ্গলকোট তৃনমূলের প্রভাবশালী নেতা অপূর্ব চৌধুরী জানিয়েছেন – ” দলের উর্ধে কেউ নয়, দলই ঠিক করবে মঙ্গলকোটের প্রার্থী কে হবেন? ” উল্লেখ্য ২০১৬ সালে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রার্থীপদ ঘোষণার বহু আগে রাজ্য তৃণমূল নেতা অনুব্রত মন্ডল মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রামে যোগাদ্যা মন্দিরে পুজো দিতে এসে মঙ্গলকোটের প্রার্থী হিসেবে অপূর্ব চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেছিলেন। পরে অবশ্য তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলকোটে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী কে দলীয় প্রার্থীপদ দেন। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে – ‘অনুব্রত মন্ডলের আগাম মঙ্গলকোটের প্রার্থীপদ ঘোষণা হয়তো তৃনমূল নেত্রী ভালো চোখে দেখেননি ‘। তবে স্থানীয় সুত্রে প্রকাশ, মঙ্গলকোটের বর্ষীয়ান তৃনমূল নেতা বিকাশ চৌধুরী ( সেসময়কার পূর্ব বর্ধমান জেলাপরিষদের সদস্য) এর সাথে আরেক নেতা অপূর্ব চৌধুরীর সাপেনেউলে সম্পর্ক ছিল। তাই একাধারে ২০১১ সালের মত দলীয় অন্তর্ঘাত না হয়, পাশাপাশি মুসলিম ভোটব্যাংকের হিসাব-নিকাশ করে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী কে মঙ্গলকোটে প্রার্থী করেছিল তৃনমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে এবার অর্থাৎ ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দুত্ব ভোট বড় ফ্যাক্টর। গত লোকসভা ভোটে (২০১৯ সালে) বিজেপি বাংলার বুকে ১৮ টি আসন ছিনিয়ে নিয়েছে। বেশিরভাগ বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে গেরুয়া শিবির। তাই হিন্দুত্ব ভোট একছত্র রাখতে এবং আদি তৃণমূল কর্মীসমর্থকদের কথা ভেবে মঙ্গলকোটে অপূর্ব চৌধুরী কে দলীয় প্রার্থী পদ দিতে পারে তৃনমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেক্ষেত্রে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীকে কলকাতা সংলগ্ন উত্তর ২৪ পরগণার যে কোন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত আসনে পুনরায় প্রার্থী করার ভাবনা রয়েছে বলে রাজ্য তৃনমুলের একাংশ সুত্র মারফত জানা গেছে। এখন দেখার ২০১১ সালের বিধানসভার দলীয় অন্তর্ঘাতে অল্প ব্যবধানে হেরে যাওয়া ‘বঞ্চিত’ অপূর্ব চৌধুরী কে ২০২১ সালের বিধানসভার দলীয় টিকিট দেয় কিনা তৃনমূল……