সফলতার বিপ্লব

Spread the love

সফলতার বিপ্লব

শম্পা মহান্তি (কলকাতা)

   'তোমার মনে কি লাগেনা আমাদের স্ত্রীলোকেরা এত অল্প বয়সে বিবাহ করে যখন বিবাহ কি তাহারা জানে না,ও আপনার মনে স্বাধীনভাবে করিতে পারে না। তোমার বিবাহ তো তোমার হয় নাই,তাহাকে কন্যাদান বলে। তোমার পিতা কেবল তোমাকে দান করিয়াছে। আমরা স্বাধীনতাপূর্বক বিবাহ করিতে পারি নাই। আমাদের পিতামাতারা বিবাহ দিয়াছিলেন। তুমি যে পর্যন্ত বয়স্ক, শিক্ষিত ও সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে, সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে প্রবেশ করিব না।'

 ...উক্ত কথাগুলি চিঠিতে লিখে ছিলেন প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস.অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর  তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে। সেই সময়ে জ্ঞানদানন্দিনীর বয়স ছিল সাত বছর।

    স্বামীর থেকে পাওয়া এসব কথা হয়তো গুরুগম্ভীর লেগেছিলো ওই ছোট্ট মেয়েটির। কথাগুলো কি ভাবে, কি চেতনার সৃষ্টি করতো, একটা সাত বছর বয়সী মেয়ের মনে, জানা নেই। একগলা ঘোমটার নীচে তার কাজলটানা চোখের ভয়,উদ্বেগ,কৌতূহল বা প্রশ্নের রেখা দেখা যেতো না।

    কখন তাঁর স্বামী লিখেছিলেন,' এখানে জনসমাজে যাহা কিছু সৌভাগ্য, যাহা কিছু উন্নতি, যাহা কিছু সাধু সুন্দর, প্রশংসনীয় -- স্ত্রীলোকদের সৌভাগ্যই তাহার মূল।.... আমার ইচ্ছা তুমি আমাদের স্ত্রীলোকের দৃষ্টান্তস্বরূপ হইবে কিন্তু তোমার আপনার উপরই তাহার অনেক নির্ভর।'

  ...এমন উন্নত দার্শনিক, মনোসামাজিক ও বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটের চিন্তাভাবনা তৎকালীন সমাজের এক পুরুষ যিনি শুধুমাত্র মুখে বলেন নি,বরং তিনি মনেপ্রাণে চেয়ে ছিলেন তাঁর বালিকা বধূকে সেই পর্যায়ে উন্নত করে, সমাজের বুকে দৃষ্টান্ত টানতে; এবং অন্যান্য নারীদের সেই পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।

  কতোটা লাঞ্ছনা খারাপ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিল জ্ঞানদানন্দিনীকে সেই সময়ে। কিন্তু স্বামীর একনিষ্ঠ প্রগতিশীল চিন্তাধারা দৃঢ়তা, তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। অনেকের কাছেই মনে হবে এ কাজ এমন কি?

একটু একটু করে নিজের পা কে তিনি অগ্রসর করেছিলেন স্বামীর দেখানো পথে। একটা সময় সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন কর্মসূত্রে মহারাষ্ট্রেযাবেন তখন তিনি তার স্ত্রীকেও তার কর্মস্থলের নিয়ে যাওয়ার জন্য ঠাকুরবাড়িতে আবেদন জানিয়েছিলেন। ভাবা যায়।…. সেই সময়, যে সময়ে বাড়ির অন্দরমহল থেকে বের হতো না মহিলারা। কতো মহিলাদের জীবন অন্যের সেবা সুশ্রূষা,সন্তান-সন্ততির প্রসব,এর মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে সমাপ্তি হতো। তাঁদের কথা মনুষ্যসমাজ প্রকৃতি ও জানতে পারতো না।

বহির্জগতের মানেই হল বাড়ির অন্দরমহলের ঐতিহ্য নষ্ট হয়ে যাওয়া। তেমন রীতিতে কুঠারাঘাত এনেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্ত্রীকে নিয়ে যাবেন বোম্বেতে, সেই সময়ের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়েও ভাবতে শুরু করেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখনকার দিনের এক ফরাসি দোকানে অর্ডার দিয়ে জ্ঞানোদানন্দিনীর জন্য বানানো হলো,ওরিয়েন্টাল ড্রেস যা পরতেও সাহায্য করেছিলেন তিনি নিজে। এরপরে বাড়ির বউকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে গাড়িতে তোলা সে তো আর এক বড় বিপ্লবী কান্ড। কারন সেই সময় মেয়েরা বাড়ির বাইরে গাড়ি চড়তে পারতেন না। মেয়েদের একমাত্র যাবার উপায় ছিল পালকি। সেই প্রথার মোকাবিলা করে তিনি নিজের স্ত্রীকে অবশেষে বাড়ির বাইরে বের করে, বোম্বাইগামি জাহাজে চাপাতে সমর্থ্য হয়েছিলেন।

   এসব কথা আজ কেন লিখতে বসেছি তার কারণ, আমরা প্রায়ই বলি একজন সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে। সে নারী যে কেউ যেকোনো রূপে হতে পারে। কিন্তু আমরা এটা বলি না বা খুব কম বলি, একজন সফল নারীর পেছনেও একজন পুরুষের বিরাট বড় ভূমিকা থাকে। আর সেই পুরুষ যদি নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটি হন। তখন সেই মহিলার সাফল্যের শেষ থাকে না। আর যদি সবচেয়ে কাছের মানুষটি লোভী, স্বার্থপর, কুসংস্কারে, আটপৌরে সংকীর্ণ চিন্তাভাবনায় বদ্ধ হন তাহলে, সেই পরিবারের নারীর অগ্রগতি স্থবির হয়ে যায়। 

এখনকার নারী পুরুষেরা স্বাধীন,আধুনিক হয়েছেন, কিন্তু একে অপরের জন্যে প্রগতিশীল হয়েছেন কি সর্বস্তরে ? জীবনের রঙমঞ্চে বেশিরভাগ সকলেই ছুটে চলেছেন নিজের নিজের স্বার্থে। যে চিন্তাধারা রূপরেখা একদা মহর্ষি ঠাকুর পরিবারের হাত ধরে শুরু হয়েছিল,তারপরে সেই নবজাগরণের স্রোত সমাজের বিভিন্ন মনীষীদের সমাজ সংস্কার, শিক্ষা, প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মধ্যে আমরা দেখেছি।

    কিন্তু যে ভারত গড়ার স্বপ্ন, প্রগতিশীল নারী-পুরুষের স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন, বর্তমানে সেই সমাজের সভ্যতার আড়ালেও ঘটে যায় বহু নারী তথা পুরুষ নির্যাতন। নারী তথা পুরুষের নির্যাতন কথাটা এই কারণেই বললাম, কারণ উভয়ের প্রগতিশীল চিন্তায় পরিবার থেকে সমাজ উন্নত হয় আবার উভয়ের সংকীর্ণ,স্বার্থপর, মানসিকতায় রুদ্ধ হয়ে যায় একে অপরের পথচলা!

(ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল গ্রন্থের লেখিকা,সাহিত্যিক,গবেষিকা চিত্রা দেব মহাশয়ার লেখনি সূত্র ধরে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *