উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদ-এর মুখোমুখি
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
উপেক্ষিত ও অনগ্রসর জাতির মান-মর্যাদার অন্বেষক কবি, গবেষক, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, সমাজ সচেতন নাগরিক এবং ‘উদার আকাশ’ জার্নাল ও ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন সংস্থার কর্ণধার ফারুক আহমেদ-এর একটি মনোমুগ্ধকর সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমি ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম। বর্তমানে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায় অবস্থিত নওগাঁ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আমি কর্মরত। সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, তরুণ গবেষক ফারুক আহমেদ দেশকাল, সমাজ ও সময় সম্পর্কে জীবন অভিজ্ঞতার ঝাঁপি নিয়ে সমাজে মানসে অবতীর্ণ হয়েছেন। বিশেষত তাঁর চেতনা ও যুক্তিনিষ্ঠ অনুসন্ধিৎসার ফলে পাঠক সমাজ দৃশ্যমান জীবনকে কেবল আড়াল থেকে দেখছেন—এমন না; বরং বাঙালির জাতিসত্তার বিবেকের সন্ধান তার অগ্রগামী প্রচেষ্টার কারণে দৃশ্যমানতা পেয়েছে। বিস্ফোরক ও মর্মস্পর্শী সাক্ষাৎকারটির স্বরূপ এক ঝলক অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করছি।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: আপনার জন্ম, গ্রাম, বেড়ে ওঠা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলুন।
ফারুক আহমেদ: আমার জন্ম ১৯৮৩ সালে ৭ মার্চ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার নাটাপুকুর গ্রামে। অতি সাধারণ পরিবার থেকে আমি এ পর্যায়ে এসেছি। পাড়াগ্রামে বসবাসরত মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সন্তান হিসেবে আমার বেড়ে ওঠা। পল্লিপ্রকৃতির আবেষ্টনে রঞ্জিত ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, মনমাতানো নয়নাভিরাম এক মনোরম পরিবেশ দ্বারা আচ্ছাদিত আমার বেড়েওঠা গ্রামটি। সেই সঙ্গে মনোরম পরিবেশের আবহে বিরাজিত গ্রামটির নির্জন প্রকৃতি। এই গ্রামের মানুষ যেমন সহজ-সরল ও হার্দিক, তেমনই সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির বন্ধনে অটুট। পাড়াগ্রামের আর দশজন ছেলের মতোই আমি গ্রামেই বেড়ে উঠেছি। গ্রামটিতে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে সম্প্রীতিতে একাকার হয়ে উৎসব ও পার্বণসমূহ পালন করে। নাটাপুকুর গ্রামেই আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। এই গ্রামে অবস্থিত প্রাথমিক স্কুল থেকেই আমার অর্জিত হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা ঘটকপুকুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং ভাঙড় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হই। ফলে গ্রামেই আমার শেকড়ের সন্ধান ও যোগসূত্র নিহিত রয়েছে। কর্মক্ষেত্রের তাগিদে বর্তমানে কল্যাণীতে বসবাস করলেও সময় পেলেই নাড়ির টানে ছুটে আসি আমার সেই চিরচেনা মায়াময় গ্রামটিতে। আমি কর্মজীবন শুরু করি মুর্শিদাবাদ জেলার বসন্তপুর এডুকেশন সোসাইটিতে অফিস সেক্রেটারি পদে। প্রায় এক যুগ ধরে শিক্ষা প্রসার ঘটাতে বসন্তপুর গ্রামেই কেটে যায় প্রথম চাকরির জীবন।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: সংস্কৃতি জগতে আসার জন্য অনুপ্রেরণা পেলেন কীভাবে? কীভাবে এলেন?
ফারুক আহমেদ: বাল্যকাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকার ফলে সংস্কৃতির জগতে আমার অনুপ্রবেশ। আমার আব্বা মোঃ আবেদ আলী লেখক ও সমাজকর্মী হিসেবে এলাকায় বেশ স্বনামধন্য। আব্বার গল্পগ্রন্থ ‘অন্য গাঁয়ের আখ্যান’ বেস্টসেলার। ফিরে আসি পরবর্তী কথায় ব্যক্তি পর্যায়ের জীবনধারা, মূল্যবোধ, সামাজিক ঐতিহ্যের ভিত্তিগুলো ক্রমবর্ধমান সৃষ্টির প্রয়াস স্বরূপ, সম্যক পরিচয়ের হাতছানি আমাকে এ জগতে নিয়ে আসে। সেই সাথে লোকজীবনধারা ও শুভ-অশুভবোধ আমার কাছে আহরিত আচরণ হিসেবে স্থান করে নেয়। এরই প্রেক্ষিতে সমাজ মানস আমার কাছে ‘মানব সংগঠন’ হিসেবে আকার লাভ করে। ফলে সংস্কৃতির জগৎ আমার কাছে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ধরা পড়ে। বিশেষ করে বাঙালি সমাজের শ্রেণিহীনতা আমার কাছে ‘মানব সংগঠন’ হিসেবে দৃষ্টিজাত।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: আপনি কি কোনও আদর্শ বা উদ্দেশ্যের কথা মাথায় রেখে সংস্কৃতি চর্চা, সম্পাদনা করে থাকেন?
ফারুক আহমেদ: আমি ব্যক্তিগত কোনও আদর্শ, উদ্দেশ্য বা দর্শনকে সামন রেখে সংস্কৃতি চর্চা ও সম্পাদনা করি না। কারণ সংস্কৃতির উদ্দেশ্য হল আনন্দ দান। সাহিত্য সংস্কৃতির সেবাই মূলত আমার উদ্দেশ্য, যা একান্ত ভাবনার ফসল। আর সংস্কৃতির কাজ হল—সত্যকে ভালোবাসা, সৌন্দর্যকে ভালোবাসা, ভালোবাসাকে ভালোবাসা, বিনা-লাভের আশায় ভালোবাসা এবং নিজের ক্ষতি স্বীকার করে অন্যকে ভালোবাসার নাম সংস্কৃতি। আমার সংস্কৃতি ও সম্পাদনা এরই ধারক এবং বাহক। ক্ষেত্র বিশেষে আদর্শ বা উদ্দেশ্যের অন্তরালে প্রত্যাশা-প্রাপ্তি থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সংস্কৃতির মধ্যে কোনও প্রাপ্তি থাকে না। বিধায় সংস্কৃতিবান মানুষ কোনও প্রাপ্তির আশায় কাজ করেন না। আমার ক্ষেত্রেও এমনটি ভাবতে পারেন।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: সম্পাদনা জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলুন।
ফারুক আহমেদ: আমার সম্পাদনা জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে দু-একটি কথা না বললেই নয়, কারণ প্রথম পর্বে সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে আর্থিক কষ্ট ছাড়াও অনেকেই আমাকে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করতেন। আমার একান্ত আপনজন নন, এমন একজন পরিচিত মানুষ পত্রিকা বিক্রি করার জন্য আমাকে তাচ্ছিল্য করতেন। আমি সেগুলোকে মোটেও আমলে নিতাম না। এমনকি নীরবে সম্পাদনাকর্ম চালিয়ে এসেছি। আমি তাদের কথায় যদি কান দিতাম, তাহলে হয়তো-বা আজকের এই ‘উদার আকাশ’ প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করতে পারতাম না। তবে তাদের বিশেষণ আমাকে পথ চলতে অনেকটা সচেতন করেছে। আজ বলতেই হচ্ছে পিছিয়ে থাকা পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমানের ক্ষেত্রে এমন একটি কাজ সম্পাদন করার বিষয়টি একেবারে সহজ নয়। আরও উল্লেখ্য যে, আমি স্কুল ও কলেজ পর্বে অধ্যয়নকালে পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত হই। বলতে পারেন প্রায় তিন দশক ধরে চলছে আমার সম্পাদনার কাজ। কলেজে পড়ার সময় টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে, বন্ধু-বান্ধবীদের সহযোগিতায় প্রথম ‘উদার আকাশ’(২০০২ খ্রি.) পত্রিকা প্রকাশ করি। বর্তমানে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা আন্তর্জাতিক পর্বে (ISSN) রিসার্চ জার্নাল হিসেবে অবস্থান করে নিয়েছে। এমনকি ভাষা সাহিত্যের পিয়ার রিভিউড দ্বিভাষিক ষান্মাসিক রিসার্চ জার্নাল হিসেবে উভয় বাংলায় পরিচিতি পেয়েছে। এই জার্নালে দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা গবেষক, প্রাবন্ধিক, কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকের মানসম্পন্ন ও গুণগত লেখা প্রকাশিত হয়। এখন ‘উদার আকাশ’ কেবল একটি নাম নয়; বর্তমানে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পশ্চিমবাংলায় ব্যাপক পরিচিত পেয়েছে। আমি বলতে পারি আমার সম্পাদনায় কালজয়ী কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হল: প্রবন্ধ সংকলন ‘প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়ন’, ‘ফুরফুরা শরিফের পয়গাম’, ‘কংগ্রেস ও বামশাসনে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক’, ‘পশ্চিমে সূর্যোদয় রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উলটপুরাণ’, ‘বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে কাজী নজরুল ইসলাম’ এবং ‘বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম’। একটি ইংরেজিতে লেখা গ্রন্থও আমি সম্পাদনা করেছি। ইতিমধ্যে আমার সম্পাদিত ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা ‘সংখ্যালঘু ও মুখ্যমন্ত্রী’, ‘মর্যাদার সন্ধানে’, ‘আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ’, ‘আত্মবিকাশের দর্পণ’, ‘রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অনগ্রসর ও সংখ্যালঘু’, ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’, ‘ভূমিপুত্রদের জাগরণ’ এবং ‘কুৎসার জবাব উন্নয়ন’। রাজ্য-রাজনীতিতে পালাবদলের সন্ধিক্ষণে এই প্রয়াস বঙ্গবাসীকে সচেতন করেছে। আগামীতেও মানুষের মর্যাদার সন্ধানে উদার আকাশ-এর প্রয়াস অটুট রাখতে আমি দৃঢ়সংকল্প।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: আপনার দৃষ্টিতে সাংস্কৃতিক জীবনে আপনার উল্লেখযোগ্য কাজ কী কী?
ফারুক আহমেদ: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত ও বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে ভারতে স্বাধীনতা আসে। স্বাধীনতার ফলে ভারতের সনাতন ঐতিহ্য অপরকে নিয়ে চলার সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদ বিষয়গুলো ধ্বস্ত হয়ে যায়। বস্তুতপক্ষে এই দেশভাগ হতে পারত নাড়িয়ে দেওয়ার মতো একটি বিষয়। অথচ বাস্তবে তা আর হল না। স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান সমাজ দেশভাগের কারণে অনেকটা কাঙাল হয়ে পড়ে। এ সময় মুসলিম এলিট শ্রেণির মানুষ বাংলাদেশে চলে যান। ফলে পশ্চিম বাংলায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ প্রায় দেশশূন্য হয়ে পড়ে। ঘোরতর সাম্প্রদায়িকতায় ক্লিষ্ট পরিবেশে দেশ খণ্ডিত হওয়ার পর পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের প্রতিকূল অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটি খুব সহজ ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের একটি বিরাট অংশ মুসলমানদের সংখ্যালঘু জাত হিসেবে মনস্তাত্ত্বিক অভিযোজনের সমস্যাটি অত্যন্ত লঘু হিসেবে দেখছিলেন। এমনকি পাত্তাও দিতে চাননি। উপায়হীন হয়ে এ বঙ্গে যেসব মুসলমান থেকে যান, তাঁদের মধ্যে সামাজিক শূন্যতা, মানসিক নিষ্ক্রিয়তা ও হতাশা গ্রাস করে বসে। এমনতর পরিস্থিতিতে এই বঙ্গের মুসলমান সমাজ বিদ্যাশিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চার দিক থেকে একেবারে পিছিয়ে পড়ে। এই পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান সমাজকে মূলস্রোতে আনয়নের নিমিত্তে অকিঞ্চিৎ আগ্রহ নিয়ে সংস্কৃতির উন্নয়নে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। পত্রিকাটি সকল সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির সেতুবন্ধন হিসেবে সংস্কৃতির উত্তরণ ঘটানোর নিমিত্তে তারই প্রয়াস ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সংস্কৃতির বিকাশে ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন থেকে উল্লেখযোগ্য অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যেগুলো কেবল কালজয়ী সৃষ্টি হিসেবেই বিবেচিত নয়; বরং কালের আবর্তে হারিয়ে যাওয়া তথ্যনির্ভর গ্রন্থ হিসেবে জনসমাজে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন থেকে ১২১টির অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: মুসলিম সমাজের কাছে কেমন সাড়া পেয়েছেন? প্রতিবেশী হিন্দু সমাজ কেমন সাহায্য করেছে?
ফারুক আহমেদ: পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান সমাজ আমাকে প্রান্তজনের সাহিত্যিক হিসেবে মনে করেন। কারণ প্রান্তজনের সন্ধান ও তাঁদের মূল্যায়নে সংস্কৃতির আহরণ ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার অন্যতম উপজীব্য বিষয়। সে লক্ষ্যে হিন্দু ও মুসলমান সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে আমার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে কথাটি আমি বলতে পারি। তা-না হলে পশ্চিমবাংলার অনেক নামীদামি ও ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশেষ সম্মানের অধিকারী লেখক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, গল্পকার, ছড়াকার প্রভৃতি লেখকবৃন্দ ‘উদার আকাশ’ পত্রিকায় লেখা প্রকাশের সুযোগ দিয়ে সহায়তা করতেন না। এক কথায় বলতে পারেন, উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ সমান আবেদন নিয়ে সম্পাদক হিসেবে ফারুক আহমেদের পাশে থেকে ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন সংস্থাকে লেখা দিয়ে ও নৈতিকভাবে সমর্থন জানিয়ে আসছেন। বলতে পারেন লেখক সমাজের সাধারণ ধর্ম হল মানবতার জয়গান ঘোষণা করা। সেক্ষেত্রে ধর্ম কোনও বিষয় নয়। সবধর্মের মানুষ ও লেখকবৃন্দের কাছে যেমন সাড়া পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল, ঠিক তেমনই সাড়া ও সহযোগিতা পেয়েছি কথাটি বলতে পারি। আর ‘উদার আকাশ’ সংস্থা কোনও ধর্মবর্ণের আবরণে আবদ্ধ নয়; বরং বলতে পারি উদার জীবনের অন্বেষণই ‘উদার আকাশ’ সম্পাদকের জীবন চলার ব্রত। আরও উল্লেখ্য যে, সমাজকল্যাণ ও আধুনিক শিক্ষা প্রসারের অনন্য কান্ডারি পতাকা হাউসের কর্ণধার মোস্তাক হোসেন সর্বদা ‘উদার আকাশ’ প্রকাশনীকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়ে আসছেন। এছাড়াও আরও অন্যান্য সাহায্যকারী সংস্থা ‘উদার আকাশ’ প্রকাশনের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতায় দিগন্ত প্রসারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। আমি তাদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল এবং চিরকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: লেখক তৈরির ক্ষেত্রে আপনি কতটা সফল?
ফারুক আহমেদ: একজন সম্পাদক কখনও লেখক তৈরি করতে পারেন না। এমনকি সমাজের কোনও মানুষের পক্ষে কখনও লেখক তৈরি করা সম্ভব নয়। তবে নাম না-জানা অনেক প্রতিভাধর মানুষ আছেন যাঁরা লেখালেখি করেন, কিন্তু লেখা প্রকাশ করার মাধ্যম খুঁজে পান না; তাঁদের পাশে আছে ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন ও জার্নাল। বিশেষ করে পর্দার আড়ালে থাকা প্রতিভাবান লেখকসমূহ আর্থিক ও অন্যান্য কারণে লেখা প্রকাশ করতে পারছেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে ‘উদার আকাশ’ সংস্থা কোনওরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই মানসম্মত ও মৌলিক লেখা প্রকাশ করতে প্রস্তুত আছেন। এক্ষেত্রে বলতে পারেন, উপেক্ষিত ও অনগ্রসর শ্রেণির অভাব-অনুযোগ আদায় করে তাদের প্রাপ্য অধিকার পাইয়ে দিতে সমাজের কল্যাণে জাতিসত্তার মর্যাদার অন্বেষক ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা ও ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন সংস্থা নির্মোহ আবেদন নিয়ে কাজ করছেন। বলে নিতে হয় যে, সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখার নিমিত্তে ও মুক্তবুদ্ধি চর্চায় ‘উদার আকাশ’ জার্নালে যেসব খ্যাতনামা লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়ে আসছে সেগুলো ইতিমধ্যেই মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটেছে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আকাশ দেখানোই সাহিত্যিক ফারুক আহমেদ-এর স্বপ্ন ও পথচলা। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু লেখক উদার আকাশ পত্রিকায় লিখে স্বনামধন্য সাহিত্যিক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন পাঠক দরবারে।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আপনি অনেক পরিশ্রম করেছেন৷ এই জার্নিটাকে কীভাবে দেখবেন?
ফারুক আহমেদ: ‘পরিশ্রমে ধন আনে, পুণ্যে আনে সুখ। আলস্যে দারিদ্র্য আনে, পাপে আনে দুঃখ।’ একজন মানুষকে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় এই খনার বচনটির আবেদন নানাভাবে অর্থবহন ও গুরুত্বপূর্ণ। আমিও এই বচনটির সাথে সহমত পোষণ করে বলতে পারি জীবনে পরিশ্রম ছাড়া কখনওই সাফল্য আসবে না। এ বিষয়ে আবারও একটি প্রবাদের প্রসঙ্গ এনে বলতে হচ্ছে ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’-কর্মের সাথে মানুষের ব্যক্তিজীবনের সাফল্য নির্ধারিত। আমি স্কুল জীবন থেকে মহৎ এই প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছি। কখনও হাল ছেড়ে দিইনি, তাই আজকে এমন একটি পর্বের সন্ধান পেয়েছি। জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ‘উদার আকাশ’ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আপনাদের মতো মানুষ আমার সঙ্গে ছিলেন-আছেন বলেই এই পথচলা অনেকটা সহজতর হয়েছে। তবে এই জার্নিটা একেবারে সহজ নয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হল ধৈর্য ধরা শিখতে হয়। আমি এই পর্যায়ে আসতে অনেক কিছু অর্জন করেছি। যার মূল অস্ত্র হল ধৈর্য। যিনি সততা ও ভালো মনমানসিকতা নিয়ে ধৈর্যধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাইবেন তিনি সফলতার দেখা পাবেন। মানুষ ধৈর্যধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে অনাগত সাফল্যকে পেয়ে যান। অনিবার্যভাবেই সাফল্য আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নেবে— এমন বিশ্বাস আজ আমার অর্জিত হয়েছে। পবিত্র কোরানেও এমন কথা বলা হয়েছে ‘নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই আছেন।’ আমার ক্ষেত্রেও এমনটি বলতে পারেন। আরও বলে নিতে হয় আমার মা ফজিলা বেগম সর্বদাই পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে সাহায্য করে আসছেন। আর্থিক দৈন্যতা লাঘবের নিমিত্তে পত্রিকা প্রকাশের জন্য নিজের গহনাদি বন্ধক রেখেছিলেন আমার গর্ভধারিণী মা। পরবর্তী সময়ে আমাকে পত্রিকা প্রকাশের জন্য এবং প্রকাশন সংস্থা চালাতে পাশে থেকে উৎসাহ দিয়ে আসছেন আমার সহধর্মিণী মৌসুমী বিশ্বাস ও কন্যা রাইসা নূর।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: সাম্প্রতিক চর্চা, সাহিত্য, সমাজ নিয়ে আপনার ভাবনার কথা কিছু বলুন?
ফারুক আহমেদ: সাহিত্য চর্চা সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই যে কথাটি না বললেই নয়, সেটি হল—আমি ছাত্রজীবন থেকে কবিতা পড়তে ভালোবাসতাম। বিশেষ করে কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর লেখা কবিতাসমূহ আমাকে উদ্দীপনা দিয়েছে। পরবর্তীতে আমি কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর কবিতাগুলো পড়ে কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা লাভ করি। বলতে পারেন সেখান থেকেই আমার সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি। সম্প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে সৃষ্টি সম্ভারে কাজী নজরুল ইসলাম ও নজরুল চর্চার একটি অনন্য অধ্যায় প্রেক্ষিত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এই কবিকে নিয়ে নানা মাত্রা ও পর্বে অনুশীলনের প্রচেষ্টা ‘উদার আকাশ’ জার্নাল ও গ্রন্থ সম্পাদনার মধ্য দিয়ে অব্যাহত রয়েছে। সাহিত্য চর্চা ও অনুশীলনের প্রকৃতি হিসেবে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ক্রমান্বয়ে আমার বর্ধিষ্ণু জীবনের পরিচয়বাহী রূপ ও স্বরূপ দৃশ্যায়িত হয়েছে। সাহিত্য চর্চা করতে গিয়ে আমার একটি বিষয় মনে হয়েছিল যে, এই চর্চা করতে গেলে একটি মুখপত্রের প্রয়োজন হয়। সে দিকটি মাথায় রেখে আমি ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করি। পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে প্রথম দিকে তেমন সাড়া পেতাম না। তবে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি বের হওয়ার পর থেকে মানুষের সাহচর্য ও সাড়া পেতে থাকি। পর্যায়ক্রমে সমাজমনস্কতার আবেদনগুলো এই পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে মানুষের মাঝে আমি পরিচিতি পেতে খাকি। বিশেষত সমাজ ভাবনার মূল্যবোধগুলো তুলে ধরে সৃষ্টিশীলতাকে অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করি। আর এই অনুষঙ্গকে জোরদার করতে লেখা দিয়ে অসংখ্য সাহিত্যিক প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়েছেন। অসংখ্য লেখক-সাহিত্যিকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন, শঙ্খ ঘোষ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, মহাশ্বেতা দেবী, আবুল বাশার, নজরুল ইসলাম, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, সুবোধ সরকার, বর্ণালি হাজরা, মীরাতুন নাহার, ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ, সুরঞ্জন মিদ্দে, জয়ন্ত ঘোষাল, রাজন গঙ্গোপাধ্যায়, মইনুল হাসান, আমজাদ হোসেন, সুমিতা চক্রবর্তী, মীর রেজাউল করিম, সাইফুল্লা, অনিকেত মহাপাত্র, গোলাম রাশিদ, লালমিয়া মোল্লা, আবদুর রব খান, রফিকুল ইসলাম, ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, রোকেয়া ইসলাম, সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। আমি এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা কামনা করি যেখানে মানুষের মূল্যবোধ ও মানবতা সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। সেখানে থাকবে না কোনও ধর্মীয় ও সামাজিক ভেদাভেদ। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সমান গুরুত্ব পাবে। বাঙালি ও বাঙালি মুসলমান সমাজের কোনো বর্ণবৈষম্য আমার কাম্য নয়। কবি চণ্ডীদাসের সাথে একমত হয়ে আমিও বলতে চাই—‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই’-কথাটি। ভারতে হিন্দু-মুসলমানের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির অটুট বন্ধন আমি দেখতে চাই। সেই সাথে ঘুমন্ত তরুণ সমাজের জাগরণও আমার প্রত্যাশা। তরুণ সমাজ জাগ্রত হলে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কখনও আর থাকবে না। সে কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে তরুণ সমাজের জাগরণ প্রত্যাশা করি। তরুণ সমাজ জাগ্রত হলে বাঙালি সমাজের যুবা প্রত্যাশাগুলো সহজেই পূরণ হবে—এমন আশাবাদই আমার কাম্য।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: আগামীতে আর কী কী পরিকল্পনা আছে?
ফারুক আহমেদ: আগামীর ভবিষ্যৎ বড়ই কঠিন হবে—এমন কথা আমি মনে করতে পারি। এর কারণ হিসেবে দেখতে পাই সভ্যতার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বড়ই অভাব রয়েছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে আমারা না দেখে কেবল ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিতি পাইয়ে দিতে চাই। যা অনাগত শৃঙ্খল বিনষ্ট হওয়ার অন্যতম প্রয়াস। সমগ্র ভারতে অধুনা ধর্মীয় অস্থিতিশীলতা লক্ষযোগ্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। এর বিপরীতে আমার অবস্থান। আমি শান্তিকামী ও শান্তিপ্রিয় একজন মানুষ হিসেবে সর্ব ভারতীয়দের সুখ-শান্তি কামনা করি। আর এই সুখ-শান্তির আবেদনসমূহ অক্ষুণ্ন রাখতে ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন ও ‘উদার আকাশ’ জার্নাল নিরলসভাবে কাজ করে যাবে। এক্ষেত্রে কেবল হিন্দু-মুসললমান নয়, বরং জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষ তথা উপেক্ষিত ও অনগ্রসর জাতিসত্তার সার্বিক কল্যাণ কামনায় আমি ও আমার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কায়মনোবাক্যে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে আগ্রহী। বিশেষত অনগ্রসর শ্রেণির অভাব, অভিযোগ, অনুযোগ আদায় করে তাদের প্রাপ্য অধিকার পাইয়ে দিতে সমাজের কল্যাণে জাতিসত্তার মর্যাদার অন্বেষক হিসেবে উদার আকাশ প্রকাশন সংস্থার কর্ণধার ফারুক আহমেদ কাজ করতে চান। ‘উদার আকাশ’ কেবল পত্রিকা নয়, আত্মমর্যাদার অভিজ্ঞান, উদার আকাশ কেবল স্লোগান নয়, সুস্থ সমাজ গড়ার অঙ্গীকার। উদার আকাশ দিচ্ছে ডাক, ঘরে ঘরে সাহিত্যের আলো পৌঁছে যাক। সব শেষে একটাই চাওয়া বিভেদকামী অশুভ শক্তির পতন সুনিশ্চিত করতে উদার আকাশ প্রকাশন সংস্থা ও উদার আকাশ পত্রিকা বেঁচে থাক সচেতন ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে। সমস্ত সত্যগুলো তুলে ধরাই হোক আমাদের বেঁচে থাকার পাথেয়। মহা মিলনের কামনায় ভারতে সহিষ্ণুতার ‘উদার আকাশ’ এগিয়ে আসুক সবার জন্য। এটি হোক উদার জীবন অন্বেষণে।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম: উদার আকাশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত দুটি বেস্টসেলার বই সম্পর্কে কিছু বলুন?
ফারুক আহমেদ: উদার আকাশ প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত বেস্টসেলার দুই ঐতিহাসিক গ্রন্থের লেখক খাজিম আহমেদ।
পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা:
পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমানদের অন্তবিহীন সমস্যা, তার আত্মানুসন্ধান বা সমাধানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দূরের কথা, ‘কওম’-গত আন্তরিক উদ্যোগও লক্ষযোগ্য হয়ে ওঠেনি। যারা বিষয়টি নিয়ে ভাবিত, সদর্থে চিন্তাভাবনা ও দায়বদ্ধ থাকাটা জরুরি মনে করেন, তাঁরা জানেন যে কেন একটি জাতিসত্তা এত উপেক্ষিত, শিক্ষায় অনগ্রসর, কেন এত দরিদ্র, আর কেনই বা মুসলমান বুদ্ধিজীবী সমাজ স্ব-সম্প্রদায়ের সমস্যাবলির স্বরূপ উদঘাটনে ও নিরসনের দিক নির্দেশ সম্পর্কে আগ্রহী নন।
হালকা একটি আলোর রেখা সম্প্রতি দৃষ্টিগোচর হয়ে উঠছে।
কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানী আলোচ্য সমস্যাবলি নিয়ে গবেষণা করছেন এবং গ্রন্থাকারে তা পাঠকসজ্জনের সামনে পেশ করছেন। এঁদের মধ্যে খাজিম আহমেদ; এই উপমহাদেশ বিষয়ক ইতিহাসবেত্তা গবেষক, দেশ-বিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাঙলার কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী জাতিসত্তার মর্যাদার অন্বেষক, অনন্যসাধারণ প্রাবন্ধিক; বিশিষ্টতম।
এই জাতীয় কাজ আগে হয়নি কখনও, প্রকাশক হিসেবে সে দাবি করছি না। সোজাসুজি বলা যেতে পারে, এই প্রকাশনার মতো নির্মোহ বিশ্লেষণ এর আগে হয়নি।
খাজিম আহমেদ পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষণ মারফত যথার্থ সত্যটা তুলে এনেছেন। এই খানেই তাঁর বিশেষত্ব।
‘উদার আকাশ’-প্রকাশনের পৃষ্ঠপোষক আর শুভানুধ্যায়ীদের সামনে এমন একটি সাহিত্য-নির্মাণ হাজির করতে পেরে আমি ব্যক্তিগতভাবে গর্বানুভব করছি।
‘পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা’ নামক প্রবন্ধগ্রন্থে ঐতিহাসিক খাজিম আহমেদ, একটি জাতিসত্তার ইতিহাস, উত্পণত্তি-বিকাশ, রাজনৈতিক অবস্থান, সামাজিক প্রেক্ষাপট, সাংস্কৃতিক অধৌবিকাশ, ধর্মীয় পরিচয়ের প্রশ্নে উপেক্ষা, ‘মিশ্র সংস্কৃতি’ বা ‘কমপোজিট কালচার’-এর অনিঃশেষ গুরুত্ব, অর্থনৈতিক নিঃসীম দুর্বলতা সর্বোপরি মানবীয় মর্যাদা নিয়ে ‘বেঁচে-বর্তে’ থাকার প্রয়োজনে পরম সাদরে লালিত ধর্মনিরপেক্ষতা কেন প্রয়োজন— ইত্যাকার বিষয় নিয়ে বিস্তৃত চর্চা করেছেন। অগণন প্রবন্ধাদির মধ্যে থেকে ১৭টি রচনা নিয়ে গ্রন্থটি প্রকাশিত।
প্রায় অর্ধ-শতকের ওপর তিনি সহৃদয় পাঠকবর্গের সঙ্গে রয়েছেন। সাবেক বাঙালিয়ানা, মিশ্র-সংস্কৃতি আর সমন্বয়ে বিশ্বাসী খাজিম আহমেদ কলকাতা কেন্দ্রিক প্রায় প্রত্যেকটি দৈনিক সংবাদপত্রসহ বিস্তর লিটল ম্যাগাজিনে কাহন কাহন লিখেছেন। সুজন পাঠক আর বিদ্বত্সরমাজের স্বীকৃতি তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
সঠিক ইতিহাস রচনা করতে গেলে কোনও পক্ষ, কোনও ধর্ম ও মতবাদের প্রতি বিশেষ আস্থা রাখা যে সর্বসময়ে উপেক্ষণীয়, তা তাঁর রচনায় বারে বারে পরিস্ফুট। যেমন বর্তমান গ্রন্থে ‘সেকুলারিজমের সওয়াল’- নামে একটি প্রবন্ধ থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করি। তিনি লিখেছেন, ‘এই দেশীয় মুসলমান সমাজের বেদনা এইখানে যে, স্বধর্মী কোনও ব্যক্তিত্ব তার সমাজের দুর্বলতার দিকটি যুক্তি ও সহানুভূতির সঙ্গে পর্যালোচনা করেননি।… সাধারণভাবে মুসলিম নেতৃত্ব সস্তায় কেল্লাফতে করার জন্য এমন সব দাবি বা সমস্যার কথা তোলেন, যার ফলে অমুসলমানরা (এমনকি প্রগতিশীল অংশও) মুসলমানদের থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।… শুধু মুসলমানদের নিয়ে যদি কেউ একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে চান, তাহলে সুনিশ্চিতভাবে তা হবে মুসলিম স্বার্থ বিরোধী।… একমাত্র জন্মের সুবাদে মুসলমান নেতারা মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করতে সমর্থ, সাধারণ উপেক্ষিত মুসলমান সমাজ আর কতকাল এই ধরনের প্রচারের শিকার হবেন, তা আমাদের জানা নেই।’ দ্য সানডে ইন্ডিয়ান’ – পত্রিকায় (১০ মার্চ, ২০১৩) অত্যাধুনিক সাহিত্যিক, সাংবাদিক অরুণাংশু ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন, ‘আমরাও ঠিক জানি না যে, আমাদের দেখার মধ্যে কোনও মুসলমান ঐতিহাসিক এবং সমাজচিন্তক… এই রকম সত্যতর মন্তব্য করেছেন কি না।’
খাজিম আহমেদ ‘পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা’
(উদার আকাশ, ২০০.০০) বইয়ে বাংলার মুসলমান সমাজের বিভিন্ন দিক আলোচনা করেছেন।
আলোচনায় ফিরে এসেছে দেশভাগের প্রসঙ্গ, সংখ্যাগুরু সমাজের চোখে সংখ্যালঘুদের অবস্থানের মতো প্রসঙ্গ। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)।
প্রবন্ধাদির মধ্যে অবশ্য পাঠ্য ‘একটা উপেক্ষিত জাতিসত্তার উত্থানের ইতিহাস’। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩১ মার্চ, ২০১২)
‘অসাধারণ প্রবন্ধ রচেছেন ঐতিহাসিক ও সমাজতত্ত্ববিদ খাজিম আহমেদ… কাউকে রেয়াত করে কথা বলেননি।’ অরুণাংশু ভট্টাচার্য, (দ্য সানডে ইন্ডিয়ান, ১৩ মে, ২০১৩)
বিষয়বস্তুর পরিচয়
বর্তমান গ্রন্থটির প্রকাশক হিসাবে বিষয়বস্তু সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় তুলে ধরা জরুরি বলে মনে করছি। ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চায় সাধারণ মুসলমান জনগোষ্ঠীকে কখনওই ভারতীয় ভূমিপুত্র বলে ধরাই হয়নি। সে কারণে চিরকালই তারা ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হিসেবেই থেকে গেছেন। এহেন অবস্থার জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে পশ্চিমবাঙলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর যে হাঁড়ির হাল হয়েছে, তা অনুসন্ধানে লেখক খাজিম আহমেদ তাঁর ‘পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন। একই সঙ্গে মুসলমান জাতির অতীত ঐতিহ্য সন্ধানের পাশাপাশি বর্তমান কালের পাকচক্রে তাঁদের অসহায়তাও লেখকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি।
বাঙালি মুসলমান : উত্পহত্তি বিকাশ
সিন্ধু তীরবর্তী ভারতবর্ষে মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রথম পদচারণা তথা.. বিস্তার পদক্ষেপে নিপীড়ন নয়, নিবেদনই ছিল মৌল উপাদান। মহানবী (সাঃ)-র ‘হিন্দ’ সম্পর্কে অনুসন্ধিত্সাী আসলে তাঁর ভৌগোলিক প্রজ্ঞাকেই মূর্ত করে তোলে। ভারত তথা বাঙলাভূমিতে ইসলাম ধর্মের বীজ বপন প্রসঙ্গে লেখক গভীর ইতিহাস চেতনারই আবহ রচনা করেছেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি নিছক ভোজবাজি দেখিয়ে বাংলার তখ্ত থেকে রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করেননি, তা খাজিম আহমেদ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। দ্বিতীয়ত, জনাব আহমেদ অকপটেই দেখিয়েছেন, ইসলাম প্রচারে সুফিবাদের সদর্থক ভূমিকা। ‘Islam was in dire need of reform and revival’, ইসলাম বিস্তারে অসিযুদ্ধের প্রয়োজন পড়েনি।
বাঙালি মুসলমান : মর্যাদার সন্ধানে
অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয়দের দুনিয়াব্যাপী সম্প্রসারণজনিত ধ্বংসাত্মক নীতিতে মুসলমানদের বিপর্যস্ত অবস্থা হয়েছিল। এ থেকে উত্তরণের পথ ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক প্রগতিশীল ভাবনা, যা পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় মুসলমান দেশগুলি উপলব্ধি করে জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেছিল। বাঙলার মুসলমান সমাজ প্রথমাবস্থায় আধুনিক জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে না পেরেই ক্রমে ক্রমে তলানিতে এসে ঠেকে। এই অবস্থায় ইন্ধন জুগিয়েছিল সংখ্যাগুরুদের উন্নাসিকতা আর শাসকগোষ্ঠীর দেশ বিভাজনের কুফলতা।
‘মুসলমানরা নিজেদের ধর্মীয়সত্তা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিল।’
সাম্প্রদায়িকতা : উপেক্ষিত জাতির উত্থান-বিকাশ
এই শিরোনামে লেখকের তিনটি প্রবন্ধ – ১. ‘একটি উপেক্ষিত জাতিসত্তার উত্থানের ইতিহাস’, ২. ‘বাঙলায় একটি জাতিসত্তার বিকাশের আদি ইতিহাস’, ৩. ‘আধুনিক ভারতে সাম্প্রদায়িকতাবাদের শিকড় সন্ধান’- এ ইতিহাসবেত্তা জনাব খাজিম আহমেদ আত্মানুসন্ধান করেছেন। তিনি বলেছেন, ঔপনিবেশিক অধোবিকাশ হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রকাশে তত্কাালীন পত্রপত্রিকার বেলাগাম ভূমিকা অত্যন্ত ব্যথিত করে। প্রকৃত ইতিহাসচর্চার অনুসন্ধান করেছেন খাজিম আহমেদ তথ্যের ভিত্তিতে।’ (সন্দীপ দত্ত, প্রাত্যহিক খবর, ১ জানুয়ারি, ২০১২)।
বিপন চন্দ্রের ‘কমিউনালিজম ইন মর্ডান ইন্ডিয়া’ নামক গ্রন্থের মূল্যায়নে খাজিম আহমেদ প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছেন।
বিভাগোত্তর ‘পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা’
১৯৪৭ থেকে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রসারের কালে কেমনভাবে মুসলমান জনসত্তা ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে গেছে তার সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে উপরোক্ত প্রবন্ধটিতে। অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং সাহসিকতার সঙ্গেই লেখক আপন কথা বলে গেছেন। তাঁর এই ভাষ্যরূপ সমবেত আর্ত পীড়িত, বুভুক্ষু বঞ্চিত মুসলমান জনগোষ্ঠীরই ভাষা। মহানজ্ঞানী অন্নদাশঙ্কর রায়ের উপর তত্কাঁলীন সরকারের যে সাম্প্রদায়িক চাপ সৃষ্টি, তা ‘সেকুলার ইমেজ’-কে সরাসরি কলুষিত করে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীদের মধ্যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মুসলমান প্রীতি মনে রাখার মতো ঘটনা বলেই খাজিম আহমেদ আর সমস্ত মুসলমানদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন। সর্বোপরি লেখক সুনিপুণভাবে দেখিয়েছেন যে, শুধু শাসক হিসেবেই নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্ব বিবেচনাতেও সিপিএম বাঙালি মুসলমানদের নির্লজ্জ ভাবে বঞ্চিত করেছে। ঘটনাক্রমে কমিউনিস্ট নেতা মুজফ্ফর আহমদ এবং মনসুর হবিবুল্লাহ’র মতো সর্বজন মান্য নেতৃত্বও সিপিএমের পক্ষ থেকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন।
বাঙালি মুসলমান : ট্র্যাডিশন চলছে
খাজিম আহমেদ এই প্রবন্ধে সামাজিক আর রাজনৈতিক ট্র্যাজিক চরিত্র মুসলমানদের সম্পর্কে সদর্থক ভূমিকা প্রেরণের বার্তা দিয়েছেন। জ্যোতি বসুর – ‘জালিম জমানা’ সম্পর্কে অকুতোভয় খাজিম আহমেদ ‘খুল্লাম খুল্লা’ মন্তব্য করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও লেখক রেয়াত করেননি।
বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে
১৯১৭ থেকে ১৯৭২ মধ্যবর্তী কালের সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনায় তথ্যের প্রাচুর্য আমাদের বিস্মিত করে! আগামী প্রজন্মের কাছে এটি নিশ্চিত দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইতিহাসচর্চা ও সাম্প্রদায়িকতা
পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যানুসন্ধানে খাজিম আহমেদ বিকৃত ইতিহাস চর্চার উত্সৃ নির্ণয় করেছেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতা লাভের সাত দশক পরেও দুই যুযুধান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য তো স্থাপন হয়ইনি, উপরন্ত সন্দেহ আর অবিশ্বাস ক্রমেই বেড়ে চলেছে। পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসচর্চা স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রকৃত মুল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছে।
‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জীবন অনুশীলন ও শিক্ষাদর্শন’, ‘বহুজাতির ভারত : ঐক্যভাবনা’, ‘সেকুলারিজমের সওয়াল’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলোর আবেদন শাশ্বত। বস্তুত গ্রন্থটি পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমানদের অন্তহীন সমস্যার ‘ঈক্ষণ-বিক্ষণ’।
বিষয়বস্তুর পরিচয় অংশটি, কাজি মুজিবর রহমান কৃত মূল্যায়নের অতিসংক্ষিপ্ত সারাত্সাির, ‘বাঙালি মুসলমানের..স্বরূপ সন্ধান’ (আবার যুগান্তর, ৩১ মার্চ, ২০১৩)।
গ্রন্থটির প্রকাশক হিসেবে আমি অনুধাবন করেছি, পরিস্থিতি ও ঘটনাক্রম পর্যালোচনার ক্ষেত্রে খাজিম আহমেদের যৌক্তিক মনোস্বভাব ও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ বিস্ময়কর। তাঁর নিরীক্ষণ-প্রক্রিয়ায় ‘পক্ষপাতী পাটগনিত’-এর ছায়া পড়েনি বলে, তাঁর ইতিহাস আলোচনায় তথাকথিত বনস্পতি ঐতিহাসিকেরও পক্ষপাতিত্ব অনায়াসে ধরা পড়ে। যা পাঠককে সত্যঋদ্ধ করে। বস্তুত তাঁর উপস্থাপনা ভাবনা- অনুভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। তাঁর বিরল পরিশ্রম-কুশলতা আমাদের বিস্মিত করে।
গবেষক খাজিম আহমেদ আশ্চর্য কৌশলে খারিজ করেছেন- তীক্ষ্ণ নীরদ সি চৌধুরীর বক্তব্য। নীরদবাবু মন্তব্য করেন, রামমোহনের পর আর কোনও বাঙালি হিন্দুর মধ্যে তিনি নাকি ইসলামি বিষয়ে জ্ঞান দেখতে পাননি। কিন্তু তথ্য ও সত্য তুলে ধরে লেখক তা খণ্ডন করেছেন। দ্রঃ মিশ্র সংস্কৃতির আবহমান ধারা। (আবু আরিফ, ‘কলম-সাহিত্য’, ০৬ জানুয়ারি, ২০১৩)। তাঁর ‘ওয়াকফ নামাহ’ – নিবন্ধের মতো এমন সুসংবদ্ধ রচনা, এর আগে আর কখনও দেখা যায়নি।
খাজিম আহমেদের এই চেতনিক নির্মাণ সমকালের একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর হিসেবে প্রত্যয়িত হবে, মান্যতা পাবে আকর গ্রন্থের— এ বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। গ্রন্থখানির প্রকাশক হিসেবে মানসিক প্রশান্তি অনুভব করছি।
বিভাগ পরবর্তী ভারতের মুসলমানদের বঞ্চিত করার অপ্রয়াস কত ভয়ঙ্কর তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন গবেষক খাজিম আহমেদ।
বাঙালি মুসলমানদের মর্যাদার অন্বেষণ ইত্যাকার বিষয় গুরুত্ব দিয়ে আলোকপাত করলেন তিনি। খাজিম আহমেদের লেখা গ্রন্থ পাঠ নিয়ে দুই বাংলার পাঠক সমৃদ্ধ হলেন।
পশ্চিমবাঙলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা ।। খাজিম আহমেদ ।। উদার আকাশ, ঘটকপুকুর, ডাক ভাঙড় গোবিন্দপুর, জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, সূচক ৭৪৩৫০২।। প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর ২০১২ ।। মূল্য ২০০ টাকা ।। দ্বিতীয় প্রকাশ, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১।। মূল্য ৩০০ টাকা।। প্রকাশকের কথা থেকে ফারুক আহমেদ, প্রকাশক ও সম্পাদক উদার আকাশ।
বাঙালি মুসলমান আত্মমর্যাদার সন্ধানে, উদার আকাশ প্রকাশন, উদার জীবনের অন্বেষণ।
বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে :
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পূর্ণতাপ্রাপ্ত বাংলার মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণিতে মুসলমানদের কোনও অংশীদারি ছিল না। অথচ ‘বঙ্গ’ নামে বাংলার বিভিন্ন জনপদকে একতাবদ্ধ করে তুলবার কাজ হিন্দু আমলে যে সাধিত হয়নি, এটি সর্বজনস্বীকৃত মত। এই কাজ সাধিত হয়েছিল মুসলমান আমলে।১ বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন আর সুফি মনীষীদের (বুজর্গ) মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু হওয়ার ছ’শো (৬০০) বছরের মধ্যে এটাই ছিল বাংলার মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে দুঃসময়। মুসলমানদের হাত থেকে ‘হুকুমতি তখ্ত’ চলে যাওয়ার বছর অর্থাৎ ১৭৫৭ সাল থেকে শুরু করে বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত প্রায় দেড়শো (১৫০) বছর পর্যন্ত সময়কালকে বাংলার মুসলমানদের জন্য অন্ধকার কাল হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। স্মর্তব্য যে, মোগল আমলে বাংলাদেশে এবং মোগল সাম্রাজ্যের বাইরে অবস্থিত দুটি স্বাধীন প্রত্যন্ত রাজ্যেও (রোসাঙ্গ ও ত্রিপুরা) মুসলিম বাংলা সাহিত্যের আলোচনা ও চর্চা অব্যাহত ছিল।২ এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৮৫৭ সালে একটি অসফল সিপাহি বিদ্রোহের পর হিন্দুস্তানে মুসলমানদের জন্য বর্ণনাতীত দুর্ভোগ ও অসার্থকতা নেমে আসে।৩ এমন কথার সমর্থন মেলে এম. আর. আখতার মুকুলের ‘কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ নামক গ্রন্থে।
১৯০৫-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ এই সময়টিকে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান শ্রেণির আত্মপ্রতিষ্ঠা ও প্রসারণের কাল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।৪ অর্থাৎ বিশ শতকের শুরু থেকেই বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বরূপ সন্ধানে প্রয়াসী হয়ে উঠে। বস্তুত ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে একটি মর্যাদাশীল জাতিসত্তা হিসেবে উত্থিত হয়। জীবন-জিন্দেগির প্রতিটি স্তরে সাড়া দেবার (Response to Change) মানসিকতা গড়ে ওঠে। এমন সময়ে দেশভাগের মারফত এই উপমহাদেশে আজাদি আসে। বাঙালি মুসলমানের আত্মবিকাশের পথটিও এপার বাংলায় রুদ্ধ হয়ে যায়। নয়া উত্থিত বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি বিরাট অংশ মানইজ্জত আর প্রতিষ্ঠার সওয়ালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ‘হিজরত’ করলেন। পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের জীবনে রাজনৈতিক বিবর্তনের ফলে নেমে আসে এক অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। তখন কলকাতায় হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের জানমালের ক্ষতি হয়েছিল অনেক বেশি।৫ দেশ-বিভাগের পর বাঙালি মুসলমান সমাজ অকস্মাৎ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। স্বতন্ত্র জাতিসত্তা, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এই রাজনৈতিক আইডিয়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
এহেন পরিস্থিতিতে বাঙালি মুসলমানদের বৌদ্ধিক ক্ষেত্রটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, সেটি স্বাভাবিক ছিল। বাঙালি মুসলমান সমাজের এই সংকট সন্ধিক্ষণে তাদের মেধা আর মননের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন হুমায়ুন কবির (১৯০৬-‘৬৯), কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-‘৭৪), আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-‘৮২) ও রেজাউল করিম (১৯০২-‘৯৩)। দেশ-বিভাগের আগেই উল্লিখিত ব্যক্তিরা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এ সময় বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের একাংশ উদ্যোগী হন। সে লক্ষ্যে দুটি সাহিত্য সংগঠন স্থাপিত হয়। এর একটি কলকাতায় এবং অপরটি ঢাকায়।৬ ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিষয়ক ভাবানুষঙ্গগুলো এম. আবদুর রহমান কঠোর পরিশ্রমে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
দেশবিভাগের পর সাহিত্য আর সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলমানদের হতচকিত করলেও একেবারে হতোদ্যম হয়ে পড়েনি। এ সময় সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয় রেনেসাঁ সোসাইটি ও সাহিত্য সংসদের নীতি। এই নীতি বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয় বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে।৭ তার প্রকাশ কিয়ৎকাল পরে লক্ষযোগ্য হয়ে উঠেছে। সেই সময় তরুণ মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে যে ক’জন উজ্জ্বল সম্ভাবনার পরিচয় রাখছিলেন তাঁদের মধ্যে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আবদুল আজীজ আল্-আমান ও আবদুল জব্বারের নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য।
দেশবিভাগের পর বাঙালি মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক সত্তার যখন নাভিশ্বাস উঠেছে, এমন সময় সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ নানা দুর্যোগ আর সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে নিজের মর্যাদা আর আভিজাত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি মুসলমানরা আত্মমর্যাদার কেন্দ্রটি চিহ্নিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। জনাব সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ছিলেন ‘কম্পোজিট কালচারের’ শীর্ষ প্রতিনিধি। এ সময় বাঙালি মুসলমান লেখকের দৃষ্টিতে বিশেষভাবে কেন্দ্রীভূত হয় তাঁর সমাজ ও সম্প্রদায়গত অনুভূতি। এ ক্ষেত্রে সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মুসলমান লেখকের ভূমিকা স্মরণযোগ্য।৮ বিশেষত আধুনিক শিক্ষা, স্বাধীনতা অর্জন, বিজ্ঞান ও আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে যোগযোগ বিষয়ে তাঁদের প্রচেষ্টা সমাজের অগ্রগতিতে সহায়ক হয়েছিল।
আবদুল আজীজ আল আমান (১৯৩২-১৯৯৪) এপার বাংলার সাহিত্য জগতে এক শ্রদ্ধার যোগ্য ব্যক্তিত্ব। বিভাগ পরবর্তী পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে তিনি প্রায় অভিভাবকতুল্য দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সৃষ্টিশীল সাহিত্য নির্মাণ মুসলমান জীবনের সহানুভূতি সিক্ত অন্তরঙ্গ পরিচয় তার কলমে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। উপন্যাস, কবিতা, গল্প, ধর্মাশ্রয়ী ইসলাম বিষয়ক রচনা, কাজী নজরুল ইসলালকে নিয়ে গবেষণা আর ‘জাগরণ’ দু’পর্যায়ের ‘কাফেলা’ আর ‘গতি’ নামক সংবাদ সাহিত্য পত্রিকার মারফত এক তুখড় লড়াই করেছিলেন। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘হরফ প্রকাশনী’ প্রকাশনার ক্ষেত্রেও যে উচ্চ গুণমানের নজির স্থাপন করেছিলেন সে ধারা আজও অনুকরণযোগ্য।৯ সৃষ্টিশীল এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা না জানাতে পারলে জাতির অপ্রাপ্তি থেকে যাবে। সে কারণে জাতির উচিত এমন মনীষীদের জীবনকথা সর্বসাধারণ পর্যন্ত পৌঁছনো।
আবদুল জব্বার গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের রূপকার। উপেক্ষিত এবং অবহেলিত মানুষের আঁতের খবর, নির্যাতিত মানবাত্মার মর্মন্তুদ আর্তনাদ তাঁর সৃজনশীল সাহিত্য নির্মাণে প্রাধান্য পেয়েছে। সমাজ ও অর্থ বিচারে তিনি নিজেও ছিলেন নন-প্রিভিলেজ শ্রেণির প্রতিনিধি। কাজী আবদুল ওদুদ আর হুমায়ুন কবিরের অশেষ স্নেহ ধন্য আবদুল জব্বারের সাহিত্যকর্মের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র। কাজী আবদুল ওদুদ ‘শরৎচন্দ্র ও তারপর’ (১৩৬৮) গ্রন্থের একটি অংশে শরৎচন্দ্র উত্তরকালের বাংলা কথাসাহিত্যের প্রধানত বাস্তববাদী অংশের পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে অন্য আরও অনেকের সঙ্গে আবদুল জব্বারের আর গোলাম কুদ্দুসের (জন্ম-১৯২০) সাহিত্য সৃষ্টির মূল্যায়ন করেছেন।১০ তাঁদের অবদান বিশেষভাবে তাই স্মরণীয়।
দেশবিভাগ পরবর্তী নয়া প্রজন্ম থেকে উত্থিত খাজিম আহমেদ (জ.১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭) জন্মগ্রহণ করেন মুর্শিদাবাদ জেলার রানিনগরে অবস্থিত কাতলামারির মালিপাড়া গ্রামে।১১ বস্তুত তিনি প্রবন্ধ নির্মাণের ক্ষেত্রে কাজী আবদুল ওদুদ১২ রেজাউল করিম আর এম. আবদুর রহমানের উত্তরসূরি হিসেবে নিজের মেধা আর মননকে নিজস্বতার খোঁজে নিরপেক্ষতা এবং বৃহত্তর নৈর্ব্যক্তিকতার প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করছেন। অনির্বচনীয় প্রকাশ স্টাইল তার শব্দ ব্যবহার দুর্বোধ্য প্রবন্ধ পাঠকেও সুখপ্রদ করে তোলে। আর বিষয় নির্বাচনে খাজিম আহমেদের সমাজমনস্কতা পুনঃ পুনঃ আমাদের চমকিত করে। দেশ বিভাগজনিত কারণে একটি আন্তর্জাতিক এবং একেশ্বরবাদী জাতিসত্তার প্রতি যে অবিচার এবং ‘দুরমুশ’ করার প্রবণতা ক্রিয়াশীল ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে তার বিরুদ্ধে যে যৌক্তিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তা প্রখর নির্ভীকতার পরিচয়বাহী। ‘বেসুমার’ মুগ্ধতা নিয়ে প্রকাশক হিসেবে তাঁর প্রথম অসাধারণ প্রবন্ধগ্রন্থ ‘পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান: অন্তবিহীন সমস্যা’ পাঠক সজ্জনের দরবারে পেশ করি। প্রবন্ধগ্রন্থ এমনভাবে সমাদৃত হবে তা চিন্তার অগোচর ছিল। সোজাসুজি বলতে কী বাংলা আর ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোতে ২০১২-তে ব্যাপক সুখ্যাতি করা হয়েছিল। আজও-বেঙ্গলি পত্র-পত্রিকায় উক্ত গ্রন্থটির রিভিউ হচ্ছে। প্রথম মুদ্রণ নিঃশেষিত। দ্বিতীয় সংস্করণ ‘উদার আকাশ প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। লকডাউন আমাদের বিড়ম্বিত করেছে। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন বিগত চুয়ান্ন বছর অগণন প্রবন্ধ তাঁর পত্রস্থ হয়েছে, অথচ সেগুলো গ্রন্থাকারে পাওয়া গেল না কেন? এমনবিধ প্রশ্ন আমার মনেও ছিল। জনাব আহমেদকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করায় দ্বিধাহীন উত্তর করলেন, ‘‘এই অকৃতী অধমের কাজ হল লেখা, পাঠক পড়বেন, প্রকাশক বই ছাপাবেন, এটাই তো দস্তুর। বই প্রকাশ আমার কর্ম নয়।’’ এমনই নির্মোহ তাঁর মানস ভাবনা। ‘উদার আকাশ পত্রিকা’র সম্পাদক এবং ‘উদার আকাশ প্রকাশন’-এর পরিচালক হিসাবে আমি তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিকে গ্রন্থবদ্ধ করার অভিপ্রায় এবং অভিলাষ পোষণ করি। আমার পরম শ্রদ্ধেয় অভিভাবক তুল্য খাজিম আহমেদ সানন্দে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। মল্লিক ব্রাদার্স, প্রভিনসিয়াল বুক এজেন্সি, নবজাতক প্রকাশন, লেখা প্রকাশনী, বুকস ওয়ে, অভিযান পাবলিশার্স, সর্বোপরি প্রবাদপ্রতিম মিথ বা কিংবদন্তি প্রকাশন সংস্থা ‘হরফ প্রকাশনী’র উত্তরসূরি হিসেবে ‘উদার আকাশ প্রকাশন’ বিগত এক দশকে প্রায় শতটি গ্রন্থ সফলভাবে প্রকাশ করেছে। সাহিত্যের সব শাখাতেই এই নয়া আর তরতাজা প্রকাশন বিচরণ করেছে। পাঠকবর্গের স্নেহ-ভালোবাসা, পৃষ্ঠপোষকতা আমাদের পরমপ্রাপ্তি। স্বভাবতই নত-মস্তক হচ্ছি।
দেশবিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলার জাতিসত্তা বিষয়ক অনন্য সাধারণ প্রাবন্ধিক ইতিহাসবেত্তা উপমহাদেশ বিষয়ক সমাজবিজ্ঞানী খাজিম আহমেদের দীর্ঘ জীবন চর্চিত অজস্র প্রবন্ধাবলির মধ্য থেকে ১৮টি দিকনির্দেশক গবেষণা ‘উদার আকাশ প্রকাশন’ থেকে ‘বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে’-এর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ প্রকাশের সুযোগ পেয়ে নির্মল গর্বানুভব করছি। সততার সঙ্গে উচ্চারণ করি ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাস থেকে ২০১৯-এর ২৫ ডিসেম্বর তক জনাব খাজিম আহমেদ ‘ডেডলি ডিজিজ’-এর সঙ্গে লড়াই করছিলেন এবং অবশেষে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। দীর্ঘদিন বাদে তাঁর লেখক সত্তাকে পুনরুজ্জীবিত করার সওয়ালে শ্লাঘা বোধ করছি। ‘উদার আকাশ প্রকাশন’ হরওয়াক্ত তাঁর পাশে রয়েছে। ‘উদার আকাশ পত্রিকা’য় দেড় ডজনের ওপর প্রথাবিরোধী কঠোর পরিশ্রমসাধ্য গবেষণাজাত প্রবন্ধ খাজিম আহমেদ লিখেছেন। সমালোচনা, নানাবিধ মূল্যায়ন ছয় দশকের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও ‘উদার আকাশ’ শীর্ষক রচনা বিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলার ৬০ বছরের এক ঐতিহাসিক দলিল ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেলেন। বিশেষত ইসলামি সভ্যতার গৌরবময় ইতিহাসের পুনরুদ্ধার, উপেক্ষিত ও বিস্মৃত মুসলিম ব্যক্তিত্ব, ভারত ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের ভূমিকাকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ভ্রান্তির বেড়াজালে জড়িয়ে উত্থাপনের বিরুদ্ধে প্রকৃত সত্য আহরণ, বিভাগ-পরবর্তী এ বাংলায় মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা প্রভৃতি ইতিহাস ও সমাজভিত্তিক প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ভুল বোঝাবুঝি ও মানসিক দূরত্ব অবসানের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন।১৩ বলাবাহুল্য নিজস্বতার খোঁজে তাঁর রচিত রচনাগুলো মূল্যবান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে।
‘বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে’ নামাঙ্কিত এই গ্রন্থের বিষয়সমূহের মর্মবস্তু সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকার পুরো জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ছিল ইসলামধর্মী। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পর জনবিন্যাসের পরিবর্তন হয়ে যায়।১৪ এর ফলে নানা মুসিবতের জন্ম নেয়। বস্তুত বর্তমান গ্রন্থটিতে নিজস্বতার খোঁজে, মর্যাদার সন্ধান, আত্মচেতনার বিকাশ আর স্বরূপ সন্ধান প্রয়াসী হয়েছেন বর্তমান গবেষক ও লেখক। এ বিষয়ে ড. রফিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন ‘A Quest for Identity ; Preface’ ‘দ্য বেঙ্গল মুসলিমস’, ১৮৭১-‘০৬। Richard M. Eaton ‘The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760’ নামক গ্রন্থে (Copyright: The Regents of the University of California) লিখেছেন, ‘In 1984 about 93 million of the 152 of the estimated 96.5 million people inhabiting Bangladesh, 81 million or 83 percent. Were Muslims in fact, Bengalis today comprise the second largest Muslim ethnic population in the world, after the Arabs.’ উপাদানের সূত্র: Richard V. Weekes, Ed. Muslim Peoples: A World Ethnographic Survey, 2nd Ed. (Westport Green Wood Press). (Page-2). এমন বিশাল সংখ্যক বাঙালি মুসলমানদের বেদনার কথাটি ডক্টর এ আর মল্লিক প্রকাশ করেছেন এইভাবে, ‘বাঙালি মুসলমানদের বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে তাদের মন্থর ও বিলম্বিত অভ্যুত্থান। এখনও সেই বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গে অনেকাংশে প্রযোজ্য।’ সেই ‘পরাভব; চেতনা’ থেকে মুক্ত হবার পথ সন্ধান করা হয়েছে ‘বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে’ নামক এই বিস্ফোরক গ্রন্থে।
হাজী মুহম্মদ মহসীনের কাছে বাঙালি জাতির ঋণ অপরিমেয়। অবিভক্ত বাংলার অতিদূর প্রত্যন্তেও তাঁর দানে বহু শিক্ষার্থী জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছেন। অথচ হাজী মুহম্মদ মহসীনের প্রতি যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা জরুরি ছিল আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি তা করেনি। অথচ হিন্দু-মুসলমান সকলেই তাঁর কাছে দায়বদ্ধ। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর বিপুল ধন-সম্পদের উপার্জিত অংশ থেকে উভয় সম্প্রদায়ই উপকৃত হয়েছিল। ১৭৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দের সরকারি দলিল থেকে জানা যায় যে, ওই সময়ের মহাদুর্ভিক্ষে তিনি বহু লঙ্গরখানা স্থাপন করেছিলেন এবং সরকারি সাহায্য তহবিলে অর্থ প্রদান করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম চিরকুমার ও মহান জনহিতৈষী ব্যক্তি।১৫ কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবাংলায় হাজী মুহম্মদ মহসীন সম্পর্কে নিশ্চিত অনীহা বিস্ময়াবহ। বাঙালির সেই কৌতূহলহীনতা অপনোদনের অভিপ্রায়েই ‘বাঙালি মুসলমান জাগরণের অপ্রত্যক্ষ অভিভাবক হাজী মুহাম্মদ মহসীন’ গ্রন্থবদ্ধ করেছি। মহাপ্রাণ মহসীনের মৃত্যুর শতবার্ষিকীতে ১৯১৩ সালে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ‘One of the Greatest Indian of the 18th century’ বলে সম্মান নিবেদন করেন।
উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে বাঙালি মুসলমান সমাজের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার তাগিদে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে নওয়াব আবদুল লতিফ (১৮২৮-১৮৯৩) এবং জাস্টিস সৈয়দ আমীর আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলার মুসলমানদের ঘোর দুর্দিনে নবাব আবদুল লতিফ রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি মুসলমানদের ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করে তাদেরকে উন্নতির পথে চালিত করার জন্য কর্মপন্থা অবলম্বন করেন। উত্তর ভারতের মুসলমানদের উন্নতির জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ খান যেরূপ কাজ করেছেন, আবদুল লতিফ বাংলার মুসলমানদের উন্নতির জন্য সেরূপ প্রচেষ্টা চালান।১৬ মুসলিম বাংলায় আধুনিকতার অগ্রনায়ক আবদুল লতিফ নামক সন্দর্ভে তাঁর ঐতিহাসিক অবদান সম্পর্কে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
সৈয়দ আমীর আলী পূর্ব ভারতের মুসলমান সমাজে একজন ত্রাণকর্তা হিসেবে অবতীর্ণ হন। ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ ও সাংস্কৃতিক পুনর্জন্মের জন্য তাঁর দান সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।১৭ মুসলিম চিন্তার উৎকর্ষ বিধান আত্মজিজ্ঞাসার উদ্বোধন করা ছিল তাঁর জ্ঞানগর্ভ তথ্যভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি সিদ্ধান্ত প্রণয়নের উদ্দেশ্য। প্রতিবেশী হিন্দুরা হিন্দুধর্ম ও ভারতের পুরাণ ইতিহাসকে আশ্রয় করে পুনর্জাগরণ ও জাতীয়তাবাদের সুর তুলেছেন। ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসাবে মুসলমানদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। তার তথ্যপূর্ণ ও যুক্তিশীল রচনা দ্বারা খ্রিস্টান জগতের অনেক ভ্রান্তি ও অজ্ঞানতা দূরীভূত হয়। চোখে ইসলামের ও মুসলমানদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় সৈয়দ আমির আলী ইসলামের ‘বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যানুভূতি’তে বিশ্বাস করতেন।
জামাল উদ্দীন আল আফগানির (১৮৩৯-১৮৯৭) জন্ম ইরানে হলেও পূর্বপুরুষদের সূত্রে নিজেকে আফগানি বলে পরিচয় দিতেন। মুসলমান সমাজে তিনি যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার ঢেউ ভারতেও এসে পৌঁছয় এবং নিজেও তিনি এ দেশে এসেছিলেন, এমনকি কলকাতাতেও। ইংরেজ সরকার এই সম্মানিত অতিথির সাথে দেশীয় নাগরিকদের মেলামেশার পথে যতদূর সম্ভব অন্তরয় সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। এর পরেও আফগানির প্রভাবে মুসলিম চিন্তানায়কগণ প্যান-ইসলামের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন।১৮ তাঁর চেষ্টা ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীর মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করা, যে কারণে তাঁকে প্যান ইসলামিক নেতা বলা হয়। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আধুনিক।
মুসলিম সাহিত্য সমাজ : বুদ্ধি ও বিবেকের মুক্তি আন্দোলন
মুসলমান সমাজে আধুনিক মনস্কতা উজ্জীবনের জন্য ক্রিয়াশীল ছিল। মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে এই সংস্থা কাজ শুরু করে সংস্থার প্রথম সম্পাদক হন আবুল হোসেন। কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী আনোয়ারুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন প্রভূত পরিশ্রম করেছিলেন এই সংস্থার সাফল্যের জন্য। জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এই ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ স্থাপিত হয় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি।১৯ বিভাগপূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ছিল কলকাতা। ফলে ঢাকায় কোনও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠেনি। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ই প্রথম সাংস্কৃতিক সংগঠন।
রেজাউল করিম সংস্কৃতির সমন্বয়ের জন্য পুরো জীবন কাজ করেছেন। তাঁর ধর্মভাবনা সম্প্রীতি বোধে উদ্দীপ্ত। এই উদার বোধ থেকে ‘সাধক দারাশিকো’র জীবনাদর্শকে ব্যাখ্যায়িত করেন। বাংলা আর ইংরেজি মিলিয়ে দু’ডজন গ্রন্থের তিনি প্রণেতা। সম্প্রীতির অগ্রণী সৈনিক রেজাউল করিম।
সৈয়দ বদরুদ্দোজা বিভাগ পরবর্তী পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের মন থেকে মাইনরিটি কমপ্লেক্স সংখ্যালঘিষ্ঠতা জনিত অস্বস্তিকাতরতা দূর করতে প্রয়াসী ছিলেন। তিনি নিরন্তর প্রচার করতেন যে, স্বদেশের ধুলোমাটি অনেক বেশি পবিত্র, তাঁরা যেন দেশত্যাগ না করেন। স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ অর্থাৎ ‘হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ইমান।’ দেশত্যাগ বন্ধ করাই ছিল তাঁর বিশাল জীবনের মহান ব্রত। সৈয়দ বদরুদ্দোজা এক মহাজীবনের কথা। এটি একটি দলিল বিশেষ।
হুমায়ুন কবির কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক, দার্শনিক হিসেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক এই মানুষটি ফরিদপুরের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাননি। তিনি দেশবিভাগের বিরোধী ছিলেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ‘ভারত-পাকিস্তান’ যুদ্ধের সময় রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মুসলমানদের উপর যে হয়রানি করা হচ্ছিল তখন জাতীয় স্তরের মুসলিম বুদ্ধিজীবী নেতা অধ্যাপক হুমায়ুন কবির এর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের কাছে কখনও দরবার, কখনও বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করে গেছেন।২০ তাঁর ছাত্রজীবন আর অধ্যাপনার জীবন ছিল অত্যুজ্জ্বল। এমন বিশাল মাপের মানুষের মূল্যায়ন হয়নি পশ্চিমবাংলায়।
এম. আবদুর রহমান অবিভক্ত বাংলা এবং খণ্ডিত পশ্চিমবাংলার একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। ইসলামি সংস্কৃতি জীবনীগ্রন্থ ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধ এবং ইতিহাসাশ্রয়ী লেখায় তাঁর ক্ষমতা প্রমাণিত। বিস্মৃতপ্রায় মনীষী এম. আবদুর রহমানকে স্মরণযোগ্য করে তুলেছেন ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ। এমন উপেক্ষার সময়ে এই উদারপ্রাণ মানুষটিকে বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে টেনে তোলা অপরিহার্য ছিল।
মৌলানা আজাদ এই উপমহাদেশের রাজনীতি ক্ষেত্রে এক ‘মহান আর নিঃসঙ্গ পদাতিক’। তাঁকে প্রথমে কয়েদ-ই-আজম অভিধায় ভূষিত করা হয়, কিন্তু সময় তাঁকে নির্বান্ধব করে তোলে, কী দুঃসহ ‘দর্দ’ তাঁর হৃদয়কে ছিন্ন করে দেয়। তার সাবুত রয়েছে প্রকাশিত সন্দর্ভটিতে।
এই উপমহাদেশের বাংলা সাংবাদিকতার মহীরুহ আবুল কালাম শামসুদ্দিন পশ্চিমবঙ্গীয় সাংস্কৃতিক জগতে অনালোচিত থেকে গেলেন।২১ অথচ তাঁর নির্দেশনায় সাংবাদিকতার পাঠ নিয়েছেন-প্রয়াত সন্তোষ কুমার ঘোষ, সাগরময় ঘোষ এবং আরও কয়েকজন কলকাতাকেন্দ্রিক যশস্বী সাংবাদিক-সাহিত্যিক। ১৯৪৬-এর দাঙ্গাকালে দৈনিক আজাদের দপ্তরে আসা-যাওয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর প্রিয়ভাজন সন্তোষ কুমার ঘোষের জন্য। জনাব শামসুদ্দিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে ঘৃণা করতেন।
ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ মুসলমান শীর্ষক নিবন্ধে খাজিম আহমেদ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একান্ত অন্ধ ও বদ্ধ ধারণার শিকড় সমূলে উৎপাটন করে দিয়েছেন। কোনটা সন্ত্রাসবাদ কোনটা ইনসাফের জন্য লড়াই আর কোনটা স্বাধীনতা সংগ্রাম দেশ ও মহল বিশেষে তার মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ শক্তিগুলি ঊনবিংশ শতাব্দীতে এশিয়া-আফ্রিকা প্রভৃতি মহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্র দখল করার পর তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনসাধারণ রুখে দাঁড়ালেই তকমা দেওয়া হত এরা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী। আর বিংশ শতাব্দীতে যখনই মুসলমানরা নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, তাদেরকে ‘উগ্র-সন্ত্রাসবাদী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে সাম্য, ইনসাফ ও সুবিচারকে দমন করার জন্য এই শব্দগুলি হচ্ছে হাতিয়ার। সমগ্র বিষয়টির ওপর নির্মোহ দৃষ্টিপাত করেছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ জনাব খাজিম আহমেদ।
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সমাজ গুরুবাদ, অদৃষ্টবাদ, অবতারবাদ, ভক্তিবাদ-এ আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। কবজ-মাদুলির মাধ্যমে জীবনের সিঁড়িগুলিকে ডিঙ্গিয়ে উপরে ওঠার লড়াইয়ে মত্তপ্রায়। এমন মানুষই অন্ধতার মধ্যে সেক্যুলারিজমের চর্চা প্রায় না মুমকিন। এদেশে সেক্যুলারিজম বলতে সব ধর্মকে চুমু খাওয়ার নীতি বোঝানো হচ্ছে। আদতে ইউরোপীয় কনসেপ্টে সেক্যুলারিজম হচ্ছে, ‘অ্যাবসেন্স অব রিলিজিয়ন’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ধর্মহীনতা। এতদ্দেশীয় সেক্যুলারিজমে বোঝানো হচ্ছে সব ধর্মকে সম্মান উৎসাহদান। এটি যথার্থ আইডিয়া নয়। সমাজবিজ্ঞানী খাজিম আহমেদ নির্মোহ একটি মূল্যায়ন আমাদের সামনে হাজির করেছেন।
ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ ফ্যাসিবাদ আর অতলান্তিক এক অসহিষ্ণুতা অবিশ্বাস্য গতিতে এতদ্দেশীয় জনমানসকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে অথচ সবাইকে আপন জ্ঞান করায় আবহমানকাল থেকে ভারতের চিন্তনের বৈশিষ্ট্য। এক অদ্ভুত আঁধার ঘিরেছে চারিদিক। স্বাধীনতার এত বছর পরেও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে আর্থিক ও সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া ঘরের ছেলেমেয়েরা মূল স্রোতে উঠে আসতে পারেনি। বরং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিছু সংখ্যক উচ্চশিক্ষা নিতে এগিয়ে আসছে—এটাই এখন বড় আলোর দিশা। এ বিষয়ে কিছু মিশন স্কুলের অবদান উল্লেখযোগ্য।২২ মর্মস্পর্শী আলোচনাটি খাজিম আহমেদ সতর্কতায় উপস্থাপিত করেছেন। গ্রন্থটিতে আমরা মূলত সাবেক বাংলা আর পশ্চিমবাংলার বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করেছি। তথাপি ভারতের মুসলমানদের জন্য চিন্তা ভাবনাও রেখেছি। এটি প্রকাশিত হয়েছিল মহাশ্বেতা দেবীর ‘বর্তিকা’- ‘মুসলিম সমাজ ভাবনা’ (১৯৮৮ জানুয়ারি-মার্চ) সংকলনে। এই সংখ্যাটি সম্পাদনা করেছিলেন খাজিম আহমেদ।
অপ্রতিরোধ্য অশ্বারোহী সেনানায়ক মালিক ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী ১১৯৯ থেকে ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কয়েক বছর ঝড়ের গতিতে জীবন পরিচালনা করেছেন এবং সাবেক বাংলায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। মুসলমানদের এই বিজয় সমগ্র উত্তর ভারতব্যাপী মুসলিম আধিপত্য বিস্তারের একটি পর্যায় হিসেবে ধরতে হয়।২৩ সেই সুবাদে জেলা মুর্শিদাবাদে ইসলামের পত্তন ও বিকাশ চমকপ্রদভাবে বিস্তৃতি পেয়েছে। ইখতিয়ার উদ্দিন ছিলেন এক ট্র্যাজিক অধিনায়ক।
দেশবিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলার নয়া প্রজন্ম থেকে উত্থিত মধ্যবিত্ত মুসলিম বাঙালি সমাজের মেধা ও মননের প্রতিনিধিস্থানীয় সমাজবিজ্ঞানী খাজিম আহমেদ ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতকের মুর্শিদাবাদ জেলায় ইসলামের উত্থান, প্রতিষ্ঠা, বিকাশ আর বিশ শতকের ১৯৪৭ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জেলার রাজনীতিতে মুসলমানদের ভূমিকা বিষয়ক একটি অত্যাধুনিক গবেষণাজাত প্রবন্ধ নির্মাণ করেছেন। আলোচনাটি এতই বিস্তৃত এবং বিশাল যে, তা ভবিষ্যতে গবেষকদের কাছে একটি দলিল হিসেবে মান্যতা পাবে। ‘মুর্শিদাবাদ : মুসলিম ভাবানুষঙ্গ’, ‘সুবেবাংলার নিজামত প্রশাসন : অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারা’, ‘দেশবিভাগ পরবর্তী মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতে মুসলমানদের ভূমিকা’ শীর্ষক তিনটি কঠোর পরিশ্রমলব্ধ বীক্ষণ আমরা গ্রন্থবদ্ধ করেছি। ভিন্নতর জেলার জন্য আমাদের এই পরিকল্পনাটি অনুসরণযোগ্য হতে পারে।
সৈয়দ আমির আলী সম্পর্কিত তিনটে পাঠ-প্রক্রিয়াজাত লেখা (অণীক মাসিকপত্র) এবং সাপ্তাহিক ঝড়ে প্রকাশিত চিন্তানায়ক আমির আলী শীর্ষক একটি মূল্যায়ন পরিশিষ্ট অংশ মুদ্রিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা সমীচীন যে, স্যার সুরেন্দ্রনাথ তাঁর A Nation in Making নামক গ্রন্থে বলেছেন, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের সূচনা স্বদেশি আন্দোলন থেকে, তার পূর্বে এই দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক ছিল মধুর।২৪ শুধু তিনি নয়, এমন ধারণা ও অভিমত দেশের প্রায় অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তির।
অসাধারণ মননদীপ্ত এই প্রবন্ধগুলো খাজিম আহমেদের স্বীয় মনস্বিতার দ্বারা অর্জিত সম্পদের এবং তদজাত ওজস্বীতার ফসল। ‘চতুরঙ্গ’- সম্পাদক, আবদুর রাউফ; ‘মাসিক কাফেলা’- সম্পাদক আবদুল আজিজ আল্-আমান; ‘বর্তিকা’-সম্পাদক, মহাশ্বেতা দেবী; ‘কলম’ এবং ‘পুবের কলম’- সম্পাদক, আহমেদ হাসান; ‘জনমত’-সম্পাদক, রাধারঞ্জন গুপ্ত; ‘গণকণ্ঠ’-সম্পাদক, প্রাণরঞ্জন চৌধুরী; ‘অণীক’ এবং ‘মুর্শিদাবাদ বীক্ষণ’-সম্পাদক, দীপঙ্কর চক্রবর্তী; ‘আবার এসেছি ফিরে’, ‘এবং পুনশ্চ’-সম্পাদক, এবাদুল হক, সর্বোপরি ‘উদার আকাশ পত্রিকা’য় বিভিন্ন সময়ে প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পৃক্ত পত্রিকার পরম শ্রদ্ধেয় সম্পাদক মহোদয়দের ‘উদার আকাশ প্রকাশন’-এর পক্ষ থেকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। ‘মৌলানা আজাদ এক নিঃসঙ্গ পদাতিক’ অতিসম্প্রতি মুদ্রিত হয়েছিল জাইদুল হক সম্পাদিত দৈনিক ‘আপনজন’ পত্রিকায়।
‘উদার আকাশ প্রকাশন’, উদার জীবনের অন্বেষণ আর ‘কম্পোজিট কালচার’ (মিশ্র সংস্কৃতির আবহমান ধারা)-এ বিশ্বাস করে। সেই সুবাদে ‘বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে’ গবেষণা গ্রন্থটি সুজন পাঠকদের দরবারে হাজির।২৫ বলা সংগত যে, দেশ বিভাগের পর মুসলমানদের জীবন সাধারভাবে দিন যাপনের গ্লানিতেই আচ্ছন্ন ছিল। দেশ গঠন ও নির্মাণের জন্য তারাও যে কিছু করতে পারে সে ভাবনাটিকে তাঁরা রূপ দিতে পারছিলেন না।
তথ্যসূত্র:
১. ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য (ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স, ২য় প্রকাশ, ১৯৯৮), পৃ. ৯।
২. গোলাম সাকলায়েন, মুসলিম সাহিত্য ও সাহিত্যিক (ঢাকা : নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৬৭), পৃ. ২।
৩. এম. আর. আখতার মুকুল, কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী নামক মর্যাদাপূর্ণ একটি গ্রন্থে, পৃ. ২৯।
৪. নাজমা জেসমিন চৌধুরী, বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি (ঢাকা : মুক্তধারা, তৃতীয় প্রকাশ, ১৯৯১), পৃ. ৫০। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে আবর্তের সৃষ্টি হয় তাতে মুসলমান আর অধিকাংশ হিন্দু পরস্পবিরোধী চিন্তাধারার পরিচয় দেন। ফলে বঙ্গভঙ্গের সংকটময় মুহূর্তে বাঙালি হিন্দু-মানস কেবল যে ইংরেজ বিদ্বেষী হয় তা নয়, মুসলমনদের প্রতিও বিরূপতা প্রদর্শন করে। মুসলমান সমাজ তখন অমুসলিম সমাজকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকেন।
৫. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (ঢাকা : খোশরোজ কিতাবিস্তান মহল, ৮ম মুদ্রণ, ১৯৯৯), পৃ. ১৯৮। দেশ বিভাগ পরবর্তী বহু প্রদেশে দানবীয় নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। আর দেশ বিভাগের কারণ ছিল কলকাতা দাংগা। এই দাংগার পরে ইংরেজ-হিন্দু-মুসলমান তিনপক্ষই বুঝতে পেরেছিল দেশ বিভাগ ছাড়া উপায়ন্ত নেই।
৬. সাঈদ-উর রহমান, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন (ঢাকা : অনন্যা, ২০০১), পৃ. ১৬।
৭. তদেব, পৃ. ১৭।
৮. আনিসুজ্জামান, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৪, পৃ. অবতরণিকাংশ।
৯. খাজিম আহমেদ, বাঙালি মুসলমান আপন ভুবনের সন্ধানে (পশ্চিমবঙ্গ : উদার আকাশ, ২০২১), পৃ. নিবেদন অংশ।
১০. খন্দকার সিরাজুল হক, মুসলিম সাহিত্য সমাজ : সমাজ চিন্তা ও সাহিত্যকর্ম (ঢাকা: বাংলা একাডেমী), পৃ. ৩৮১।
১১. মনিরুদ্দিন খান, খাজিম আহমেদ : সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের অক্লান্ত সৈনিক, (ফারুক আহমেদ- সম্পাদিত, উদার আকাশ, ২০ বর্ষ, সংখ্যা ১ম, ২০২১), পৃ. ৯৭।
১২. কাজী আবদুল ওদুদ একজন বিশিষ্ট গদ্য লেখক-তাঁর এই বিশিষ্টতা শুধু রচনাশৈলী ও ভাষার দিক থেকেই নয়, চিন্তা ও মননশীলতার দিক থেকে, মতবাদ ও জীবনদর্শনের দিক থেকেও। চিন্তা ও ভাবের চর্চা তার ব্যসন বটে, কিন্তু আসলে তিনি একজন সচেতন সাহিত্যিক। তাই সাহিত্য ধর্মকে ডিঙিয়ে তাঁর রচনা কখনও প্রচারধর্মী হয়ে ওঠেনি। হয়তো এ কারণেই তাঁর পাঠকসংখ্যা উদারধর্মী সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিক সমাজেই একরকম সীমাবদ্ধ। ড. সাঈদ-উর রহমান, ওদুদ চর্চা (ঢাকা : কাকলী প্রকাশনী,১৯৮২), পৃ. ৮০।
১৩. মনিরুদ্দিন খান, খাজিম আহমেদ : সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের অক্লান্ত সৈনিক, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৮।
১৪. ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে জাতীয় জাগরণের একটি দিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ফলে পরবর্তীতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্রমশ জীবনের সর্বক্ষেত্রে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। আবার মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষের বহ্নি ধূমায়িত হতে থাকে। ফলস্বরূপ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট দেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৪।
১৫. সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলা পিডিয়া-১১খণ্ড (ঢাকা : এশিয়াটিক সোসাইটি, ২য় সংস্করণ, ২০১১), পৃ. ৩৯৩।
১৬. কে.এম. রাইছউদ্দিন খান, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিক্রমা (ঢাকা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, পুনমুর্দ্রণ, ২০০৬), পৃ. ৫৮০।
১৭. মুসলিম আইন ও ইতিহাসে তাঁর অসামান্য ব্যুৎপত্তি ও পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি বহু বছর কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম বিলেতের প্রিভি কাউন্সিলের সভ্য হবার সম্মন লাভ করেন। পেশাগত দায়িত্ব পারনের পাশাপাশি তিনি মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন ও ইসলামের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে কাজ করতেন। তদেব, পৃ. ৫৮৫।
১৮. আনিসুজ্জামান, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১৪।
১৯. ড. সাঈদ-উর রহমান, ওদুদ চর্চা, প্রাগুক্ত, ১৯।
২০. খাজিম আহমেদ, মর্যাদার অন্বেষক হুমায়ুন কবির (ফারুক আহমেদ-সম্পাদিত, উদার আকাশ, ১৯ বর্ষ, সংখ্যা ২য়, ২০২০), পৃ, ২৭।
২১. আজহার ইসলাম, বাংলা মসাহিত্যের ইতিহাস-আধুনিক যুগ (ঢাকা : অনন্যা, ৩য় সংস্করণ, ২০০১), পৃ. ৫৫৪।
২২. ফারুক আহমেদ-সম্পাদিত, উদার আকাশ (পশ্চিমবঙ্গ : ঘটকপুকুর, ভাঙড়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ১৯ বর্ষ, সংখ্যা ২য়, ২০১৯), পৃ. উৎসর্গ পত্র, ৯।
২৩. ড.মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, বাংলাদেশের ইতিহাস (ঢাকা:নওরোজ কিতাবিস্তান, একাদশ সং, ২০০৫, পৃ. ১৪৭।
২৪. কাজী আবদুল ওদুদ, শাশ্বত বঙ্গ (ঢাকা : ব্র্যাক প্রকাশনা, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থ সিরিজ, ২য় সংস্করণ, ১৯৮৩), ১৬৩।
২৫. খাজিম আহমেদ, বাঙালি মুসললান : আপন ভুবনের সন্ধানে (পশ্চিমবঙ্গ : প্রকাশক উদার আকাশ, ২০২১)।। মূল্য ৩০০ টাকা।।
উদার আকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে খাজিম আহমেদ-এর দুই ঐতিহাসিক গ্রন্থ। পাঠক দরবারে সমাদৃত হয়েছে। ইতিমধ্যে বেস্টসেলার গ্রন্থ দুটো সংগ্রহ করতে গবেষকদের মধ্যে চাহিদা তৈরি হয়েছে।
উদার আকাশ
কথা: +৯১ ৭০০৩৮২১২৯৮।। +৯১ ৯৮৩০৯৯২৯৫০