মারাত্মক শ্বাসকষ্ট থেকে বাঁচাতে পারে ভেন্টিলেটর জানালেন ডাঃ
পুষ্পিতা মণ্ডল
রাজকুমার দাস
ঠাণ্ডার দাপট আর বায়ু দূষণে ফুসফুসের ক্রনিক অসুখ মারাত্মক রূপ নিতে পারে। আবার নানান শারীরিক অসুস্থতার জন্যেও স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে রোগীর জীবন বাঁচাতে ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়, এই বিষয়ে সবিস্তারে জানালেন উডল্যান্ডস হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিনের চিকিৎসক ডা পুষ্পিতা মণ্ডল।
সাধারণ মানুষের ধারনা হাসপাতালের বিল বাড়ানর জন্যে নাকি রোগীকে ভেন্টিলেশনে দিতে হত। কিন্তু বিজ্ঞান অন্য কথা বলছে। যে যন্ত্রের সাহায্যে কৃত্রিম ভাবে শ্বাস নেওয়া যায় তারই ডাক্তারি নাম ভেন্টিলেটর। ফুসফুসের সংক্রমণ, দূর্ঘটনা বা অন্য কোনও গুরুতর শারীরিক অবস্থায় মানুষের স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নেবার ক্ষমতা কমতে থাকে। এই অবস্থা চলতে থাকলে শরীরে অক্সিজেন কমে যায় ও কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বেড়ে যায়। ফলে রোগীর অবস্থা আরও জটিল হয়ে ওঠে। এই সময়ে রোগীর জীবন বাঁচাতে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস প্রশ্বাস চালু রাখতে হয়।
মূলত পোলিও আক্রান্তদের প্রাণ বাঁচাতে এই জীবনদায়ী মেশিন আবিষ্কার করা হয়। ১৯২৮ – ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পোলিও আক্রান্তদের মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি। ১৯২৮ সালে বস্টনের স্কুল অফ পাবলিক হেলথের চিকিৎসক ফিলিপ ড্রিঙ্কার ও ল্যুইস অ্যাগাসিস নামে দুজন চিকিৎসক আয়রন লাংস নামে প্রথম মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর আবিষ্কার করেন। এর অনেক পরে ১৯৫২ সালে কোপেনহেগেনে পোলিওর মহামারি শুরু হয়। সেখানকার ব্লেগদাম হাসপাতালে পোলিও আক্রান্তদের মধ্যে ৮৭% মারা যাচ্ছিলেন শ্বাসনালীর পেশি অকেজো হয়ে। সেই সময় ইয়ন ইবসেন নামে এক অ্যানেস্থেশিয়ার চিকিৎসক আধুনিক ভেন্টিলেটর তৈরি করেন ১৯৫২ সালের আগস্ট মাসে। নিজের উদ্যোগে বানানো সেই ভেন্টিলেটর ব্যবহার করে এক বছরের মধ্যেই পোলিওতে মৃত্যুহার নেমে আসে ১১% এ। তারপর প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এসেছে এখনকার অত্যাধুনিক ভেন্টিলেটর। এর সাহায্যে অজস্র মুমূর্ষ মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
নানান গুরুতর রোগের কারণে যখন মানুষ এতোটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে নিজে শ্বাস নেবার ক্ষমতা চলে যায় তখনই ভেন্টিলেটরের সাহায্য নেওয়া হয়। এর সাহায্যে সাময়িক ভাবে পরিস্থিতির সামাল দিলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। রোড ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্টে গুরুতর আহত হলে, নিউমোনিয়া, সিওপিডি সহ বিভিন্ন ফুসফুসের অসুখ হলে, সেপ্টিসিমিয়ার মত সাঙ্ঘাতিক কোনও ইনফেকশন হয়ে রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়লে, সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেন স্ট্রোক হলে, বিষাক্ত সাপে কামড়ালে, জটিল কোনও অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর অবস্থা সামাল দিতে ভেন্টিলেটরের সাহায্য নিতে হতে পারে। মোদ্দা কথা শরীরে যখন অক্সিজেনের মাত্রা খুব কমে যায় একই সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, তখনই ভেন্টিলেটরের সাহায্যের দরকার হয়। গুলেনবেরি সিন্ড্রোমের মত কিছু অসুখে যখন শরীরের মাংস পেশি অত্যধিক দূর্বল হয়ে যাবার জন্যে নিশ্বাস নেবার ক্ষমতা চলে যায় সেই সময়েও কৃত্রিম ভাবে শ্বাস চালু রাখার জন্যে ভেন্টিলেটরের সাহায্য নিতে হয়।
মুমূর্ষ মানুষকে জীবন ফিরিয়ে দিতেই ভেন্টিলেটরের সাহায্য নেওয়া হয়। কখনও কখনও সাময়িক ভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে ভেন্টিলেটরের সাহায্য নেওয়া হয়। আবার অনেক সময় বছরের পর বছর ভেন্টিলেটরে রাখতে হতে পারে (যেমন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী)। বেশিরভাগ মানুষের মনে এই প্রশ্ন ওঠে যে এই কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সাহায্য নিলে রোগীর ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটা। রোগী ভেন্টিলেটর থেকে সুস্থ হয়ে বেরিয়ে আসতে পারবেন কীনা তা নির্ভর করে মানুষটির সার্বিক শারীরিক অবস্থার ওপর। অনেক ক্ষেত্রেই রোগী ভালো হয়ে ওঠেন। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে না। ভেন্টিলেটরে রোগীকে রেখে চিকিৎসা করার সময় জীবনদায়ী ওষুধ সহ একাধিকবার নানান টেস্ট করানোর প্রয়োজন হয়। ব্যাপারটা যথেষ্ট খরচ সাপেক্ষ। তাই রোগীর নিকটজনের সম্মতি নিয়ে তবেই রোগীকে ভেন্টিলেটরে দেওয়া হয়। খরচের ধাক্কা সামলাতে না পারলে ভেন্টিলেটর থেকে রোগীকে বার করে দিতে অনুরোধ করেন। ইচ্ছে হলেই রোগীকে ভেন্টিলেটর থেকে বাইরে আনা যায় না। রোগী সুস্থ হলে কিংবা মারা গেলে তবেই তাঁর এই জীবনদায়ী মেশিন খুলে দেওয়া যায়, এটাই আইন। তবে একটা ব্যাপার জেনে রাখা উচিত মানুষ মারা যাবার পর তাকে ভেন্টিলেটরে রেখে বিল বাড়ানোর গল্পটা একেবারে মনগড়া। কেননা ভেন্টিলেটর শুধুমাত্র শ্বাস প্রশ্বাস চালু রাখতে পারে। মানুষ মারা গেলে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক চিকিৎসার সাহায্য নিন, ভাল থাকুন।