জ্যোতিপ্রকাশ মুখার্জি,
লুকিয়ে লুকিয়ে গান করতে করতে কখন যে তাদের একমাত্র ছেলে ইমন গানের জগতে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন হয়ে গেছে বুঝতেই পারেননি কলকাতার মানিকতলার বাসিন্দা সৈকত মুখার্জ্জী ও ইন্দ্রানী মুখার্জ্জী (গুপ্ত)। সৈকত বাবু নিজে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। এক দুর্ঘটনা তাকে সেই জগত থেকে সরিয়ে দেয়। ইন্দ্রানী দেবী নিজে অভিনয় জগতের মানুষ। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারে হঠাৎ নেমে আসে আর্থিক বিপর্যয়। একদিকে সংসার অন্যদিকে ছেলের পড়াশোনা – দুই খরচের চিন্তায় দিশেহারা ইন্দ্রানী দেবী চাননি তার ছেলে গান নিয়ে মেতে থাকুক। আর পাঁচটা বাঙালি মায়ের মত তিনিও চেয়েছিলেন তার ছেলে ভাল করে লেখাপড়া শিখে একটা চাকরি পাক, সংসারের অভাব দূর করুক। কিন্তু ইমনের স্বপ্ন যে অন্য।
ইমন তখন কলকাতার এক নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। ফসিল, ক্যাকটাস, চন্দ্রবিন্দু প্রভৃতি বাংলা ব্যাণ্ডের গান শুনতে শুনতে সেও ভিন্ন স্বাদের পরীক্ষামূলক গান লেখার কথা ভাবতে থাকে। তার নতুন ধরনের গানে থাকবে সমাজ দর্শনের কথা। স্বপ্নের কথা বলে ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইড তথা দাদা সায়ন সেনগুপ্তকে। নিজের সংগ্রহে থাকা বাংলা ব্যাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্কিন পার্ক, গ্রিন ডে, কুইন প্রভৃতি ইংরেজি ব্যাণ্ডের গানও সায়ন ভাই ইমনকে শোনাতে থাকে। গানের নেশায় পাগল ইমনের কাজই ছিল স্কুলের ছুটির শেষে দাদা সায়নের কাছে ছুটে যাওয়া এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাণ্ডের গান শোনা।
গান শুনতে শুনতেই সে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। বারবার ক্লাসের মধ্যেই অন্য মনস্ক হয়ে পড়ে। সেখানেই সে গান লিখতে শুরু করে। গানের কথাগুলি দেখে উৎসাহ দেওয়ার পরিবর্তে শিক্ষক ও সহপাঠীরা তাকে ঠাট্টা করতে শুরু করে। কিন্তু হতাশ হয়নি সে। সবাইকে চমকে দিয়ে ২০১৬ সালে ইমন-সায়নের হাত ধরে বাংলা-ইংরেজি গানের ডালি নিয়ে বাংলার বুকে জন্ম লাভ করল এক নতুন ব্যাণ্ড “তাণ্ডব”। সঙ্গী হলো সোহম, তিয়াসা, উজিয়ান সহ কয়েকজন সহপাঠী।
যদিও তারা বর্তমানে আর এই ব্যাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নাই।
যাইহোক, নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে রাজ্য তথা দেশের সীমা অতিক্রম করে অচিরেই এই নতুন ব্যাণ্ড বিশ্বের গানের দরবারেও তাণ্ডব ঘটিয়ে ছাড়ল। সঙ্গীত রসিকদের কাছে প্রশংসিত হলো গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ইমনের নতুন ধারার পরীক্ষামূলক গান। নতুন ব্যাণ্ড “তাণ্ডব” পা রাখল সমাজ মাধ্যমের প্রায় প্রতিটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মে। কঠোর পরিশ্রম ও স্নেহ দিয়ে সে বুকে জড়িয়ে ধরল “তাণ্ডব” কে। এবার সঙ্গে পেল প্রীতাঙ্ক, সুতীর্থ, রিয়া,শঙ্খ, মা ইন্দ্রানী দেবী সহ অসংখ্য শুভানুধ্যায়ীকে। পিছনে থাকল বাবার উৎসাহ ও আশীর্বাদ।
আগামী ২ রা অক্টোবর ইমনের জীবনে ঘটতে চলেছে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লণ্ডনে পরিবেশিত হবে তার গান। ইমনের ভাষায় – সবার আশীর্বাদকে পাথেয় করে বিদেশের শ্রোতাদের সামনে সে তার রাজ্য তথা দেশের মুখ উজ্জ্বল করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।
প্রথমে ছেলের গানকে সমর্থন না করলেও আজ তার গানের সবচেয়ে বড়ো প্রেরণাদাত্রী মা ইন্দ্রানী দেবী। তিনি বললেন- হঠাৎ আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। তাই প্রথম দিকে সমর্থন করিনি। এখন আমি এবং ওর বাবা দুজনেই চাই আমাদের আদরের গুড্ডু (ইমনের ডাক নাম।এই নামেই সে পরিবারে ও পাড়ায় পরিচিত) গানের জগতে আরও নাম করুক। তবে আমরা চাইব ছেলে যেন পড়াশোনায় অবহেলা না করে।
ইমন বলল- প্রত্যেক মা-বাবাই চান তার ছেলে ভাল করে পড়াশোনা করুক। গান যে ছেলের পেশা হয়ে উঠুক কোনো মা-বাবাই চাননা। আমার ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। ফলে কপালে মায়ের বকুনি জুটেছে। কিন্তু নিজের রুমে লুকিয়ে গান লিখতে, সুর দিতে বা গাইতে ছাড়িনি। এই সময় তার সবচেয়ে বড় শ্রোতা ছিল মামীমা। তিনিই তাকে সবার অলক্ষ্যে উৎসাহ দিয়ে গেছেন।
ইতিমধ্যেই প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি গান লিখে ফেলা ইমনের স্বপ্ন গান নিয়ে আরও বেশি পরীক্ষা করা। গানের মাধ্যমে মানুষের কথা তুলে ধরা। তবে তার গানকে সে শুধু বাংলা ভাষার মধ্যেই আবদ্ধ রাখতে চায়না। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেও তার সৃষ্টিকে সে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে চায়। উজ্জ্বল করতে চায় রাজ্য তথা দেশের মুখ।