শুধু পথে প্রতিবাদ নয়, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশই অপরাধ প্রবণতা কমানোর উপায়
খুনের সাজা ফাঁসি। চরম পরিণতির কথা জেনেও অপরাধপ্রবণ মন খুন করে। কিন্তু অপরাধ করা কি অতই সোজা? হত্যার সময় হাত কাঁপে না খুনির? কথিত আছে, ক্রিশ্চিন চ্যাপেলে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা দ্য লাস্ট সাপার ছবিতে যিশু ও জুডাসকে আঁকা হয়েছিল একই ব্যক্তিকে দেখে। শোনা যায় নিষ্পাপ বালক, যাকে দেখে যিশুর ছবি আঁকা হয়েছিল, কালক্রমে জঘন্যতম অপরাধী হয়ে ওঠা সেই ব্যক্তিকেই যুডাসের মডেল করেছিলেন দ্য ভিঞ্চি। কেন অপরাধী হয়ে উঠেছিল সেই বালক? কলকাতায় সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কয়েকটি স্কুলের ছোটো ছেলে মেয়েদের মধ্যে সমীক্ষা করে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন এসএসকেএম হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট স্পিচ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোহাঃ শাহীদুল আরেফিন। তাঁর কথায়, “সমীক্ষা করে দেখেছি ১৮ শতাংশ পড়ুয়ার মধ্যে এগ্রেসিভ ট্রেইটস দেখা গিয়েছে।
তিনি বলেন, শিশুর অনেক শারীরিক ও মানসিক বিকাশগত সমস্যা বাইরে থেকে বোঝা যায়না, তাই যথা সময়ে চিকিৎসা না হলে পরবর্তী সময়ে এদের মধ্যেই সমাজে অপরাধ করার প্রবণতা দেখা যায়, তাছাড়া অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও আমরা দেখেছি। আমাদের মনে হয়েছে, স্কুল থেকেই উপযুক্ত শারীরিক ও মানসিক মূল্যায়ন ও চিকিৎসা বা কাউন্সিলং করা হলে এই সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা সম্ভব।”
নেচার ও নার্চার, প্রথমটা আসে জিন থেকে, এটি জন্মগত। পরেরটি আসে পরিবেশ থেকে।
আর জি কর হাসপাতালের ঘটনায় যখন সারা রাজ্য তো বটেই, দেশ পথে নেমে প্রতিবাদ করছে, তখন সমাধানের উপায় বলছেন ড. আরেফিন। আর জি করের ঘটনায় তিনি গভীর দু:খ প্রকাশ করেন। সঙ্গে তিনি জানান, এই রাজ্যের কিছু বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গবেষণা করে সমাজের প্রান্তিক শিশুদের নিয়ে। এইসব শিশুদের একাংশ আবার পরিবারের মধ্যে প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি যারা স্কুলে যাচ্ছে। আর পাঁচজনের মতো এইসব শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের যাতে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হতে পারে সেই জন্য তাদের মন বোঝার চেষ্টা করা হয় সমীক্ষায়। দেখা যায় ছোট থেকেই অনেকের মনে হিংসা ও প্রতিহিংসা পরায়ণতা দানা বাঁধতে থাকে শৈশব থেকেই। অবরাধ প্রবণতা নষ্ট করার জন্য তখন থেকেই কাউন্সিলিং বা চিকিৎসা করার প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. আরেফিন। তিনি জানিয়েছেন, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় ২০১৮ সালে হালতুর একটি বিদ্যালয়ে করা সমীক্ষা তাঁরা কলকাতায় স্কুল পরির্শকের অফিসে জমা দিয়ে এই ব্যাপারে আর্জিও জানিয়েছিলেন স্কুলে নিয়মিত বাচ্ছাদের কাউন্সেলিং করার জন্যে। তিনি বলেন, “আমাদের পুরো টিমের মূল উদ্দেশ্যই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পর্যালোচনা করা। আমরা যাদের নিয়ে সমীক্ষা করেছিলাম তাদের বেশিরভাগই অপুষ্টির শিকার ছিল যদিও তারা মিডডে মিল পেত। তবে শারীরিক স্বাস্থ্য তেমন ভালো ছিল না। মানসিক স্বাস্থ্যেও তার প্রভাব পড়েছিল। এরা সকলেই পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণীর পড়ুয়া ছিল।” তাঁরা এই কাজ ২০১৮ সালে করলেও এখন নতুন করে তাঁদের সুপারিশ কার্যকর করার সময় হয়েছে বলে মনে করেন মোহাঃ শাহীদুল আরেফিন।
মায়ের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়াও জরুরি বলে তাঁরা দেখেছেন, কারণ শিশুর প্রাথমিক দেখভালের দায়িত্ব থাকে মায়ের কাঁধেই।। সংসারের বোঝা টানতে গিয়ে এইসব মায়েদের অধিকাংশই অবসাদে ভোগেন। তাঁদের শরীর ও মনের প্রভাব পড়ে শিশুর উপরেও। সমস্যায় জর্জরিত মায়ের উদ্বেগের ছায়া পড়ে সন্তানের উপরেও।
মায়ের বা পরিবারের কষ্ট লাঘব করতে বাচ্ছারাও ছোটো থেকে অনেক সময় বিপথগামী হতে পারে। তাই মায়েদের কাউন্সিলিং করা ও তাঁদের উদ্বেগ দূর করাও প্রয়োজন বলে সমীক্ষায় দেখা গেছে।