আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস আজ
কাজী নূর।। ‘কুলি মজুর’ কবিতায় বিদ্রোহী কবি নজরুল বলেছিলেন,
“তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি/তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি/তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান/তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান”!
আজ পহেলা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। পহেলা মে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের রক্তঝরা দিন, শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান এবং সংহতি জানাবার দিন। ঐতিহাসিক আন্দোলন এবং রক্তঝরা সংগ্রামের পুণ্যস্মৃতির সম্মানে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়ে থাকে। অসংখ্য প্রশ্নের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগো শহরের হে মার্কেট নামক স্থানে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছিলেন বহু শ্রমিক। ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী মে মাসের প্রথম দিন মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল ও শ্রমিক সংঘের প্রতি আহ্বান জানায় সমাজতন্ত্রীরা। এ আহবানে সাড়া দিয়ে বিশ্বের প্রায় সব শ্রমিক সংগঠন পহেলা মে বাধ্যতামূলক কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই থেকে পহেলা মে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের চরম আত্নত্যাগ আর ন্যায্য অধিকার আদায়ের অবিস্মরণীয় এক দিন। দিনটিকে আমরা মে দিবস বলেও জানি। শ্রমিকদের প্রতি সম্মান জানিয়ে মে দিবস বা পহেলা মে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ।
বর্তমান বিশ্বে আজও শ্রমজীবী মানুষেরা নির্যাতিত নিপীড়িত। পান না তাদের ন্যায্য মজুরি। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এ অবস্থা ছিলো আরো খারাপ। তখন শ্রমিকরা দিনে ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করলেও তার বিনিময়ে সামান্য মজুরিও পেতেন না। উপরন্তু ছিলো মালিক পক্ষের অনবরত অকথ্য নির্যাতন। ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা তাদের মজুরি না কমিয়ে সারাদিনে ‘আট ঘণ্টা’ কাজের সময় নির্ধারণের জন্য দাবি জানান। এ জন্য তারা একটি সংগঠনও (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতিষ্ঠা করেন। যার নাম দেয়া হয় ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’। এই সংগঠন শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিয়মিত আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। ১৮৮৪ সালে সংগঠনটি কাজের সময় ‘আট ঘণ্টা’ নির্ধারণের জন্য মালিক পক্ষের কাছে সময় বেঁধে দেয়। শ্রমিকেরা দাবি পূরণের সময়সীমা দেয় ১৮৮৬ সালের পহেলা মে পর্যন্ত। বারবার মালিক পক্ষের কাছে দাবি জানানো হলেও একটুও সাড়া মেলেনি তাদের কাছে। উত্তাল সে মুহুর্তে এ বিষয়ে আর্টিকেল প্রকাশিত হয় একটি পত্রিকায়। প্রকাশিত এ আর্টিকেল ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এরপর বিদ্রোহের পারদ ওঠে চরমে। আর শিকাগো হয়ে ওঠে প্রতিবাদ- বিদ্রোহের মূলমঞ্চ। পহেলা মে যতই এগিয়ে আসছিল, দুই পক্ষের সংঘর্ষ অবধারিত হয়ে উঠছিলো। মালিক- বণিক শ্রেণী ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলো। এর মধ্যে পুলিশ আগেই তাদের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিলো। আবারও চলছিলো তেমন প্রস্তুতি। শ্রমিকদের উপর গুলি চালাতে পুলিশদের বিশেষ অস্ত্র কিনে দেন ব্যবসায়ীরা। পহেলা মে’তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ ফেলে নেমে আসেন রাস্তায়। দাবি আদায়ের আন্দোলন সংগ্রাম চরমে ওঠে। ১৮৮৬ সালের ৪ মে সন্ধ্যাবেলা শিকাগো’র হে মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় জড়ো হওয়া শ্রমিকদের দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছু পুলিশ সদস্য। এমন সময় হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণে কিছু পুলিশ আহত হন। মারা যান ছয়জন। পরে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ চালালে ১১ জন শ্রমিক নিহত হন। পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করে ছয়জনকে প্রহসনমূলক দোষী সাব্যস্ত করে প্রকাশ্যে ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
কিন্তু এই মিথ্যা বিচারের অপরাধ শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। ২৬ জুন ১৮৯৩ ইলিনয় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিথ্যা ছিলো ওই বিচার। অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় পুলিশের কমান্ডারকে। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের দৈনিক ‘আট ঘণ্টা’ কাজ এর দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত প্রথম কংগ্রেসে শিকাগো শ্রমিক আন্দোলনের দিনটিকে ১৮৯০ সাল থেকে পালনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। পরের বছর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে প্রস্তাবনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ, ভারত, রাশিয়া, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পহেলা মে দিনটির তাৎপর্য ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে পহেলা মে পালিত হয় শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে। মে দিবসে সকল শ্রমজীবী মানুষ তাদের ভাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার মাধ্যমে উন্নয়ন এবং গণমুখী পরিবর্তনের অঙ্গিকারে আবদ্ধ হয়। জয় হোক সাম্যের। জয় হোক পৃথিবীর সকল মেহনতি মানুষের।