সিলুট সার্ব্বজনীন দুর্গাপুজো – সম্প্রীতির উজ্জ্বল নিদর্শন
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
চারদিকে যখন সাম্প্রদায়িকতার নাগিনরা তাদের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে পরিবেশকে দূষিত করে চলেছে তখন গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে সম্প্রীতির উজ্জ্বল নিদর্শন রেখে চলেছে আউসগ্রামের সিলুট গ্রাম। সৌজন্যে এলাকার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের আন্তরিকতা।
দীর্ঘদিন ধরেই আউসগ্রাম থানার সিলুট গ্রামের বাসিন্দাদের মনের মধ্যে একটা দুঃখ থেকেই গিয়েছিল। তারা বঞ্চিত ছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর আনন্দ থেকে। পুজোর সময় সারাবাংলা যখন আনন্দে মেতে উঠত তখন বিষণ্ণতার কালো মেঘ ভিড় করত সিলুট গ্রামের উপর। কিছুটা সংকুচিত ভাবে পাশের গ্রামে দুর্গাপুজো দেখতে যেতে হতো, তাতে আনন্দ থাকত না। ছেলেরা যেতে পারলেও পাড়ার মেয়েদের একটা সমস্যা থাকতই। তারা স্বাধীনভাবে যেতে পারত না। একই অবস্থা হতো বাচ্চাদের। ফলে আক্ষেপ থেকেই গিয়েছিল।
অবশেষে সেই আক্ষেপ দূর করতে এগিয়ে আসেন প্রতিবেশী বাবুরবাঁধের বাসিন্দা মোজাম্মেল সেখ ও বিল্লাল সেখ, নবগ্রামের পরিমল কোনার, সিলুট গ্রামের মোস্তাকিম সেখ, বৈদ্যনাথ দত্ত, দীনবন্ধু দাস, নবকুমার দাস, দুর্যোধন দাস, খোকন হালদার এবং প্রয়াত সনৎ হালদার, উদয় বাগ্দী ও ডা. নারায়ণ প্রমুখরা। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে গ্রামের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশি গ্রাম থেকেও চাঁদা তুলে অনাড়ম্বর পরিবেশে একটা অস্হায়ী চালা করে শুরু হয় দুর্গাপুজো। গ্রামের বাসিন্দাদের আনন্দের কোনো সীমা ছিলনা। যতইহোক নিজেদের গ্রামের পুজো। এ এক আলাদা আনন্দ। এটা বাংলার ১৩৯৫ সালের ঘটনা।
তারপর এলাকার আর্থিক অবস্থার বদল ঘটেছে। ভবিষ্যতে যাতে পুজো করতে গিয়ে কোনোরকম আর্থিক সমস্যা নাহয় তারজন্য সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে 'ফাণ্ড'। বছর ছয়-সাত আগে গড়ে উঠেছে পাকা মন্দির। সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে তৈরি হয়েছে কমিটি। তারাই পুজোর দেখভাল করে। শত পরিবর্তনের মধ্যেও আজও পুজোর সময় সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করে।
পুজো পুরোপুরি রীতি মেনে হয়। সপ্তমীর দিন দোলা করে পাশের পুকুর থেকে ঘট আনা হয়। নিয়ম মেনেই অষ্টমী ও নবমীর পুজো হয়। দশমীর অন্যতম আকর্ষণ হলো সিঁদুর খেলা। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর একরাশ বিষণ্নতা গ্রাস করে গ্রামবাসীদের। অপেক্ষা পরের বছরের জন্য।
পুজো কমিটির পক্ষ থেকে রাজকুমার বাবু বললেন - তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। বড়দের কাছে অতীতের কাহিনী শুনি। মনটা খারাপ লাগত। অবশেষে সবার মিলিত চেষ্টায় পুজো শুরু হওয়ায় খুব আনন্দ লাগে। তবে তার আক্ষেপ - যেভাবে বর্তমান প্রজন্ম মোবাইল কালচারে মেতে উঠেছে অদূর ভবিষ্যতে পুজো হবে তো! ভবিষ্যতের কথা ভেবে মনটা তাকে কিছুটা উদাস লাগে।