মোল্লা জসিমউদ্দিন টিপু,
রবিবারসীয় সকালে বঙ্গ রাজনীতিতে নুতন চমক দিলো ফুরফুরা শরীফ।কোন নির্ধারিত কর্মসূচি না রেখে, দলীয় রাজ্য নেতৃত্ব কে আগাম বার্তা না দিয়ে বাংলায় এলেন মিম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি।শুধু আসায় নয়, দক্ষিণবঙ্গের সাম্প্রতিক ‘সংখ্যালঘু মুখ’ আব্বাসউদ্দিন সিদ্দিকির সাথে বৈঠক সারলেন।সর্বশেষে মিম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি জানিয়ে দিলেন – ‘ ভাইজানের ( আব্বাস সিদ্দিকি) পরামর্শে আসন্ন বিধান সভায় চলবে তার দল’। আর এতেই সরগরম বঙ্গ রাজনীতি মহল।উর্দুভাষি মুসলিমদের ‘মসিহা’ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এবং দক্ষিণবঙ্গের বাঙালি সংখ্যালঘুদের ‘ভাইজান’ আব্বাস সিদ্দিকির যুগলবন্দী এখন বাংলার রাজনীতিতে তুফান আনতে চলেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। কমপক্ষে ৮০ টির মত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিধানসভা আসনে হেরফের করে দিবেন এই দুজন। কয়েকটি আসন জিততে পারলেও বাকি গুলিতে শাসক দলের চরম ক্ষতি করে দিতে পারে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এবং আব্বাস সিদ্দিকির জোট। সম্প্রতি বিহার ভোটে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে জাতীয় রাজনীতি সরগরম হয়। অন্য রাজ্য গুলি অপেক্ষা বিহারের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক পারদ ক্রমশ উদ্ধমুখি মিম দলের সাফল্য নিয়ে। কয়েকমাস পরেই এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। তাই গত লোকসভা ভোটের বিজেপির ১৮ টি আসন প্রাপ্তির পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে দ্বিতীয় স্থানে বিজেপির থাকাটা খুবই অস্বস্তিকর শাসক তৃণমূলের। লোকসভার ভোটের নিরিখে ১২০ টির মত বিধানসভা আসনে এগিয়ে গেরুয়া শিবির। ক্ষমতাদখলের লক্ষ্যমাত্রা অতিরিক্ত ৩০ টি আসনের মত। ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে জাতীয়স্তরে বিজেপি বিরোধী দলগুলির অভিযোগ – তেলেঙ্গানার সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসির ‘মিম’ দল আসলে বিজেপির গোপন মিত্র।যারা নাকি সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভোট কাটাকুটি করে পক্ষান্তরেই বিজেপি কে জিতিয়ে দেয়। বিহার নির্বাচনে ২০ আসনে প্রার্থী দিয়ে ৫ টিতে জিতেছে মিম দল কোন জোটসঙ্গী ছাড়াই। এর মধ্যে আবার ১২ টি আসন মহাজোট খুবই অল্প ভোটে হেরেছে এই মিমের সৌজন্যেই! যদি এই ১২ টি আসনে মহাজোট জিততো তাহলে বিহারে ক্ষমতা পূন দখল হত না বিজেপি জোটের। যে ৫ টি আসনে জিতেছে মিম, তা আবার পশ্চিমবাংলা সীমান্তবর্তী বিহারের বিধানসভা এলাকাগুলিতে। তাই সীমানার এপারে জিতলে ওপারে অর্থাৎ মালদা – মুর্শিদাবাদ – উত্তর দিনাজপুর জেলাগুলিতে মিমের প্রভাব পড়তে একপ্রকার বাধ্য। বিহার ভোটে উজ্জীবিত মিম প্রধান সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ইতিমধ্যেই মিডিয়ার সামনে বাংলার শাসক দলের সাথে জোটের প্রস্তাব রেখেছেন। ওয়াকিবহাল মহল জানে – ‘৪০ আসন চাওয়া মিমের সাথে আসনরফা বাস্তবিক ক্ষেত্রে তৃণমূলের পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়’। রাজনৈতিক কারবারিরা বলছেন – ‘তৃনমূল যাতে মিম কে বিজেপির দালাল না বলতে পারে, সেজন্যই তৃণমূলের সাথে আগাম আসনরফার কথা মিডিয়ায় প্রচার করলো মিম’।তৃণমূল এ নিয়ে উচ্চবাক্য না করলেও মিমের নেতারা তখন বলবেন – আমরা তো বিজেপি কে হারাতে জোট চেয়েছিলাম তৃণমূলের সাথে ‘। তৃনমূলের অন্দরমহলের দাবি – মিমের কিছুটা প্রভাব উর্দুভাষী মুসলিমদের মধ্যে। বাঙালী মুসলিমদের মধ্যে নেই। মিম কে নিয়ে এতই আশংকা যে বিধানসভা ভোটের আগেই আসানসোল উত্তর কেন্দ্রে সংখ্যালঘু প্রার্থীর দাবি তুলেছে শাসক দলের প্রাক্তন কয়েকজন কাউন্সিলর। এখানে আবার বিধায়ক রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। মিম প্রাথমিকভাবে এই রাজ্যে ৪০ টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। যদি ৩০ টি আসনে মুসলিম ভোট কেটে বিজেপির পরোক্ষ নির্বাচনী লড়াইয়ে জিতাতে পারে, তাহলে গত লোকসভা ভোটের নিরিখে এগিয়ে যাওয়া আসনগুলির সাথে মিমের সৌজন্যে অতিরিক্ত ৩০ টি আসন পেলে বিজেপির বঙ্গ বিজয় অনেকটা সহজ হতে পারে। তবে এইসব রাজনৈতিক অঙ্ক। কতটা মিলবে তা নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি বলবে। মিমের পাশাপাশি ফুরফুরা শরিফের আব্বাস ভাইজান ( সিদ্দিকি) কে নিয়েও বিড়ম্বনায় শাসক দল।মূলত ভাঙ্গর – ক্যানিং নিয়ে সমস্যা হলেও দক্ষিণবঙ্গের ৪০ টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন ফুরফুরা শরিফের আব্বাস সিদ্দিকি।ভাঙ্গরে আব্বাস সিদ্দিকি আক্রান্ত হওয়ার পর যেভাবে দক্ষিণবঙ্গে হাজার হাজার পীরসাহেবের অনুগামীরা শাসক দলের বিরুদ্ধে হুংকার ছেড়েছিলেন। তাতে মিমের পাশাপাশি আব্বাস সিদ্দিকির ভূমিকা এই রাজ্যের শাসক দলের কাছে ক্ষতিকারক হতে চলেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। অন্যদিকে একদা ‘মাদ্রাসা ছাত্র ইউনিয়নে’র সাধারণ সম্পাদক তথা ‘সারাবাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনে’র সভাপতি মহম্মদ কামরুজ্জামান সম্প্রতি মহাজোটের অন্যতম কারিগর সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরীর সাথে সভা সেরেছেন। তৃনমূল এবং বিজেপি কে সমান বিপদ ভেবে কামরুজ্জামান সাহেব তাঁর সাংগঠনিক শক্তি কে মহাজোটে নিয়ে যেতে পারেন। ‘প্রগেসিভ ইয়ুথ ফাউন্ডেশনে’র কর্মকর্তা সিয়ামত আলি সব ধরনের পরিস্থিতি দেখে সংখ্যালঘুদের প্রকৃত উন্নয়নে সঠিক সময়ে সির্দ্ধান্ত জানাবেন বলে জানিয়েছেন। শাসক দল তৃণমূলের সেইরকম হেভিওয়েট সংখ্যালঘু নেতা নেই বললেই চলে। প্রয়াত হয়েছেন মন্তেশ্বরের প্রাক্তন বিধায়ক আবু আয়েশ মন্ডল। যিনি সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে এসেছিলেন। তৃনমুলের তরফে রাজ্যের সহ সভাপতি পদ, পরবর্তীতে সংখ্যালঘু উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান ছিলেন। অতীতে বাম আমলে আবু আয়েশ মন্ডল রাজনৈতিক জগতে নিজস্ব ধারা থাকলেও তৃণমূল আমলে দলবদলের পর কিছুই ছিলনা।ক্যানিং এর রেজ্জাক মোল্লাও আবু আয়েশ মন্ডলের মতন ভূমিকায় দেখা যায়। জমিয়ত উলেমা হিন্দের নেতা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর নিরঙ্কুশ প্রভাব মুসলিম জগতে একদা থাকলে টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বরকতির গাড়িতে লালবাতি নিয়ে যে বিক্ষোভ প্রদর্শন কর্মসূচি নিয়েছিলেন। তাতে উর্দু ভাষী মুসলদের দু চোখের ‘বিষ’ সিদ্দিকুল্লাহ। এইরুপ দাবি উর্দুভাষী মুসলিমদের।মঙ্গলকোটের শাসক দলের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেভাবে পদে পদে অসহযোগিতা – অপমান পেয়েছেন, তাতে জমিয়তের একাংশ তাদের সাংগঠনিক নেতা কে বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় ক্ষমতালোভী বলে সমালোচনা করে থাকে। ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে বিহার ভোটে মিমের সাফল্য বাংলার শাসক দলের রাতের ঘুম কে অনেকটাই কেড়ে নিতে চলেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে রবিবার মিম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি চলে আসেন ফুরফুরা শরীফের আব্বাস সিদ্দিকির বাড়িতে। তাও কোন নির্ধারিত কর্মসূচি ছাড়াই।আবার, রাজ্য নেতৃত্ব কে আগাম বার্তা না দিয়ে চলে এসে তিনি আব্বাস সিদ্দিকির গুরত্ব কতটা তা বুঝিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।উত্তরবঙ্গে মিমের প্রভাব রয়েছে উর্দুভাষি মুসলিমদের মধ্যে , আবার দক্ষিণবঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকির প্রভাব রয়েছে বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে। কমপক্ষে ৮০ টি আসন টার্গেট করেছেন এই দুজন নেতা বলে বিশস্ত সুত্রে জানা গেছে। এখন দেখার আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারেন এই দুজন। তবে জয়ের আসন সংখ্যা হাতে গোনা হলেও ৭০ এর কাছাকাছি আসন শাসক দলের অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বাড়াতে পারে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ও আব্বাস সিদ্দিকির যুগলবন্দীর জোট।