নিশির কান্না (মিথ্যে নয়),
দিলীপ রঞ্জন ভাদুড়ী।
বহু বছর আগের কথা। তখন আমি কুচবিহার ও তুফানগঞ্জ থানার সি আই পদে কর্মরত। কুচবিহার কোতোয়ালী থানার বড়বাবু ছিলেন এস আই দিগম্বর থাপা।এ এস আই সুভাষ মুর্মু এই থানাতেই
কর্মরত ছিল।অত্যন্ত সাধা সিধে,সহজ সরল জীবন
যাপনে অভ্যস্ত ছিল। শ্বশুরবাড়ী ও নিজের বাড়ী অভিভক্ত মেদিনীপুর জেলায়। চাইলে ব্যারাকে থাকতে পারতেন।কিন্তু না,তিনি থানার পাশেই একটি বাড়ীর দুটি ছোট রুম ভাড়া নিয়ে থাকতেন।
একটি রুমে একটি বড় খাট ও বেঞ্চ। লাগোয়া রুমটি খুব ছোট। কোন মতে কুকার জ্বালিয়ে রান্না টুকু করা যেতে পারে। গরীব দরদী ছিলেন। রিসিভ ও ডেসপাচ সেরেস্তার কাজ করতেন। পেন্ডিং কোন
কিছু থাকলে লাল কালিতে তোলার আগে বহুবার
অনুরোধ করে কাজ আদায় করার ওস্তাদ ছিল।
কিন্তু, পাঁজি বিশ্বাস করত। অদ্ভুত এক ঝোঁক ছিল। ত্রয়োস্পশর্কালে কোন যুবতী কন্যা
গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা হত্যা করলে সেই ইউ ডি কেস হলে ,সেই মামলা তদন্ত ভার ওঁকে দিতে
অনুরোধ করত। কিন্তু, কেন তা জানতে অনেক দেরী হয়েছিল। তখন,গ্রাম থেকে গ্রামন্তরে যাবার জন্য সাইকেলে যেতে হত। ফলে বহু ইউ ডি কেস তদন্ত করায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই সুভাষ মুর্মু হঠাৎ একদিন বেপাত্তা হয়ে গেল। তখন আজকালকার মত পুলিশের নিজেদের মধ্যে বিরোধ একদম ছিল না। ইতিমধ্যে বড়বাবু বদলি
হয়ে গেল। বড়বাবু হয়ে এলেন স্বর্গত পীযুষ রায়।
তিনি থানার দায়িত্ব নেবার সময় সুভাষ মুর্মুর কথা
জানতে পেরে বললেন যে সবার আগে ওঁর বাড়িতে
লোক পাঠাতে হবে। অনুপস্থিত দেখাবার আগে সব
জেনে নিতে হবে। আমার সাথে আলোচনা করে থানার তুখোড় কনস্টেবল ঘুরন ঝাঁ কে পাঠান হল
মেদিনীপুরে। ব্যাপারটা খুব গোপন ছিল।
দিন দশেক পরে ঘুরন ঝাঁ ফেরত এলেন একা। জানা গেল সুভাষ মুর্মু বহাল তবিয়তে
ওঁর শ্বশুর বাড়ীতে বসবাস করছে। শ্বশুর মারা গেছেন। ওঁর স্ত্রী যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত। বহু চাষ যোগ্য জমির মালিক ওঁর স্ত্রী। ওঁ তাই চাষে ও স্ত্রীর
চিকিৎসায় ব্যস্ত। বলেছে চাষ শেষ হলে স্ত্রীকে নিয়ে
থানায় ফিরবে। ঘুরন ঝাঁ অনেক বুঝিয়েও কোন ভাবে সঙ্গে নিয়ে ফিরতে না পেরে ,একটি ছুটির দরখাস্ত লিখিয়ে নিয়ে ফেরত এসেছেন।
তখন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ছিলেন শ্রী
এ এম খান,আই পি এস। তিনি অত্যন্ত দয়ালু সাহেব ছিলেন। বাধ্য হয়ে তাঁকে বলতেই হেঁসে বললেন যে তিনি সব জানেন। বললেন,ওঁকে কাজে অনুপস্থিত দেখাতে। ফিরলে রিপোর্ট দিতে।
ও ই এল করে দেব। কিছুটা নিশ্চিত হলেও আর এক বিপত্তি দেখা দিল।
বাড়ীর মালিক এসে জানালেন যে আজ প্রায় তিনমাস হল মুর্মু বাবু বাড়ীতে তালা মেরে চলে গিয়েছেন আর ফিরছেন না। উনার ছোট রুম
থেকে রাতে রোজ কোন মহিলার কান্না ভেসে আসে। বাড়ীতে ভয়ে সবাই সিঁটিয়ে আছে। বড়বাবু খুব রসিক ও ম্যানেজ মাস্টার ছিল। বললেন, আপনার যা বাড়িভাড়া পাওনা আছে,দিয়ে দিচ্ছি।
আর কান্না শুনতে পাবেন না। ভদ্রলোক বললেন যে না, আপনি আমায় ভুল বুঝেছেন। আপনি ওই
ঘর খুলে দেখুন ,কিসের কান্না রোজ শুনতে পাই।
বড়বাবু আমাকে বললেন, এখন কি করা যায়। তারপর ঠিক হল তালা ভেঙ্গে দেখাই যাক।
কথামত দিন ঠিক হল। বাড়িওয়ালা ও কয়েকজন
প্রতিবেশীর সামনে তালা ভাঙা হল। দেখা গেল বেশ কিছু দড়ি ও একটি বাঁশের কয়েকটি টুকরো ছাড়া কিছুই নেই। ওগুলো বের করে নিয়ে থানায়
নিয়ে আসা হল। নতুন তালা লাগিয়ে দেওয়া হল রুমে। বাড়িওয়ালা কে বলা হল যে আজ রাত থেকে কিছু শুনতে পান কিনা, জানাবেন।
থানায় আনার পর দড়ি গুলোতে দেখা গেল প্রত্যেকটি তে ইউ ডি কেস নম্বর ও তারিখ
লেখা আছে। কিন্তু, বাঁশের টুকরো গুলোতে কোন
লেবেল পেলাম না।
দুদিন পর খবর পেলাম যে মুর্মু স্ত্রী সহ ফিরে এসেছে। স্ত্রীকে রাজারহাট আই ডি হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছে। থানায় গিয়ে মুর্মুকে খুব মন মরা দেখলাম। বললাম” মুর্মু তুমি
কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছিলে কেন”। সহজ
সরল উত্তর পেলাম। বলল যে শ্বশুরের মৃত্যু সংবাদ ও ওঁর স্ত্রীর অসুস্থ সংবাদ পেয়ে ওঁর মাথার ঠিক ছিল না,তাই চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
বললাম,এখন তো সব ঠিক হয়ে গেছে, তার পরেও মনমরা কেন। এবার কার উত্তর শুনে অবাক হয়ে গেলাম। বলল,স্যার মাত্র দুদিন অপেক্ষা করতে পারলেন না।আমার সব সংগ্রহ শেষ হয়ে গেল! বিস্ময়ে জানতে চাইলাম কি?
ওই যে দড়ি গুলো বাইরে বাগানে ফেলে রেখেছেন
ও গুলো র মধ্যে প্রাণ ছিল। সব নষ্ট হয়ে গেল। আর কাজে লাগবে না। ও গুলো কি কাজে লাগত, জানতে চাইলাম। বলল,ওগুলো মহিলাদের বহু রোগে তাবিজ হিসেবে কাজে লাগত। এর পর বাঁশ
নিয়ে জানতে চাইলে বলল ওটা “আমি পরীক্ষার জন্য এনেছিলাম।” ” ওটা বেসো ভুত কিনা জানবার জন্য আনা হয়েছিল। এঁদের বশে রাখতে হয়। বশে না থাকলে বিপত্তি হয়।
আগ্রহ বেড়ে গেল। কিন্তু, এবার মুর্মু আমাকে থামিয়ে দিল। বলল যে ওঁর গুরুর কাছে পাওয়া গুপ্ত বিদ্যা, কাউকে বলা নিষেধ।
আমি চুপ করে গেলাম। আজও মুর্মুর কথা
আমার মনে পড়ে। কান্না টা কার! বাঁশো ভুতের না
অতৃপ্ত কোন আত্মার ,আজও উত্তর পেলাম না।
*** *** *** ***