রাইপুরের চাঁদুডাঙ্গা গ্রামে মা মহামায়া মন্দির নির্মাণে ১২ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবী শক্তিপদ মহাপাত্র।

Spread the love

রাইপুরের চাঁদুডাঙ্গা গ্রামে মা মহামায়া মন্দির নির্মাণে ১২ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবী শক্তিপদ মহাপাত্র।


সাধন মন্ডল বাঁকুড়া:—-রাইপুরের চাঁন্দুডাঙ্গা গ্রামে মা মহামায়া মন্দির নির্মাণ কমিটির উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে একটি সুবিশাল সুদৃশ্য মাতৃমন্দির যা বাঁকুড়া জেলার ইতিহাসে একটি বিশেষ স্বাক্ষর বহন করবে। যা দেখতে হাজার হাজার দর্শনার্থী সারা বছর ধরেই রাইপুরের চাঁন্দুডাঙ্গা গ্রামে হাজির হবেন। মন্দির নবরূপে এই মন্দির উদ্বোধন করা হবে ২০২৫ সালের ৩১ শে জানুয়ারি অর্থাৎ ১৬ই মাঘ বুধবার মন্দির নির্মাণ কমিটির ইচ্ছা ওই দিন অস্থায়ী মন্দির থেকে দেবী মা মহামায়া কে নবনির্মিত সুদৃশ্য মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হবে। তার তোড়জোড় চলছে জোর কদমে। মা মহামায়া মন্দির নির্মাণ কমিটি আজ থেকে পাঁচ বছর আগে নতুন মন্দির তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং কাজ শুরু করেন। সেই কাজ চলছে জোর কদমে। আর্থিক কারণে মাঝেমধ্যে থমকে থাকলেও মায়ের অশেষ করুণায় ও কৃপায় বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান ,কলকাতা শহর রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা তাদের সাধ্যমত টাকা সাহায্য করে চলেছেন। মন্দির কমিটির পক্ষে একটি ঘোষণা করা হয়েছিল সমাজ মাধ্যম সহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে যে মন্দির নির্মাণে যিনি ১৫ লক্ষ টাকা সাহায্য করবেন বা সর্বোচ্চ পরিমাণ টাকা দান করবেন তার হাত ধরে ই নবনির্মিত মন্দির এর দ্বারোদঘাটন করা হবে। মন্দির নির্মাণ কমিটির মূল উদ্যোক্তা তথা সম্পাদক বিশিষ্ট শিক্ষক বীরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন আমরা ঘোষণা করেছি আমাদের এই ঘোষণায় বা মন্দির নির্মাণে স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে যিনি এগিয়ে আসবেন তার জন্য নির্ধারিত সময় নবমীর সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ।ঘোষণা অনুযায়ী সারেঙ্গা ব্লকের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সু হৃদয় পরোপকারী রাইপুর বাজারের বিশিষ্ট আলু ব্যবসায়ী তথা আলু ব্যবসায়ী সমিতির কর্মকর্তা শক্তিপদ মহাপাত্র ১২ লক্ষ দিয়ে টাকা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই শক্তিপদ মহাপাত্র বাবুকে। এই প্রসঙ্গে এলাকার বিশিষ্ট আলু ব্যবসায়ী শক্তিপদ মহাপাত্র এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন অষ্টমীর দিন মায়ের পুজো দিতে মহামায়া মন্দিরে গিয়েছিলাম পুজো দিয়ে প্রসাদ গ্রহণ করে বাড়িতে এসে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হঠাৎ স্বপ্নে দেখি এক মাতৃ মূর্তি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলছেন ওরে শক্তি, আর ঘুমিয়ে থাকিস না এবার আমার মন্দিরের কাজ সম্পন্ন কর। আমি আর অস্থায়ী মন্দিরে থাকতে পারছি না আমাকে মূল মন্দিরে নিয়ে চল। আমি তোর হাতেই মন্দিরের উদ্বোধন করাতে চাই, আমার ইচ্ছে পূরণ কর এরপর আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমি দেখি নারীর এক ছায়ামূর্তি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন ঘরে অপূর্ব এক গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মা ও সহধর্মিনী এবং মেয়েদের কাছে স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করি সকলেই আমাকে বলে তুমি আর দেরি করো না মন্দিরে গিয়ে মন্দির নির্মাণ কমিটির কর্মকর্তাদের কাছে তোমার মনের কথা খুলে বলো। আমি আর দেরি না করে ছুটে যাই মন্দির নির্মাণ কমিটির কার্যালয়ে গিয়ে দেখি বীরেন বাবু বসে রয়েছেন ।কোথায় পাব এত টাকা কিভাবে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে নির্ধারিত দিনে মাকে নতুন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে পারবো তো ? এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে বীরেন বাবু চোখ মুজে বসে ছিলেন কাছে গিয়ে ডাকতেই আমাকে দেখেই তিনি যেন চমকে উঠলেন বললেন এই তো পুজো দিয়ে গেলেন আবার ছুটে এলেন যে ? আবেগ ধরে রাখতে পারিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আমার মনের কথা খুলে বললাম বীরেন বাবুকে তিনিও আবেগে আপ্লুত হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন সবই মায়ের ইচ্ছা । পরে নবমীর দিন সন্ধ্যা সাতটার পরে বীরেন বাবু এই ভক্তের নাম প্রকাশ করলেন এবং বললেন নির্ধারিত দিনেই মাকে আমরা নতুন মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করব মন্দিরের দ্বার উদঘাটন করবেন শক্তিপদ বাবু। এদিন এই উপলক্ষে সন্ধ্যায় এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে শক্তিপদবাবু ,তার মা সহ তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে মায়ের কাছে শক্তিপবাবু মঙ্গল কামনা করে তার হাতে পুষ্পস্তবক তুলে দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হয়। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শক্তি বাবুর মা শ্রীমত্যা জলধর মহাপাত্র সহ তার সহধর্মিনী ও দুই মেয়ে । এই প্রসঙ্গে মন্দির কমিটির সম্পাদক তথা বিশিষ্ট উদ্যোক্তা শিক্ষক বীরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন শক্তি বাবু একজন একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ, মন্দির নির্মাণ কমিটির একজন সদস্য হয়ে তার কর্তব্যের তাগিদে মায়ের ইচ্ছায় তিনি ১২ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহায্যের হাতে বাড়িয়ে দিলেন। আমি সহ মন্দির নির্মাণ কমিটির সকলেই অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। শক্তিপদ বাবু আরো বলেন আজ থেকে ৪০ বছর আগে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি, বাবার স্মৃতি কে বাঁচিয়ে রাখতে চাই এইভাবে সমাজসেবার মধ্য দিয়ে। এখানে উল্লেখ্য মা মহামায়া মন্দির নির্মাণে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে সাত কোটি টাকা। অনেকটা টাকা উঠে আসলেও এখনো কাজ সম্পূর্ণ হতে অনেক বাকি সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন মন্দির নির্মাণ কমিটি।।
রাইপুরের চাঁন্দুডাঙ্গা গ্রামের মা মহামায়ার কিছু ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের একটু পিছিয়ে আসতে হয়।পূর্বে রাইপুরের চাঁন্দুডাঙ্গা গ্রামের দেবী মহামায়া ছাড়া আশেপাশের অন্য কোন গ্রামে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল না।দেবী মহামায়া ছিলেন রাজবংশের কুলদেবী। মহামায়া মন্দিরের দুর্গা পুজোই ছিল এলাকার শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র পুজো যা দেখতে হাজার হাজার মানুষ পুজোর দিনগুলিতে ভিড় করতেন চাঁন্দুডাঙ্গা গ্রামে মন্দির প্রাঙ্গনে।
দেবী মহামায়া কোকোমুখা।কোকামুখো দেবী মহামায়া প্রকৃতপক্ষে দ্রাবিড়ীয় দুর্গামূর্তি।নেকড়ে মুখো দেবী ষড়ভূজা।দু হাতে একটা হাতিকে(করিন্দাসুর)মর্দন করে বধ করছেন।মূর্তির উচ্চতা আড়াই ফুট।মূর্তির দক্ষিণ পাশে তুঙ্গভুদ্রা ও বামে সর্বমঙ্গলা বিরাজ করছেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায় মল্লরাজাদের অধীনস্থ ছিল রাইপুর। বিষ্ণুপুরের রাজা বীরসিংহের ভাই ধরম সিংহ সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজত্ব করতে রাইপুরে আসেন। কথিত আছে তাঁর রাজত্ব কালে রাজা ধরম সিংহের পুত্র রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ স্বপ্নাদেশ পান দেবী মহামায়ার। তিনি মহামায়াকে উদ্ধার করেন।পরবর্তীকালে একটি খড়ের চালা তৈরি করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
   রাজা রাজেন্দ্র চোল কোন কারণে মূর্তিটি ছেড়ে চলে যান।পরবর্তীকালে রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র সিংহ মূর্তিটি খুঁজে পান এবং পূজা করতে শুরু করেন।রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র সিংহের দুই পুত্র দুর্জন সিংহ এবং ফতে সিংহ ছিলেন বিট্রিশ বিরোধী চূয়াড় বিদ্রোহের নেতা।কথিত আছে দুর্জন সিংহের রাজত্বের সময়কাল পর্যন্ত দেবীর মন্দিরে নরবলি দেওয়া হতো।দুর্জন সিংহের সময় নরবলির জন্য ব্যবহৃত খড়্গ দিয়ে আজও ছাগ বলি হয় দেবীর থানে।ফতে সিংহের সময় নরবলি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে একটি ছাগ, এক গুচ্ছ আঁখ ও চাল কুমড়ো বলি দেওয়া হয়
জানা যায় দেবী মহামায়ার পুজোর সময় রাজা দুর্জন সিংহ হাত কামান ব্যবহার করতেন। এই কামানের তোপধ্বনির শব্দ শুনে আগে এলাকার অন্যান্য পুজো গুলিতে সন্ধি পুজো শুরু হতো।
মহামায়ার মন্দির প্রাঙ্গনের কাছেই রয়েছে পবিত্র জলাশয় (আলম সায়ের।)কথিত আছে এই পুকুর পাড়েই মানবীরূপ ধারণ করে মা মহামায়া বিষ্ণুপুরের চিনু শাঁখারীর নিকট শাঁখা পরেছিলেন।শাঁখারী শাখার দাম খুঁজলে দেবী মন্দিরের পুরোহিত কালাচাঁদ সন্যাসীর কন্যা বলে নিজেকে পরিচয় দিয়ে বলেন কুলঙ্গির ভাঁড়ে পয়সা আছে সেখান থেকে যেন পিতা শাঁখারীকে পয়সা দিয়ে দেন।আশি বছর বয়স্ক কালাচাঁদ বিশ্বাস করেন না শাঁখারীর কথা তিনি পয়সা দিতে অস্বীকার করেন তিনি শাঁখারীকে বলেন আমি সন্ন্যাসী মানুষ আমার কোন সন্তান নেই। তখন শাঁখারী তাকে পুকুরপাড়ে নিয়ে যান  পুকুর পাড়ে গেলে দেবী মহামায়া তাঁর শাঁখা পরা দুটি হাত জল থেকে তুলে দেখান। দুজনেই আশ্চর্য হয়ে যান পরে বাড়ি ফিরে এসে দেখেন কুলুঙ্গিতে পয়সা রাখা আছে
  সেই থেকে ওই শাঁখারীর বংশধরেরা প্রতিবছর মা মহামায়াকে ছয়টি শাঁখা, পাঁচটি ষোল আনা এবং একটি আলতা পেড়ে কাপড় দিয়ে যান।
 প্রাচীন রীতি মেনে কৃষ্ণানবমীর দিন থেকে মা মহামায়ার পুজোর সূচনা হয় মহামায়া মন্দিরে ও রাজবাড়িতে।এই রাজবাড়ির পুজো প্রায় ৩৪০ বছরের প্রাচীন।পুজোর সময় ষষ্ঠীর দিন রাইপুরের হরিহরগঞ্জগড় রাজবাড়ি থেকে রাজলক্ষীকে শোভাযাত্রা সহকারে নিয়ে যাওয়া হয় রাইপুরের চাঁদুডাঙ্গায় অবস্থিত মহামায়ার মন্দিরে। পঞ্জিকা মতে দেবী দুর্গার আগমন এবং প্রত্যাগমন হয় যে যানে অনুরূপ যানে রাজলক্ষীকে নিয়ে আসা হয় মহামায়ার মন্দিরে।সেখানে মহামায়ার ডানপাশে পুজোর চারদিন থাকেন রাজলক্ষী। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার সঙ্গে রাজলক্ষী পূজিত হন।  হরিহর গঞ্জগড় রাজবাড়ির শ্যামসুন্দরজিউ মন্দির থেকে মহামায়ার মন্দির পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ শোভাযাত্রা সহকারে রাজলক্ষীকে নিয়ে যাওয়া হয়।শোভাযাত্রায় হরিনাম সংকীর্তন এর দল, শঙ্খ, ঘন্টা ঢাক,বল্লম,মশাল, দুটি বড় ছাতা পাখা ও বলি দেওয়ার  খড়গ এবং রাজআমলের বিভিন্ন সামগ্রী।বিজয়ার দিন শোভাযাত্রা সহকারে ফের রাজলক্ষীকে ফিরিয়ে আনা হয় হরিহরগঞ্জ গড়ের রাজবাড়িতে। কয়েক বছর আগেও রাজলক্ষ্মীর আসা যাওয়ার পথে রাইপুর বাজারে দীর্ঘক্ষণ ধরে মাকে দাঁড় করিয়ে রেখে বাজি ফাটানোর রেওয়াজ ছিল বর্তমানে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে গেছে।
 সন্ধিপূজার সময় যে ছাগবলি হয় তা রাজবাড়ির অন্দরমহলে নিয়ে গিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। বলে জানা যায়। বর্তমান রাজা গোপীনাথ সিংহ দেও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলেন এই রাজবাড়ীর অনেক ভূমিকা রয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনে কিন্তু আমরা উপেক্ষিতই রয়ে গেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *