সম্প্রীতির অনন্য নজির সীমান্তের নাকুয়াদহে,
হিন্দু-মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাতলো দুর্গোৎসবে
স্টাফ রিপোর্টার, বসিরহাট: সম্প্রীতির রঙে রঙিন নাকুয়াদহ দুর্গোৎসব। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ইটিন্ডা-পানিতর পঞ্চায়েতের নাকুয়াদহ গ্রাম। সীমান্তের জিরো এরিয়া। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ভারী বুটের আওয়াজ, অন্যদিকে দুই দেশের নিরাপত্তারক্ষীদের সতর্ক প্রহরা। বিনোদনের লেশ মাত্র নেই। নাকোয়াদহের ওয়েসিস ক্লাবের ৯০ শতাংশ সদস্য মুসলিম, আর বাকি ১০ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের। এই ভৌগোলিক ও জনসংখ্যাগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও ধর্মের ভেদাভেদকে দূরে সরিয়ে রেখে এ বছর থেকে শুরু হল সম্প্রীতির দুর্গোৎসব। দুই সম্প্রদায়ের মিলিত এই প্রচেষ্টা সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
রবিবার বিকালে উৎসবের শুভ সূচনা করেন বিশিষ্ট সমাজসেবী ও পঞ্চায়েত সমিতির মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ সরিফুল মন্ডল। ছিলেন ক্লাব সম্পাদক পার্থ রায়, বিশিষ্ট খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ উত্তম মন্ডল, ক্লাব সভাপতি বিদ্যুৎ গাজী এবং বিশিষ্ট সদস্য রামিজ মন্ডল, মেহেবুল বিশ্বাস, ক্লাব এছাড়াও ক্যাশিয়ার ফারুক গাজী সহ একাধিক বিশিষ্ট জনেরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যরা, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা, শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ এলাকার অসংখ্য সাধারণ মানুষ। উদ্বোধন মঞ্চে সরিফুল মন্ডল বলেন, “এই পুজো শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এটি মিলন-মেলার প্রতীক। সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। এখানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলে যে একসাথে অংশ নিচ্ছেন, সেটিই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।” স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ জানিয়েছেন, মুসলিম প্রতিবেশীদের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া এই পুজো সম্ভব ছিল না। কেউ অর্থ সাহায্য করেছেন, কেউ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে প্যান্ডেল তৈরি করেছেন, আবার কেউ নিরাপত্তা ও ভিড় সামলাতে এগিয়ে এসেছেন। অপরদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও মনে করছেন, দুর্গোৎসব কেবল হিন্দুদের নয়—এটি গোটা গ্রামবাসীর উৎসব।
আয়োজক কমিটির তরফে জানানো হয়েছে, প্রতি বছরই পুজো আয়োজন হয়, তবে এ বছরের উৎসবে অংশগ্রহণ ও উচ্ছ্বাস অন্য মাত্রা পেয়েছে। ছোট থেকে বড়, সবাই একসাথে মেতে উঠেছেন আনন্দ ভাগাভাগি করার উৎসবে। পূজামণ্ডপে ভক্তি আর ভিড় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে হাসি-আনন্দে ভরা সম্প্রীতির ছবি। গ্রামের প্রবীণরা বলছেন, বহু দশক ধরে নাকুয়াদহতে ধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য বজায় রয়েছে। গ্রামে কোনো উৎসব মানেই সকলের অংশগ্রহণ। ঈদ হোক বা দুর্গাপুজো, প্রতিটি অনুষ্ঠানেই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরের পাশে দাঁড়ান। এই মিলনই গ্রামের প্রকৃত পরিচয়।
উৎসব ঘিরে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে স্থানীয় যুবকেরা দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, উৎসব সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে সবাই একসাথে কাজ করছেন। নাকুয়াদহর দুর্গোৎসব প্রমাণ করছে, সম্প্রীতির শক্তি থাকলে ধর্মীয় ভেদাভেদ দূরে ঠেলে দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। সীমান্তবর্তী এই গ্রাম আজ সারা রাজ্যের কাছে উদাহরণ, যেখানে একসাথে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে দুর্গোৎসব পরিণত হয়েছে মিলনোৎসবে। ক্লাব সম্পাদক পার্থ রায় জানান, আমরা সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাস করি, এখানে বেশিরভাগ মানুষ মুসলিম সম্প্রদায়। এই ক্লাবের পক্ষ থেকেই প্রথম বছর আমরা ওযু করার চিন্তাভাবনা করি। কিন্তু আমার এটাকে সাড়া দিয়ে হিন্দু মুসলিম সবাই মিলে পূজোটা করছে, এটাই সবথেকে আমার আর ভালো লাগছে। আগামী দিন এখানেই ইসলাম ধর্মে কিছু হলে আমরা হিন্দু সম্প্রদায় সবাই একসঙ্গে কাঁদে কাঁধ মিলিয়ে উৎসব করব।