সাংবাদিক – সাহিত্যিক মোশারফ হোসেনের কলমে ‘মাটির গন্ধ মেলে’

Spread the love

সাংবাদিক-সাহিত্যিক ‘মোশারফ হোসেন’-এর কলমে মাটির গন্ধ মেলে

নিজস্ব সংবাদদাতা: সাংবাদিক মোশারফ হোসেন সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। দৈনিক ‘বর্তমান’ পত্রিকার দুঁদে সাংবাদিক হিসেবে সাড়ে তিন দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের বহু এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। বেশ কয়েকবার বিদেশেও পাড়ি দিয়েছেন। একজন প্রাবন্ধিক হিসেবেও তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এরই পাশাপাশি সাহিত্যের অঙ্গনেও তিনি যে সমান সাবলীল তারও প্রমাণ মিলেছে তাঁর বেশ কিছু গল্প, উপন্যাস, কবিতায়। অনেকগুলিই বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর আরও অনেক সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক ও সাময়িক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে পাঠকদের প্রশংসা লাভ করেছে। সেগুলিও বই আকারে প্রকাশের অপেক্ষায়। এই কথাশিল্পীর আঁকা চরিত্রগুলি যেন আমাদের চেনা পরিবেশ থেকেই উঠে আসা নারী-পুরুষ। তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা বেদনা, আবেগ আনন্দ সবই যেন সাধারণ মানুষের হৃদয় ও মননভূমি থেকে আহরণ করা। ছত্রে ছত্রে মাটির গন্ধ। দেশ-বিদেশের পটভূমিতে লেখা তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যেতে পারে।

জন্মভূমিশ্চ (১০০ টা:।। উদার আকাশ প্রকাশন। ঘটকপুকুর।। ডাক: বি গোবিন্দপুর ৭৪৩৫০২।। দ: চব্বিশ পরগনা।। প্রকাশকাল ২০১২)

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হল। পরিবারের অন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলেও পশ্চিমবঙ্গে সাত পুরুষের ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে ছিলেন আব্দুর রহমান। বলেছিলেন, এটা আমার জন্মভূমি। জন্মভূমি ছেড়ে যাব কেন? কিন্তু ৬৪-র কলকাতা দাঙ্গার পর সেই মানুষটিই ঘরবাড়ি, জমিজমা, রমরমা ব্যবসা ছেড়ে স্ত্রী সোফিয়া ও বালকপুত্র আনীশকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি জমালেন ঢাকায়। ধীরে ধীরে সেখানেও পায়ের তলায় মাটি পেলেন। ওই ঘটনার বত্রিশ বছর পর একদিন ঘটনাচক্রে চট্টগ্রামের সমুদ্রসৈকতে আনীশের আলাপ হল কলকাতার এক অধ্যাপক মোতি চৌধুরির সঙ্গে। তারপর? ? দুই বাংলার পটভূমিতে লেখা এক অনবদ্য মর্মস্পর্শী উপন্যাস ‘জন্মভূমিশ্চ’।

পরিবর্তন (প্রথম খণ্ড) (১০০ টা:।। উদার আকাশ প্রকাশন।। ২০১২)

পার্টির নেতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো যে কেউটে সাপের লেজে পা দেওয়ার চেয়েও ভয়ঙ্কর কাজ তা মালুম হতে দেরি হল না।
মাধবদা বললেন, তারপর কী হল জানতে চাইছো? ছিলাম তিরিশ বিঘে জমির মালিক সম্পন্ন গৃহস্থ, হয়ে গেলাম পথের ভিখারি। রোজ সকাল হলে পীরের মাজারের রাস্তায় ভিখ মাগতে বসে যাই। সারাদিনে যা জোটে তাতে দুটো মানুষের কোনওরকমে দিন গুজরান হয়।
নীল জানে, পুলিশ আসলে হাওয়া মোরগের মতো। যার যখন ক্ষমতা, পুলিশ তখন তার পক্ষে ঘুরে যায়।
‘পরিবর্তন’ যেন নিছক একটা উপন্যাস নয়, তা পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ একটি দীর্ঘ অধ্যায়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক দলিল। সময়ের আয়নার ফুটে ওঠা বহু মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। পড়তে পড়তে কখনও বুকের মধ্যে হাহাকার ওঠে, কখনওবা পুঞ্জিভূত হয় ক্ষোভ।

কাঁচপোকার টিপ (১০০ টা:।। উদার আকাশ প্রকাশন।। ২০১৩)

দেশভাগের আবহে ব্যাপক হানাহানির খবরে পূর্ববঙ্গের বহু এলাকা আলোড়িত। প্রথম বিবাহবার্ষিকীর মাত্র কয়েকটা দিন আগে রাতারাতিই শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে প্রায় একবস্ত্রে কলকাতা পালিয়ে এসেছিলেন সোনারগাঁওয়ের তরুণী গৃহবধূ সুরমা। পরিস্থিতির কারণে ওই অশান্ত সময়ে চাঁদপুরের বাসিন্দা বাবা-মা ও একমাত্র ভাইটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। দুই পরিবারে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বাবা-মা ও ভাইয়ের খোঁজে তারপর কতকাল ধরে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। অনেক বছর বাদে ঘটনাচক্রে সুরমার আলাপ হল তরুণ সাংবাদিক মফিজুলের সঙ্গে। তারপর? আবেগে পাঠককে আপ্লুত করে দেওয়ার মতো এক অসামান্য কথাচিত্র ‘কাঁচপোকার টিপ’ উপন্যাস। এই উপন্যাসেরও পটভূমি দুই বাংলা।

মানুষ মাটি মা (১০০ টা:।। উদার আকাশ প্রকাশন।। ২০১৩)

একগুচ্ছ অসাধারণ নিবন্ধের সংকলন। বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিজের বহু নিবন্ধ থেকে বাছাই করা মোট ২৮টি দিয়ে লেখক সাজিয়েছেন এই বইটি। বইয়ে সংকলিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিবন্ধের শিরোনাম: ‘ইমামদের ভাতা নয়, সরকার রাজ্যের মুসলিমদের সামগ্রিক উন্নয়নে উদ্যোগী হোক’। ‘ ভোট ভিখারিদের রকম সকম’। ‘জলের দরে দুধ না খেয়ে দুধের দরে জল খাচ্ছি আমরা’। ‘যারা নিরীহ মানুষকে খুন করে, তারা আর যাই হোক জেহাদি হতে পারে না’। ‘ওরা ভোটের পরে ঘুমিয়ে পড়ে, ফের ভোটের ডাকে জাগে’। ‘মানুষ অনেক কিছু মনে রাখে না বলেই বহু নেতা করেকম্মে খেতে পারছেন’। ‘কর্তা, হাওয়া এবার কোনদিকে? বাবু, হাওয়া এবার চতুর্দিকে’ প্রভৃতি।

ভালোবাসার আঙিনায়(৩০ টা:।। উদার আকাশ প্রকাশন।। ২০১৩)

‘একসময় নদীর স্বপ্ন দেখতাম
তার খোঁজে স্বপ্নের মধ্যে কত পথ হাঁটলাম।
নিঃশব্দ সন্ধ্যায় পাতাঝরা জঙ্গলের পাশে,
তপ্ত দুপুরে বালির ছোঁয়ায় পায়ের পাতা পুড়ে যাওয়া মরুভূমির কিনারায়।
হাঁটতে হাঁটতে হাতের নাগালে পেলাম পাথর চুঁইয়ে আসা বিন্দু বিন্দু জল,
বুড়ো অশ্বত্থের পাশ দিয়ে তির তির করে বয়ে চলা শীর্ণ সোঁতা, আর একদিন স্বপ্নে মাছরাঙা-বিলও দেখা দিয়ে গেল।
কিন্তু নদী পেলাম না।
তারপর হঠাৎ সেদিন স্বপ্নে নয়, সত্যি সত্যিই দেখলাম…..
……………….’। (নদী)
অথবা-
সেই রাতে
তুমি কাছে ছিলে না।
তোমার কবিতারা ছিল
স্বপ্নের রূপ ধরে
আমার অজান্তে
হৃদয়ের পুষ্পিত শয্যায়।
………
………….. (স্বপ্নের কবিতারা)।
সুখপাঠ্য ২৫টি কবিতার ডালি এই কাব্যগ্রন্থ- ‘ভালোবাসার আঙিনায়’।

কারগিল রণাঙ্গন থেকে (৫০ টা: নয়নতারা পাবলিশার্স।। কলকাতা-৫৪।। ২০০০)

পেশাগত জীবনে লেখক একজন সাংবাদিক। ১৯৯৯ সালে কারগিলের যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী। কলকাতার প্রথম সাংবাদিক হিসেবে পৌঁছেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়ে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন সেই প্রান্তরে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি বিনিময়ের মধ্যে পড়েছেন বারে বারে। অল্পের জন্য মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন। মর্মে মর্মে অনুভব করেছেন, জীবন হল পদ্মপাতায় জল। এই ছিল, এই গড়িয়ে গেল! প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকের কলমে সেই ভয়াবহ যুদ্ধের দিনগুলির বর্ণনা তাঁর এই বইটিতে। দম বন্ধ করে পড়ার মতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *