হিন্দু স্কুলে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্ম-দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপন

Spread the love

হিন্দু স্কুলে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্ম-দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপন

২৭ জানুয়ারি ২০২৪ শনিবার ৪৭তম আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তক মেলার প্রেস কর্নারে আবরণ উন্মোচন হল হিন্দু স্কুলের মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্ম-দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি দ্বারা প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থ “তিষ্ঠ ক্ষণকাল“। এই বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হিন্দু স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক শুভ্রজিৎ দত্ত (যিনি আবার এই স্কুলের প্রাক্তনীও), পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, অন্যতম কার্যকরী আধিকারিক শুভঙ্কর (অপু) দে, প্রাক্তন আইপিএস ড. চম্পক ভট্টাচার্য যাঁরা প্রত্যেকেই হিন্দু স্কুলের প্রাক্তনী, এবং হিন্দু স্কুলের বর্তমান শিক্ষকমণ্ডলী। প্রকাশিত হল স্মারকগ্রন্থ ‘তিষ্ঠ ক্ষণকাল’। মধুসূদনের সাহিত্যের বহুমাত্রিক মূল্যায়নের পরিসর এই গ্রন্থে তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি দ্বিশতবর্ষ-পালনের একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্রও তথ্যের মাধ্যমে সাজানো হয়েছে, যা ভবিষ্যৎ-গবেষণায় সহায়ক হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

দুটি শতাব্দী অতিক্রমী হিন্দু স্কুল। উনিশ শতকের বঙ্গদেশ অথবা অন্যভাবে বললে গোটা ভারতবর্ষের নবজাগরণের গর্ভগৃহ। ইউরোপীয় রেনেসাঁস যুগের ইতিহাস, সাহিত্য ও বিজ্ঞান আমাদের দেশের ভাবজগতে মানবতাবাদী জীবনবোধের যেসব আকাঙ্ক্ষা, দ্বিধা ইত্যাদি তুলে ধরেছিল, বলতে কী তার সবগুলোই ধারণ করেছিল হিন্দু স্কুল। নবজাগরণের এই ধারাতেই সম্ভাবনাময় নতুন মানসিক পরিমণ্ডলে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অবস্থান। এবং একথা সত্য যে, নবজাগরণের যুগে মানবতাবাদের নতুন নতুন আকাঙ্ক্ষাগুলো রামমোহন-বিদ্যাসাগরের মধ্যে যে-অফুরন্ত প্রেরণা ও বহুমুখী কর্মোদ্যোগের সঞ্চার ঘটিয়েছিল, সেই একই আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে মধুসূদনের চরিত্রে প্রবল পৌরুষ, গভীর আত্মপ্রত্যয় এবং সূক্ষ্ম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের এক বলিষ্ঠ অভিব্যক্তি এনে দিয়েছিল। এসব নিয়েই এক অতৃপ্ত মানসসত্তা সফল অভিব্যক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল বাংলাসাহিত্যে। এবং এসব নির্মাণের সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়ে আছে হিন্দু স্কুল অথবা সেদিনের ‘হিন্দু কলেজ’-এর নাম। মধুসূদন যখন হিন্দু কলেজে ভর্তি হন, তখন শারীরিকভাবে ডিরোজিও নেই, কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে রয়ে গেছে তাঁর আদর্শ ও শিক্ষা। তখনও প্রকাশিত হচ্ছে বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা। সেইসব পত্র-পত্রিকার পাতায় প্রচলিত মূল্যবোধ কাটিয়ে যুক্তিবাদের মাধ্যমে সত্যকে গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে তখনও। মধুসূদন এইসব কর্মোদ্যোগে যোগ না দিলেও এই আবহের মধ্যেই বড়ো হয়ে উঠেছেন। অর্থাৎ হিন্দু কলেজ অথবা হিন্দু স্কুল ‘মহাকবি’ মধুসূদনের প্রেরণাভূমি হয়ে উঠেছিল তাঁর বাল্য-কৈশোরেই। ফলত, মধুসূদনের শতবর্ষ উদ্‌যাপনে হিন্দু স্কুল তার দায়বদ্ধতা থেকে যে-উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, দ্বিশতবর্ষের কালেও আজকের প্রাসঙ্গিকতায় সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের নানাবিধ উদ্যোগ।

২০২৩-এ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে সংগঠিত সরস্বতী পূজায় থিম হিসেবে উঠে আসেন মধুসূদন। ‘মাতৃকোষে রতনের রাজি’ শিরোনামের এই মণ্ডপসজ্জা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সুধীসমাজের কাছে। এরপর ছাত্রদের দাবি এবং শিক্ষক ও প্রাক্তন ছাত্রদের উৎসাহে তৈরি হয় ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্ম-দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপন কমিটি, হিন্দু স্কুল’। পাশে এসে দাঁড়ান ‘হিন্দু স্কুল ফাউন্ডার্স অ্যান্ড লুমিনারিজ় ট্রাস্ট’-এর সদস্যরা। একটা সংগঠিত সমবেত প্রয়াসে বিদ্যালয়ে দু’দিন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম আলোচনাসভায় (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩) উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় (নবজাগরণের গর্ভগৃহ হিন্দু কলেজ ও তার শ্রেষ্ঠ সন্তান মধুসূদন), অধ্যাপক ড. অমিতকুমার দে (মাইকেল মধুসূদন দত্ত : সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত) ও অধ্যাপক ড. সুমিতকুমার বড়ুয়া ( মধুসূদনের গীতিকবিতা ও সনেটে ভারত প্রসঙ্গ)। দ্বিতীয় আলোচনা সভায় (৬ অক্টোবর ২০২৩) উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে অধ্যাপক ড. স্বপনকুমার পাণ্ডা, (বাঙালি জীবনে মধুসূদন), অধ্যাপক ড. নির্মাল্যকুমার ঘোষ ( আমাদের মধুসূদন পড়া) ও ড. বিধান দত্ত (মধুসূদনের সনেট : জীবন ও সাহিত্য)। আন্তঃশ্রেণি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা(২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩), প্রদর্শনীমূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘রেনেসাঁস’ (১২ অক্টোবর ২০২৩) প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাপ্তি পর্বে গত ২৪ জানুয়ারি আয়োজন করা হয়েছিল ‘মাইকেল মধুসূদন জন্ম-দ্বিশতবর্ষ স্মারক বক্তৃতা। ‘মাইকেল থেকে শ্রীমধুসূদন : আমাদের সময়ে, সংগ্রামে ও বিদ্রোহে’–এই বিষয়ে স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন বিদ্যালয়েরই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক গৌতম অধিকারী। ঐদিন ‘মধুকবির গান’ পরিবেশন করে গানের দল ‘বৈঠা’ (নদিয়া), এবং অণুনাটক ‘শেষ সংলাপ: মাইকেল’ অভিনয় করেছেন ড. দেবেশ ঠাকুর। মাননীয় সাংসদ, কলকাতা উত্তর, শ্রীসুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়-সহ আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয় ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ মহাকবির জন্ম-দ্বিশতবর্ষ পূর্তির দিনে। সন্ধ্যায় গিরিশ মঞ্চে অভিনীত হয় “নয়ে নাটুয়া”-র মহাকাব্যিক প্রযোজনা ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। এই সব উদ্যোগগ্রহণে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সাহায্য আমরা যেমন পেয়েছি, তেমনই অনেক সুধীজন আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের মধুসূদন-অনুরাগী মানুষের কাছে এই প্র‍য়াস পৌঁছে যাক এটাই কাম্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *