ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করতে ‘দুয়ারে’ প্রধান শিক্ষক
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
একে কী বলা হবে ‘দুয়ারে শিক্ষক’? হয়তো সেটাই সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। করোনার পর থেকেই শুধু এই রাজ্যে নয়, সমগ্র দেশের বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রছাত্রীদের হাজিরার সংখ্যা কমেছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে ড্রপ আউটের সংখ্যা। বর্তমান শিক্ষাবর্ষে গ্রীষ্মের ছুটির পর কোনো কোনো বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার খুব কম। এই সমস্যা থেকে বর্ধমানের রথতলা মনোহর দাস বিদ্যালয়ও মুক্ত নয়। বিষয়টি নজরে আসে ছাত্রদরদী প্রধানশিক্ষক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতির হার বাড়াতে, ড্রপ আউটের সংখ্যা কমাতে তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষা কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু সন্তোষজনক ফল পাননি। অবশেষে বিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী অরিজিৎ
বাবুকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ শে আগষ্ট ছুটির দিন নিজেই চলে যান বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে।
এক্ষেত্রে সমস্যা অনেক। বিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী খুবই গরীব ঘরের। বহু কষ্ট করে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠান।
সমস্যা হয় তাদের সঠিক ঠিকানা ও ফোন নাম্বার সংগ্রহ করা। ভর্তির খাতায় বা বাংলা শিক্ষাপোর্টালে ছেলেমেয়েরা যে ঠিকানা দিয়েছে তার বেশিরভাগই পরিবর্তন হয়ে গেছে। অনেকেই অন্য জায়গায় বসবাস করছে। একটা বড় অংশের ফোন নাম্বার পরিবর্তন হয়ে গেছে।
তাও 'খড়ের গাদাতে ছুঁচ খোঁজা'-র মত ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য বিনায়ক বাবু ও অরিজিৎ বাবু রথতলা বিদ্যালয়ের আশেপাশের আঁজিরবাগান, বাঁধের পাড় সহ কয়েকটি বসতিতে গিয়ে হাজির হন। সঙ্গে পেয়ে যান পার্শ্ববর্তী রথতলা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মন্দিরা রায়কে। মূলত সেই হয়ে ওঠে তাদের পথপ্রদর্শক। তার সহযোগিতায় একে একে ছ'জন ছেলেমেয়ের বাড়িতে পৌঁছে যান তারা।
সাতসকালে স্বয়ং প্রধানশিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীকে বাড়ির উঠানে দেখে চমকে ওঠে গরীব ঘরের মানুষগুলো। বিষয়টি তাদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। চমক ভাঙতেই প্রত্যেকেই আগামীকাল থেকেই নিজ নিজ ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়। কেউ কেউ নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরে প্রধান শিক্ষকের সামনে। ছুটির দিন হলেও ফোনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে তিনি সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।
জনৈক অভিভাবক বললেন - আমরা গরীব ঘরের মানুষ। কোনোদিন ভাবিনি স্বয়ং প্রধানশিক্ষক আমাদের বাড়িতে আসবেন। তার সম্মান রক্ষার্থে অবশ্যই আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠাব।
বিনায়কবাবুর উদ্যোগের কথা শুনে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র তথা স্থানীয় বিধায়ক খোকন দাস খুব খুশি। তার সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া – বিনায়কবাবু ডাকলে আমি অবশ্যই ছেলেমেয়েদের বাড়িতে যাব। তবে বিধায়ক হিসাবে নয়, এলাকাবাসী হিসাবে।
বিনায়ক বাবু বললেন - সত্যিই এরা খুব গরীব ঘরের ছেলেমেয়ে। এদের সমস্যা উপলব্ধি করলাম। যতটা সম্ভব তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব। তিনি আরও বললেন - ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য আমি আমার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেছি আমরা নিয়মিত বিদ্যালয় ছুট ছেলেমেয়েদের বাড়িতে যাব। তাদের অভিভাবকদের বুঝিয়ে ছেলেমেয়েগুলোকে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনব। ওরা তো আমাদের সন্তান। আশাকরি আমাদের চেষ্টা ব্যর্থ হবেনা। তিনি তাদের পথপ্রদর্শক মন্দিরার ভূয়সী প্রশংসা করেন। একইসঙ্গে স্থানীয় বিধায়ক তথা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র খোকন দাসের প্রতিক্রিয়া শুনে বললেন - উনাকে ডাকলেই পাই। অসুবিধা হলে অবশ্যই সঙ্গে নেব।
প্রসঙ্গত শিক্ষক জীবনের শুরু থেকেই বিনায়ক বাবু ছাত্রছাত্রীদের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। তার সৌভাগ্য প্রথমে সহশিক্ষক ও পরে প্রধানশিক্ষক হিসাবে তিনি সহকর্মীদের সহযোগিতা পেয়েছেন।