শ্রমিক কল্যাণে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন ড : পরিমল কান্তি মন্ডল।

Spread the love

শ্রমিক কল্যাণে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন ড : পরিমল কান্তি মন্ডল।

কলমে: অভিজিৎ ভট্টাচার্য।
১৯৮১ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর হাড়োয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম সোনাপুকুরে জন্ম নিয়ে ওই গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ।পরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বসিরহাট কলেজ থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সের স্নাতক হয়ে এল এল বি ডিগ্রি লাভ করেন।স্কুল লাইফ থেকেই পরের উপকারের জন্য ব্যস্ত হয়ে যেতেন। টিফিন ভাগ করে খাওয়া, হাত খরচের পয়সা বাঁচিয়ে গরীব ছাত্রদের খাতা বই দেওয়া। কলেজ লাইফে নিজের টিউশনের টাকায় অনেক ছাত্র ছাত্রী দের পড়াশোনার খরচ চালানো, দূ:স্থ অসহায় দের সাহায্য করা, ইভটিজার দের থেকে নারীদের রক্ষা করা এগুলো তার সহজাত প্রবৃত্তিতে পরিনত হয়ে গেছে। ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হয়ে অনেক ছেলে মেয়েদের নিয়ে বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় আর্ত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে কোথাও উদ্ধার কার্যে নেমে পড়েছেন।আবার কোথাও খাদ্য সামগ্রী,ওষুধ, হাঁস,মুরগী, ছাগল বিতরণ করেছেন। জনসেবার জন্য আশ্রয় নামে একটি এন জি ও প্রতিষ্ঠা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি আইলার বিদ্ধংসী ঝড়ে। একদিন তো কিছু মানুষকে একটা দ্বীপ থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই তলিয়ে যাচ্ছিলেন। অনেক্ষন একটি পোস্ট ধরে কোন রকমে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গেছেন। পরে উদ্ধারকারী টিম এসে তাকে উদ্ধার করে।নেপালের বিদ্ধংসী ভূমিকম্পতেও পরিমল বাবুর টিম কোলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বিগ বাজার ও গুঞ্জনের মাধ্যমে দু ট্রাক ভর্তি ড্রাই ফুড,ওষুধ, নতুন জামা কাপড় ইত্যাদি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরবর্তী কালে তিনি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাথে যুক্ত হন।
রেলের মাল গোদাম শ্রমিক দের দূর্দশা আর বঞ্চনা দেখে তিনি ব্যথিত হয়ে পড়েন।সেই ব্রিটিশ শাসন কাল থেকে এই শ্রমিকরা বঞ্চিত নিপীড়িত। প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় পরে থাকা। না ছিল খবার জল,না কোন শৌচালয়, বিশ্রামাগার। প্রচন্ড গরমে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এরা মাল গাড়ির নিচে স্লিপার এ শুয়ে বিশ্রাম নিত।ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত এই শ্রমিকদের প্রতিবাদ করার অধিকার নেই। যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণ কাজ করতে হবে। নেই কোন ই এস আই সি,ই পিএফ,ইন্সুইরেন্স, মেডিকেল বেনিফিট, ছুটি। এযেন এক দাসত্যের জীবন। অথচ সরকার এই কাজের জন্য যথেষ্ট ভালো মজুরি দিয়ে থাকেন। তবে সেটা কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে, আর এই কন্ট্রাক্টর রাই এই শ্রমিকদের বঞ্চিত করে রাখেন।ভারতীয় রেলওয়ে মাল গোদাম শ্রমিক ইউনিয়নের ( BRMGSU) ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা করে সারা ভারতের প্রায় ১০ লাখ শ্রমিকের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষ লড়াই শুরু করে ছিলেন। এর মধ্যেই দিল্লির সক্রেটিস সোসাল রিসার্চ ইউনিভার্সিটি পরিমল কান্তি মন্ডল মহাশয় কে সোসাল সার্ভিসের জন্য ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে সন্মানিত করেন।
এর পর তিনি আর পিছনে ফিরে তাকান নি।চালিয়ে গেছেন শুধু লড়াই আর লড়াই। বাড়ি ঘর সংসার ফেলে রেখে দিল্লিতে পড়ে থেকে এই ১০ লাখ মাল গোদাম শ্রমিক দের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেবার এক আমরন পন করে বসলেন।ছুটে বেড়িয়েছেন এম পি থেকে মন্ত্রী, নেতা থেকে আমলা সবার দুয়ারে দুয়ারে । যোগার করলেন ৭৪ জন সাংসদ ও মন্ত্রীর লিখিত সমর্থন। বার বার ছুটে গেছেন রেল মন্ত্রী ও শ্রম মন্ত্রীর দরবারে ১৪ দফা দাবি নিয়ে।
অবশেষে শ্রম মন্ত্রণালয় এই মাল গোদাম শ্রমিক দের জন্য ই শ্রম পোর্টালে গোদাম শ্রমিক দের জন্য আলাদা পোর্টাল খুলে দিলেন।
রেল মন্ত্রণালয় এক বিশেষ অর্ডার জারি করে সমস্থ জি এম এবং ডি আর এম দের নির্দেশ দেন অতি শীঘ্র ই সমস্থ রেলের মাল গোদামে হাইজিনিক বাতাবরণ তৈরি করা, পানীয় জল, টয়লেট, শৌচাগার, বিশ্রামাগার তৈরি করার জন্য।
আর শ্রম মন্ত্রীর নির্দেশনায় ভারতের চিফ লেবার কমিশনার দেশের সকল ডেপুটি চিফ লেবার কমিশনার এবং রিজিওনাল চিফ লেবার কমিশনার দের নির্দেশ দেন যত শীঘ্র সম্ভব এই রেলের মাল গোদাম গুলো ভেরিফিকেসন করে রিপোর্ট পেশ করতে। গত ১৪ ই জুন নিউ দিল্লির এন ডি এম সি সিটি সেন্টারে সারা দেশের এই মাল গোদাম শ্রমিক দের নিয়ে যে ” শ্রম মন্থন পোগ্রাম হয়েছিল সেখানে সবার উপস্থিতিতে, রিপোর্টারদের উপস্থিতিতে বলেন। “এই ভেরিফিকেসন রিপোর্ট আসার সাথে সাথেই আমি কড়া পদক্ষেপ নিয়ে মাল গোদাম শ্রমিক দের বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করবো।”আর খুব দ্রুতই এই কাজ চালু হয়ে গেছে। এই ১০লাখ মানুষের লাঞ্চনা বঞ্চনার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ড: মন্ডল কিন্তু এতেও থেমে নেই। এখন তিনি চাইছেন শুধু মাল গোদাম শ্রমিক নয়,সারা ভারতের প্রায় ৬৫ কোটি মানুষ অসংঘটিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। মালিক পক্ষ এদের ও নানা ভাবে বঞ্চনা করে থাকে। মিস্ত্রি ও সহযোগী মিস্ত্রি, পরিচালক বা পরিচালিকা, হকার,কৃষি শ্রমিক, ক্যাটারিং বা চুক্তি ভিত্তিক কর্মী, অন্যান্য অসংগঠিত কর্মী। এদের ন্যায্য অধিকার এবং ই-শ্রম কার্ডের মাধ্যমে সরকারি সুবিধা গুলো পাইয়ে দেবার জন্য তিনি উঠে পরে লেগেছেন।
ভারত সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে ড: মন্ডল বেশ কিছু সন্মানীয় পোস্ট পেয়েছেন। রেল মন্ত্রণালয় থেকে যেড আর ইউ সি সি মেম্বার। কনজিউমার এফেয়ার ফুড ও ডিস্ট্রিবিউসন থেকে এস এল সি সি।টেলিকম মন্ত্রণালয় থেকে টি এ সি মেম্বার। দিল্লি প্রোডাক্টিভিটি কাউন্সিল এ যুগ্ম সম্পাদক হয়েছেন।
এত লড়াইয়ের মধ্যে ও ড: পরিমল কান্তি মন্ডল কবিতা ও সাহিত্যে নিজের কলম চালিয়ে গেছেন। যেখানেই দেখেছেন শ্রমিকদের বঞ্চনা,নারীর অপমান,দূর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার তাঁর কলম শানিত হয়েছে। গত কলকাতা বই মেলায় পরিমল বাবুর লেখা একটি কবিতার বই ” জীবনের সহজ পাঠের ইতিকথা ” ছায়া প্রকাশনির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
ড: পরিমল কান্তি মন্ডল বলেন, ” এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি যখন যেতেও হবে একদিন। নিজের জন্য তো সবাই অনেক কিছু করে, কিন্তু মানুষের উপকারের জন্য যদি কিছু করে যেতে গিয়ে মৃত্যুবরন ও করতে হয় তার জন্য ভয় করিনা।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *