রবিঠাকুর আমার রবিঠাকুর তোমারও
সোমা নায়ক (কলকাতা)
— আলাদীন…আলাদীন এলি? ভাই আমার…
— হ্যাঁ গো নতুন দিদা, এই তো আমি, দেখ, দেখ, আমায় ছুঁয়ে দেখ, এই তো আমি, একদম তোমার কাছে।
— হাসালে দাদা তুমি, যার কাছে পৃথিবীর অর্থই হল একটা অন্ধকারের গোলা সে কি করে দেখবে ভোরের সূর্য! তবে হ্যাঁ, মনের আলোয় আমি তোমায় দেখতে পাই সোনা। সব দেখতে পাই, এই যে স্বপ্নের রঙ হলুদ, ভালোবাসার রঙ লাল, আবার কান্নার রঙ যে ঘন ময়ূর কন্ঠী নীল সে তো আমি মনের আলোয় বুঝতে পারি দাদা।
—আচ্ছা নতুন দিদা, তুমি তো চোখে দেখতে পাও না, তোমার গায়ের চামড়া, মাথার চুল, তোমার পুরো শরীরটা আগুনের হলকায় ঝলসে গেছে, তবু, তবু তুমি এমনভাবে ভাবতে পার কিভাবে গো?
— আমার যে ঠাকুর আছে দাদা, সমস্ত খেদ, জীবনের সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রনা আমি যে ঠাকুরের চরণে সঁপে দিয়েছি ভাই।
—নতুন দিদা, তোমাকে সবাই এত কষ্ট দিয়েছে, অবহেলা করেছে, রবিঠাকুরকে জীবনের ধ্যান জ্ঞান ভেবেছ বলে লোকে ব্যঙ্গ করেছে, বই পড়তে ভালোবাসতে বলে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ছুঁড়ে দিয়েছে, তাও তুমি এমন ভাবে কি করে ভাবতে পার গো।
— জীবনের নিয়মই তো তাই দাদা, কোথাও সুখ তো কোথাও দুঃখ, তবু আমাদের বাঁচতে ভুললে চলবে কেন শুনি?
—জীবনের এতো ওঠা পড়া দেখেছ, এতো কিছু সহ্য করেছ তুমি, তবু তোমার ঠাকুরকে তুমি ভুলতে পারনি। কি করে পার তুমি নতুন দিদা, এমন ভাবে ভাবতে, এমনি করে থাকতে?
— পাগল ছেলে। মানুষ নিজেকে কখনো ভুলতে পারে? শত কষ্টে ষও আপন মানুষদের কখনো ভোলে না তো!এই যে আমার তিন কাল গিয়ে এককালে এসে ঠেকেছে তুমি কি আমায় নতুন দিদা না বলে পুরনো দিদা বল? বল না তো। তোমার কাছে আমি যেমন পুরনো হয়ে ষও নতুন দিদা হয়ে থেকে গেছি তেমনি আমার ঠাকুর।
— কি সুন্দর করে সব কিছু কেমন গল্পের মতো বুঝিয়ে বল গো তুমি!
— হা হা হা… গল্পই বটে। তা আমার জিনিসটা এনেছিস ভাই, আমার পুজোর ফুলটুকু? এই আকুল করা সময়ে আমার যে মন আর টেকে না, ওরে।
— হ্যাঁ গো হ্যাঁ, এনেছি, অনেক ফুল এনেছি, গাছে অনেক টগর ছিল, চাঁপা ছিল, রজনীগন্ধার সাথে করবীও ছিল, সব এনেছি তোমার জন্য।
— ঠাকুর আমার, আমার প্রাণের দেবতা, আমার সকল ব্যথার একমাত্র ওষুধ
— এনেছি, বামদিকের ওই চেয়ারের ওপর মেলে দিয়েছি টগরের চাদর, আর তার ওপর তোমার ঠাকুর বসে আছেন। এই দেখ নতুন দিদা, এই যে, এদিকে। তুমি হাতটা একটু বাড়াও। ছুঁয়ে দেখতে পার তোমার ঠাকুরকে।
— ও মা! ঠাকুর কি আমার একার গো, ঠাকুর তো সবার, তোমার আমার, সারা বিশ্বের ঠাকুর উনি। তুমিও তাঁকে ভালোবাসো ভাই, সম্মান করো, স্মরণ কর কোনো কারণ ছাড়াই। জীবনের সব দুঃখ নিঃশেষ হয়ে যাবে, জীবনের সমস্ত সুখ শতগুণ হয়ে ফিরে আসবে । তাঁর সৃষ্টির সামনে মাথা নোয়ালে দেখো জীবনে অপ্রাপ্তি বলে আর কিছু থাকবে না।
— নতুন দিদা! জানো তো, তোমার কাছে এলে আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই।
— ভাঙা ভাঙা অক্ষর জুড়ে জীবন পড়তে শিখিয়েছিল যে মানুষটা, সেই যখন আমার হাত ছেড়ে দিয়ে চিরদিনের জন্য একা করে দিয়ে চলে গেল তখন বুঝেছিলাম রবিঠাকুর আসলে কি, কেমন তাঁর সৃষ্টি,
জীবনের সব সাচ্ছন্দ্য হারিয়েও আসল সুখ তো আমি হারাই নি দাদা। কত জ্বালা, কত যন্ত্রণার ছোঁয়ায় পাথর হয়ে যাওয়া আমি কাঁদতে পেরেছি, হাসতে পেরেছি, শান্ত মনে ঠাকুরকে ডাকতে পেরেছি, তা যে আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি।
তুমিও দাও ভাই, অঞ্জলী দাও, ভালোবাসার ফুল দিয়ে কিনে নাও আলো, শান্তির সুর, অপার আনন্দ।
আলাদিনের মোবাইল থেকে ভেসে আসছে সুর …..তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি…..
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও। আমিও তোমার সাথেই আছি দিদা। আর শুধু আমি নয়, সারা বিশ্বের মানুষ প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত পুজো করছে, জীবনের আধার বানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পেয়েছে।
নতুন দিদা, তোমার চোখে জল, মুখে তৃপ্তির দ্যুতি। যেন জীবন থেকে জীবনে ছড়িয়ে পড়ছে আলো, বিশ্বাসের ভিত, ভালোবাসার আশা।