The Unseen Colours Of Autism

Spread the love

The Unseen Colours Of Autism

ঝর্ণা ভট্টাচার্য,

তৃণার সকাল থেকেই মনটা খারাপ ।ঋজু আজ না খেয়েই অফিস চলে গেল। পিকু এখন একদম কথা শোনে না। কেন যে ঋজুর খাবার থালায় বলটা ছুড়তে গেল। অবশ্য ওর কি দোষ তৃণা ঋজু দুজনেই নিজেদের কাজ আর নিজেদের নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে পিকু আর পাঁচটা বাচ্চার মত নয় খেয়াল করতে করতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তখন সেগুলো ছেলেমানুষী ভেবে দিনের শেষে বাবা মা ছেলেকে সন্তান স্নেহে ভরিয়ে নিজেদের মতৃত্ব পিতৃত্বের স্বাদ মিটিয়েছে আর তাতেই হয়তো কিছুটা দায়িত্ববোধ থেকে দূরে সরে গেছে।
মিনতি দি কতবার বলেছে বৌদি পিকু না সবার মত নয় ওকে ডাক্তার দেখাও। একদিন তার উত্তরে তৃণা বলেছিল ” মিনতি দি তুমি বড্ড বেশি ভাবো,আমার পিকু যতদিন ছোট থাকবে ততদিন ভালো” ।ঋজু খেলা দেখতে দেখতে বলেছিল ” আরে ছেলে তাড়াতাড়ি বড় হলেই চাপ আবার কোন মেয়ের বাবা এসে বলবে আমার মেয়েকে আপনার ছেলে ডিস্টার্ব করছে।” সবাই সেদিন হাসিঠাট্টা করে কাটিয়ে দিয়েছিল একটা কঠিন বাস্তবকে । যতদিন গেছে পিকু যে আর পাঁচটা বাচ্চার থেকে আলাদা সেটা বুঝতে পেরেছে তৃণা ঋজু দুজনেই ,আর বাবা মায়ের স্নেহ ভালোবাসার বাইরে একটা বড় দায়িত্ব থাকে সন্তানকে গভীরভাবে বোঝা তাকে পর্যবেক্ষণ করা আর সেটা যে নিজেদের জগৎ নিজেদের কাজ আর উন্নত জীবনের তাগিদে হয়ে ওঠেনি তার জন্য বিবেক দংশনে ভুগে চলেছে প্রতিনিয়ত দুজনেই দুজনকে লুকিয়ে।স্বামী স্ত্রীর মধ্যেও তৈরি হয়েছে দূরত্ব। ঋজু একদিন ড্রিংক করে বলেই বসলো” তৃণা আর যাই করো ভালো মা হতে পারলে না,বসের প্রিয় হলে বটে কিন্তু চামড়া ঝুলে গেলে ওই বস কি আর এত পাত্তা দেবে? ” তৃণা চিৎকার করে বলেছিল ” সব দায়িত্ব একা মায়ের বলো? তুমিও তো বাবা ,তুমি কি করেছো? অফিস ট্যুরে যে কি হয় আমারও জানা আছে ঋজু তাই একটা আঙ্গুল আমার দিকে তুললে পাঁচটা আঙ্গুল তোমার দিকেও উঠবে “। সেদিন মিনতি দি তৃনাকে নিয়ে অন্য ঘরে চলে গিয়েছিল বলে ঝামেলাটা বেশি দূর গড়ায় নি। পরের দিন অবশ্য একে অপরকে সরি ও বলেছিল।
এখন পিকুর বয়স সাড়ে তিন বছর। ঠিকমতো কথা বলতে শেখেনি পিকু। মাত্র দু–একটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারে, কিন্তু সেগুলো দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। বাবা-মা বা অন্য কারও চোখে চোখ রেখে তাকায় না। একা একা থাকে, বাড়িতে ওর বয়সী কোনো বাচ্চা এলে তাদের সঙ্গে মেশে না। মাঝেমধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই উত্তেজিত হয়ে পড়ে মিনতি দিকে মেরে দেয়, তৃনাকে খামচে দেয়।কখনো নিজেকেই আঘাত করে, একই কাজ বারবার করে। যেমন বারবার হাতে তালি দেয়, মেঝের ওপর ঘুরতে থাকে।
একদিন পিকুর ব্যবহারে তৃণা মেজাজ হারিয়ে ভীষন মারধর করে পিকুকে তারপরই ওকে নিয়ে ঋজু আর তৃণা যায় একজন ডক্টরের কাছে।সেদিনই ডক্টর জানায় পিকু অটিষ্টিক চাইল্ড । ডক্টর বোসকে তৃণা জিজ্ঞেস করে কেন এমন হল ।
তার উত্তরে ডক্টর বোস জানায় ” অটিজম হচ্ছে স্নায়ুর বিকাশজনিত সমস্যা। মায়ের গর্ভ থেকে জন্মের কয়েক বছর পর পর্যন্ত শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। কোনো কারণে স্নায়ুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে। উনি আরো বলেন অনেক গুলো লক্ষন দেখে অটিজম বোঝা সম্ভব যেমন ধরুন ৬ মাস বয়সের মধ্যে শিশু একা একা হাসতে না পারা
১২ মাস বয়সের মধ্যে আধো আধো বোল বলতে পারছে না, পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা করছে না বা ধরুন ১৬ মাসের মধ্যে কোনো একটি শব্দ বলতে পারে না। ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই বা ততোধিক শব্দ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পারার পর আবার ভুলে যাচ্ছে।এমন কি বয়স উপযোগী সামাজিক আচরণ করছে না।এসব লক্ষণ দেখা গেলে তখন তাকে অবশ্যই অটিজমের বৈশিষ্ট্য আছে কি না, বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। যেটা আপনারা করেন নি।যাইহোক এখন আমরা চেষ্টা করবো ওকে যথা সম্ভব ভালো রাখার তবে বাবা মা হিসেবে আপনাদের কিন্তু ধৈর্য্য ধরতে হবে , হাল ছেড়ে দিলে হবে না।

অটিজম রয়েছে এমন শিশুর মধ্যে মূলত দুই ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায় জানেন
সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে অসুবিধা এবং আশপাশের পরিবেশ ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যা।
বারবার একই ধরনের আচরণ করা।অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি বা শিশুরা সামাজিকতা পালন করতে পারে না, নিজের আগ্রহ, আবেগ আর অনুভূতি অপরের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না, যেকোনো ধরনের সামাজিক সম্পর্ক শুরু করার জন্য নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না এবং যদি সে কথা বলতেও পারে, তবু আরেকজনের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। কেউ কেউ ঠিকমতো কথা বলতে পারে না বা একেবারেই কোনো অর্থবোধক শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না, চোখে চোখ রেখে তাকায় না এবং পরিবেশ অনুযায়ী মুখভঙ্গির পরিবর্তন করে না, অর্থাৎ ভয় পেলে বা খুশি হলে মুখ দেখে বোঝা যায় না। অটিজম আছে এমন শিশুরা কল্পনা করে খেলে না। যেমন নিজেকে কোনো চরিত্র ভেবে বা কোনো সাধারণ বস্তুকে গাড়ি বা প্লেন বানিয়ে খেলতে পারে না। সহজে বন্ধু তৈরি করতে পারে না এবং অপরের বিষয়ে তাদের আগ্রহ কম তৈরি হয়।
আবার ধরুন একই ধরনের আচরণ বারবার করতে পারে। যেমন হাতে তালি দেওয়া, মেঝেতে ঘুরতে থাকা, বারবার আঙুলের সঙ্গে আঙুল প্যাঁচানো। কখনো বা একটি বস্তুকে বারবার একই রকমভাবে ব্যবহার করা। যেমন খেলনা গাড়ির চাকা বারবার ঘোরানো, কখনো বা একই শব্দ বারবার উচ্চারণ করা। অটিজম আছে এমন যারা কথা বলতে পারে, তারা দেখা যায় একই প্রশ্ন বারবার করছে বা প্রশ্নকর্তার প্রশ্নটিই বারবার উচ্চারণ করছে। যেমন যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তোমার নাম কী?’ তবে সে নিজের নাম না বলে বলতে থাকে—‘তোমার নাম কী? তোমার নাম কী? তোমার নাম কী?’—এই ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা রুটিন বা প্যাটার্ন মেনে চলতে পছন্দ করে, রুটিনের ব্যতিক্রম হলে রেগে যায় বা মন খারাপ করে। অনেক সময় একই চিন্তা বা একই কাজ বারবার করার অভ্যাস থাকে, আবার কখনো একটি বিশেষ বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ তৈরি হয়। যেমন খেলনা গাড়ি, চশমা, কলম ইত্যাদি সংগ্রহ করতে চায়। শব্দ বা স্পর্শের প্রতি অস্বাভাবিক সাড়া দেয়। যেমন অল্প শব্দেই ভীত হয়ে পড়ে বা অনেক জোরের শব্দেও কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, তেমনি অল্প স্পর্শেই ব্যথা পায় বা অস্বস্তিবোধ করে, আবার উল্টোটাও হতে পারে, অনেক ব্যথা পেলেও কাঁদে না।এবার সবার মধ্যে সব লক্ষন দেখা যায় না । আমরা লক্ষন দেখে তার সঠিক চিকিৎসা করি। “
তৃণা বলে” ডক্টর আমার ছেলেরই এমন কেন হল?”
ডক্টর বোস একটু চুপ করে থেকে বলল ” দেখুন ম্যাডাম সাধারণত
অটিজমের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কিছু বিষয়কে অটিজমের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন ধরুন বংশে কারও অটিজমের সমস্যা, মায়ের গর্ভকালীন সংক্রমণ (রুবেলা, মিসেলস, মাম্পস), জন্মের সময় শিশুর ওজন কম থাকা, গর্ভকালীন সময়ে বিষাক্ত সিসাযুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া, প্রসবকালীন কোনো জটিলতা, মা ও শিশুর অপুষ্টিজনিত সমস্যা এসবের থেকে হতে দেখা যায়।”
ঋজু হঠাৎ করে বলে উঠলো ” তোমার এক ভাই এরকম পাগল পাগল ছিল না ? যাকে আমাদের বিয়ের দিন তোমার কাকিমা খুব বকছিল? তার মানে তোমার বংশেই আছে!”
তৃণা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো।
ডক্টর বোস বললো ” কি জানেন মিস্টার রায় আপনাদের মত কিছু মানুষদের জন্য এঁরা সমাজের মূল স্রোতে কখনো নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে না। ধরে নিন না এরা ভগবানের তৈরি এক অনন্য মানব। ভাবতে পারেন ডাক্তার হয়ে কাব্য করছি আসলে করতে বাধ্য হলাম কেন জানেন আমার মেয়েটাও অটিষ্টিক বাচ্চা। প্রথমে কষ্ট হত এখন এই ছলচাতুরীর পৃথিবীতে ওকেই বেশি স্বাভাবিক মনে হয়। তাই বলি কি ওর যত্ন করুন ওর থেকে যে ভালোবাসা পাবেন তা হয়তো তথাকথিত স্বাভাবিক বাচ্চার বাবা হয়ে পেতেন না”।
“সরি তৃণা হঠাৎ করে একটা বাজে কথা বলে ফেললাম “।ঋজু তৃণার দিকে না তাকিয়েই বললো।
তৃণা ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললো ” পিকুর ট্রিটমেন্ট কিভাবে শুরু করবো ডক্টর? কি কি করলে ও ভালো থাকবে?”
“দেখুন সবার আগে ওকে আপনাদের ভালো করে বুঝতে হবে তাহলে সেই বুঝে ওর অনুভূতির কথা বুঝতে পারবেন। পিকু যাতে ঠিকঠাক আচরণ করে তার জন্য ধৈর্য্য ধরে ওকে ট্রেনিং দিতে হবে যা একজন থেরাপিস্টই সঠিক ভাবে পারবে। ওকে বিভিন্ন বিষয়ে আঁকা, নাচ, গান,খেলা যেগুলো আর পাঁচটা বাচ্চা করে সেগুলোতে উৎসাহ দিতে হবে। স্কুলে ভর্তি করবেন অবশ্যই এবং নিয়মমাফিক স্কুলে ওর খোঁজ নিতে হবে। সামাজিক রীতিনীতি ধরে ধরে আপনাদেরই শেখাতে হবে ,দেরি হবে ওর আয়ত্ত করতে কিন্তু ঠিক শিখবে। সামাজিক অনুষ্ঠানে কখনই ওকে রেখে যাবেন না ,সব সময় ওকে নিয়ে সব জায়গায় যাবেন।হয়তো অনেক মানুষ অনেক কথা বলবে শিক্ষার অভাব ভেবে উড়িয়ে দিতে দিতে দেখবেন একসময় ওগুলো আর কান অব্দি পৌঁছবে না।আর হ্যাঁ একজন স্পিচ থেরাপিস্ট এর কাছে অবশ্যই নিয়ে যাবেন তাহলে কমিউনিকেশন গ্যাপ হবে না। অকুপেশনাল থেরাপি করালে খুব ভালো হয়।এছাড়া সাইকোথেরাপি,প্লে থেরাপি, সেন্সরি ইন্টিগ্রেশন ভীষন ওদের সুস্থ জীবন যাপনে সাহায্য করে। তবে আজ আমি কিছু ওষুধ দিচ্ছি নিয়ম করে খাওয়ান আর তিন মাস পরে আবার একবার পিকুকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন”।
পিকু হঠাৎ ঋজু আর তৃণার হাত নিয়ে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরলো।
ডক্টর বোস বললো” এই যে আমরা এতক্ষন কথা বললাম ও কিন্তু অনেক কিছুই বুঝেছে হয়তো বলে কিছু প্রকাশ করলো না কিন্তু দেখুন ওর যে ওর বাবা মাকে কতটা প্রয়োজন ঠিক বুঝিয়ে দিল।”
ঋজু পিকুর মাথায় হাতটা রাখলো। চোখটা অজান্তেই জলে ভরে উঠলো। তৃণা চিকুকে বললো ” ডক্টর আঙ্কেল কে থ্যাংক ইউ বলো”।
পিকু অবশ্য ওসবের ধার ধরলো না। বরং ডক্টর আঙ্কেলের পেনটা টেবিল থেকে নিয়ে নিল। ঋজু ছাড়িয়ে রাখতে গেলে পিকু রাগ দেখাতে শুরু করলো।
ডক্টর বোস বললো ” ছেড়ে দিন ওই পেনটা ওর থাক। একদিন কে বলতে পারে আমাদের পিকু এই পেনটা দিয়ে লিখে হয়তো জুনিয়র আলবার্ট আইনস্টাইন হবে ।জানেন কি উনি ছিলেন অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। আইনস্টাইন ছোটবেলায় তুলনামূলকভাবে অনেক দেরিতে কথা বলতে শেখেন। আরো শুনুন তবে চার্লস ডারউইন( প্রকৃতিবিদ)ভূতত্ত্ববিদ এবং জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনকে চেনেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জানলে অবাক হবেন চার্লস ডারউইনের অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার ছিল। ডারউইন ছিলেন খুব শান্ত প্রকৃতির। সবসময় কোলাহল এড়িয়ে চলতেন। এমনকি যে কোনো কথা মুখে না বলে লিখে জানাতেন।
স্যার আইজ্যাক নিউটন ছিলেন অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। অন্যান্যদের তুলনায় কথা কম বলতেন। কারও সঙ্গে খুব ভালো মিশতে পারতেন না।

এছাড়াও বিল গেটস, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ভিনসেন্ট ভ্যান গগ, টমাস এডিসন, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, নিকোলা টেসলা, বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন, হেনরি ফোর্ড, লুডভিগ ভ্যান বিথোভেন, উলফগ্যাং আমাদেউস মোজার্ট, বব ডিলান, জেমস টেলর, জন ডেনভার, পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ, আলফ্রেড হিচকক, সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্ট কার্ল জং, স্যামুয়েল ক্লেমেন্স, জর্জ অরওয়েল, জেন অস্টেন, চার্লস এম শুলজ অটিজমে আক্রান্ত ছিলেন।
তাই আমার আশা আমাদের পিকু এনাদের কারোর মতোই একজন হয়ে উঠবে যে নতুন পথের দিশা দেখাবে।”
ঋজু ডক্টর বোসের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বললো ” আপনি আমাদের আজ চোখ খুলে দিলেন । আবার দেখা হবে। আপনাদের মত মানুষ আছে বলেই হয়তো পৃথিবীটা এত সুন্দর এখনও।”
ঋজু ডক্টর বোসকে ফিস দিয়ে তৃণা আর পিকুকে কোলে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে পড়লো।তৃণা বেরোনোর আগে হাত জোড় করে ডক্টর বোসকে একবার প্রণাম জানালো।
সেদিন রাতে খাবার পরে তৃণা ঋজুকে বললো” পিকুকে নিয়ে তুমি শুতে যাও ,আমি আসছি একটু পরে”।
ঋজু বললো ” বেশি দেরি করো না , তোমারও বেশ ধকল গেছে।”
তৃণা ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
তৃণা বারন্দায় গিয়ে সোফায় ফোনটা নিয়ে বসে গুগল ঘাটতে শুরু করলো। সার্চ করতে শুরু করলো অটিজমের খুঁটিনাটি। তৃণা দেখে অবাক হল যে পৃথিবীর কত কিছু আমাদের অজানা।পিকুর কোন কোন দিকে বেশি নজর দিতে হবে সার্চ করতে গিয়ে দেখলো যে অটিষ্টিক বাচ্চাদের মধ্যে খিঁচুনি (মৃগী), অতিচঞ্চলতা (হাইপার অ্যাক্টিভিটি), বুদ্ধির ঘাটতি, হাতের কাজ করতে জটিলতা, হজমের সমস্যা, দাঁতের সমস্যা, খাবার চিবিয়ে না খাওয়া ইত্যাদি সমস্যা থাকতে পারে। মনে মনে ভাবলো কাল মিনতি দি এলেই এগুলো জানাতে হবে যেন ঠিক মত নজর রাখে এই দিক গুলো। তারপর পিকুর বাইরে বৃহত্তর পরিধিতে অটিষ্টিক বাচ্চাদের নিয়ে জানার ইচ্ছে থেকে পড়াশোনা করার ইচ্ছেটা বাড়লো। যদি মা হয়ে শুধু পিকুর জন্য নয় আরো কিছু পিকুর মত শিশু ও তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো যায় একটু সচেতন করা যায় মন্দ হয় না

সেই জানার ইচ্ছে থেকেই তৃণা দেখলো যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) পরিচালিত সর্বশেষ জরিপ (২০১৮ সালে প্রকাশিত) অনুযায়ী দেখা যায়, প্রতি ৫৯ জন শিশুর মধ্যে ১ জনের অটিজম রয়েছে। মেয়েশিশুদের তুলনায় ছেলেশিশুদের অটিজমের বৈশিষ্ট্য থাকার আশঙ্কা প্রায় ৪ গুণ বেশি। বিগত ৪০ বছরে সারা বিশ্বে অটিজমের হার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। এর মূল কারণ, বারবার অটিজমের সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছে, ফলে অটিজমের বৈশিষ্ট্যের পরিধি বেড়েছে।
তৃণা ফোনের নেটটা বন্ধ করে বেডরুমে ঢুকলো। শুয়ে থাকা ঋজুর পাশে গিয়ে বসলো আসতে করে।পিকু অঘোরে ঘুমাচ্ছে, কি নিষ্পাপ সেই মুখ। ঋজু ও গভীর ঘুমে। ঋজুর মাথায় হাত বুলিয়ে শুতে যাবে এমন সময় ঋজু তৃণাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের ওপর শুইয়ে দিল। আধো আধো গলায় বললো ” তৃণা আমরা দুজন মিলে দেখো আমাদের ছেলেকে সুন্দর মানুষ করবো ,আর তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি পারলে ক্ষমা করে আমায় একটু বেশি ভালোবেসে দিও। তোমার মত খিটখিটে বউকে আমি ছাড়া কে ভালোবাসবে বলো?”
তৃণা ঋজুর হাতটা খামচে দিয়ে বললো ” তোমার মত বাজে বর দুটো নেই। শোনো না এসব ছাড়ো আমি ঠিক করেছি আমি অটিজম নিয়ে কাজ করে যেসব ngo তাঁদের সাথে যুক্ত হবো তাঁদের সাথে থেকে কিছু কাজ করবো বাচ্চাগুলোর জন্য ।শনি রবিবার ছুটি থাকে পিকুকে নিয়েই চলে যাবো।ও বন্ধু পাবে আর কিছু আমাদের মত বাবা মার পাশে দাঁড়ানো হবে। কি বলো?”
ঋজু তৃণার চুলটা হালকা করে টেনে ধরে বললো ” শোন বিয়ের পর আমি বলে কিছু হয়না যা হয় আমরায় হয়। তুই একা কেন আমরা তিনজনই যাবো বুঝলি?”
তৃণা আরো একটু ঋজুর কাছে এগিয়ে গিয়ে পাশের নাইট ল্যাম্পটা বন্ধ করে দিল। ঘরে নামলো গভীর আঁধার দিগন্তে দাঁড়িয়ে রায় পরিবার আর এক নতুন মায়াবী আলোময় পৃথিবী অপেক্ষা করছে ঠিক ওপরেই তাঁদের জন্য যে নতুন সূর্যের আলোয় মনের দৈন্যতার অন্ধকার দূর হয়ে যাবে নিমেষে যে পৃথিবীতে শুধু ভালো থাকা আর ভালো রাখার গল্পরা বাসা বাঁধে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *