দুর্গা
সুজান মিঠি (জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান)
‘অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাং
চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্ ।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা
ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্ ।।’
আমি বজ্রের মত কঠিন!
অগ্নির মত ক্রুদ্ধ
সমুদ্রের মত উত্তাল
আমার চোখে স্পর্ধা, বুকে প্রত্যয়, হাতে অস্ত্র…
আমি দুর্গা। আমি দশভূজা! আমি মহিষাসুরমর্দিনী…
আমি মাটির মত কোমল।
খড় আর বাঁশের উপর লেপে আমাকে মা বানিয়ে নেওয়া যায় সহজেই।
আমার দিকে মন্ত্র আর ফুল ছুঁড়ে চেয়ে নেওয়া যায় বর,
আমার মাটির মুখে গুঁজে দেওয়া যায় সন্দেশ।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় ক্ষুধার্ত মুখগুলো তাচ্ছিল্য দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া যায়।
বলা যায়, এই এই, ছুঁয়ে ফেলছিস নাকি রে?
পাপ দেবে যে মা!
আমার প্রতিমার কণ্ঠে বলে ওঠা হয় না, মা কখনো এমন করে দুঃখ দুঃখ মুখে পাপ দেয় না। আনন্দ দেয়।
ওদের পাশে এসে দাঁড়ায় অন্নদা।
প্রসাদের থালা উজাড় করে দিয়ে বলে, কাল বিজয়া। আমাদের বাড়িতে যাস। ভোগ খেয়ে আসিস।
আর ঠিক এই কারণেই আমার আর কিছুই বলা হয়ে ওঠে না।
মুখে গুঁজে দেওয়া সন্দেশ নিয়ে জলে পড়তে হয় ধুপ করে।
নিদ্রা ভঙ্গ হলে পুনরায় আমি আকাশের মত প্রকাণ্ড।
আমি নদীর মত সুমিষ্ট
আমি স্বপ্নের মত সুখ
আমার অর্ধেক দৃষ্টিতে কান্না এসে পড়ে
আমি যন্ত্রণার মত ভয়ানক হয়ে উঠি।
অত্যাচারিতা নারী তার ভাঙা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মৃত্যুর তীরে বসে।
পাশে এসে বসে অন্য পুরুষ। হাত ধরে বলে,
কী ভাবছ, সবাই একরকম?
আমার যন্ত্রণার মত অস্ত্র ফিরে আসে।
বলে, ওই দেখো। এখনো প্রাণ আছে।
আমি প্রতি শরতের শিউলিতে মিশে ঘন হাসি হয়েছি। আমি কাশের বাতাসে মিলে রাশি রাশি আলো হয়েছি।
আমার দৃষ্টি প্রশান্ত, উচ্চারিত হয়েছে, এখনো প্রাণ আছে…
হঠাৎ মেঘ করে আসে! আমি চোখ মেলতেই নদী বলে, এ তো শরৎ! এমন তো হবেই!
মাটি বলে, না এ কালবৈশাখী। ভালো করে দেখো।
পৃথিবীর নাড়ি টিপে দেখি, স্পন্দন বড় কম।
এইবার?
আমি খুঁজে চলি…
অন্নদা কোথায়? সেই পুরুষ? কোথায় আনন্দ?
কোনোদিকে কোনো নিমন্ত্রণ নেই তো!
সে পুরুষের প্রবল পরাক্রম প্রতিধ্বনিত হয়, ভাবছো সবাই ভালো?
আমার পা টলছে…
দশ হাত কম্পিত!
আকাশ, মাটি, বৃষ্টি, শরৎ, কাশ, শ্বাস সকলেই কম্পিত…
ক্রোধে আমি দৃষ্টিহীন! সৃষ্টিহীন!
অপেক্ষা করো অসুর!
আমার ক্রোধ বর্ধিত হতে হতে আকাশ ছুঁয়ে ফেলুক একবার!
আমি সে আকাশে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর দিকে ছুঁড়ে দেব প্রবল বজ্র…
ধ্বংস হবে সব!
আমাকে গড়তে হলে প্রাণ দিতে হবে এরপর…
সে প্রাণের নাম হবে মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা …
নইলে, এমন কোনো মাটি থাকবে না যে হাসতে হাসতে নিজের শরীরে আমাকে আঁকবে।