মননের খোরাক, মনের স্বস্তি
সুরাজ পাল
শরৎ আসবে, নীল আকাশের শুভ্র মেঘের ভেলা ভাসবে, নদীর তীরে রাশি রাশি কাশফুল দুলবে অথচ শারদ সাহিত্যসম্ভার আত্মপ্রকাশ করবে না, এমনটা হতে পারে না। আপামর বাঙালির সর্বজনীন ঈদ ও দুর্গোৎসবের সঙ্গে শারদ সংখ্যা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। শুধু শহর কলকাতা নয়, শহরতলী থেকে মফঃস্বল এমনকি গ্রামও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। কলেবরে ছোটো হোক বা বড়–সব প্রতিষ্ঠানই পাঠকের রুচি ও চাহিদাকে মাথায় রেখে শারদ সংখ্যা বের করে থাকে। উৎসবের নতুন পোশাক ও বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে উৎসব সংখ্যাগুলোও মানসিক স্বস্তির বড় আয়োজন। সম্প্রতি হাতে এল ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার ঈদ–শারদ উৎসব সংখ্যা ১৪৩০। বিষয়বৈচিত্র্য পরিপূর্ণ ১৪৮পৃষ্ঠার এই সংখ্যা সাজানো হয়েছে ভিন্ন স্বাদের ছোটো–বড় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, স্মরণালেখ্য, সাক্ষাৎকার, ভ্রমণকাহিনী, গ্রন্থ পর্যালোচনা দিয়ে। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে যত্নের সঙ্গে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়ে আসছে, এবারেও তার অন্যথা হয়নি। এবারে সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হয়েছে প্রখ্যাত সাংবাদিক–সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষকে। শুরুতেই সম্পাদকীয় মহাশয় বহুত্ববাদী ভারতের জয়গান গেয়ে, সকলকে মিশ্র সংস্কৃতির ভারতীয় ঐতিহ্য অটুট রাখতে আহ্বান করেছেন সম্পাদকীয় লেখাতে।
নবনীতা দেবসেন লিখেছিলেন, গৌরকিশোর ঘোষ এমন একজন মানুষ, যিনি বিশ্বাসে, চিন্তায় এবং জীবন–যাপনে কখনও ভাবের ঘরে চুরি করেন নি। বর্তমান সময়ে যখন দেশপ্রেম এবং সরকারপ্রীতি সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন গৌরকিশোর ঘোষের চিন্তা আমাদের ভাবায়। এই সংখ্যায় গৌরকিশোর ঘোষের নিজের একটি লেখা রয়েছে, আবার তাকে নিয়ে পাঁচটি স্মরণালেখ্যও স্থান পেয়েছে। দেশপ্রেমের ব্যাখ্যা যে এক রৈখিক নয়; ব্যক্তিভেদ, সময়ভেদ, সমাজভেদে দেশপ্রেমের ধারণা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে সে কথাই বারেবারে বলতে চেয়েছিলেন তিনি। এই যেমন শেখ মুজিবুর রহমান– বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক, বঙ্গবন্ধু অথচ তিনিই পাকিস্তানের কাছে শত্রু, দেশদ্রোহী। আবার একই দেশে দুজন ব্যক্তি ভিন্ন সময়ে একই রকম পদক্ষেপ নিলেও যে একজন দেশ প্রেমিক, একজন দেশদ্রোহী হতে পারে তা সুভাষচন্দ্র বসু ও নাগাল্যান্ডের ফিজোর উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট হয়। মীরাতুন নাহার গৌরকিশোর ঘোষের গুল্পগুলি (গুল+গল্প) থেকে কিছু নিদর্শন তুলে ধরেছেন। এই গুল্পগুলিতে একদিকে যেমন রয়েছে হাস্যরসের ফোয়ারা, অন্যদিকে তেমনি আছে বুদ্ধির ঝলকানি। দেবাশিস পাঠকের কলমে উঠে এসেছে উপন্যাসিক গৌরকিশোর ঘোষের ট্রিলজি প্রেম নেই, জল পড়ে পাতা নড়ে, প্রতিবেশী-র পর্যালোচনা। জয়ন্ত ঘোষাল লিখেছেন, আজ সার্কুলেশন, টিআরপি, ডিজিটাল হিট, সেনসেশনের এক ভয়ঙ্কর ফাঁদে বন্দী সংবাদপত্র। এখনও মনে আছে আজকাল পত্রিকায় যখন সবাই অন্য কোনো খবরে ব্যস্ত তখন তিনি উত্তরবঙ্গের চা বাগানের শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে রিপোর্টারদের পাঠিয়ে ধারাবাহিকভাবে সিরিজ করাচ্ছেন। অথবা এক আধুনিক প্রজন্মের চলচ্চিত্র চিন্তা, সাহিত্য চিন্তা প্রকাশ করছেন। ভাগলপুরে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে আনন্দবাজার রবিবাসরীয়তে লেখা মনুষ্যত্বের সন্ধানে (১৯৯০) প্রবন্ধটি তিন দশক পর ফিরে দেখার চেষ্টা করেছেন মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, গৌরদা সেই খোঁজটা শুরু করেছিলেন–কিভাবে কোন সে মুহূর্তে বদলে যায় অবিরত চেনা মুখ, জ্বালিয়ে দেয় ছোটবেলার খেলার সাথীদের, অকথ্য নির্যাতন করে পাশের বাড়ির বালকটিকে–যে তার মেয়ের খেলার সঙ্গী। কোনদিনও যার হাত ওঠে না সেই হাতে ঝলসে ওঠে তরবারি, কোন সে উন্মাদনা ভর করে ছাত্রদলকে–যারা ছুটে যায় প্রিয় শিক্ষিকার রক্ত নিতে, শুধু সম্প্রদায় ভিন্ন বলে। পাশাপাশি আরও একটি অনুসন্ধান ছিল– কীভাবে ফিরবে বিশ্বাস, কীভাবে জাগবে ভরসা, কীভাবে আবার থাকা যাবে পাশাপাশি ঘর বেঁধে। বিগত ২০ জুন, ২০২৩ বিড়লা সভা গৃহে গৌরকিশোর ঘোষ জন্ম শতবর্ষ উদযাপন কমিটি যে স্মরণসভার আয়োজন করেছিল তার রিপোর্ট তুলে ধরেছেন অরূপ বন্দোপাধ্যায়। অশোক মজুমদার লিখেছেন গৌরকিশোর ঘোষের দূরদর্শিতা সম্পর্কে।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর মধ্যে বিশ্বভারতী ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের জমিসংক্রান্ত বিরোধ, অগ্নিগর্ভ মণিপুরের প্রসঙ্গটিও উঠে এসেছে। অমর্ত্য সেন কী করেন, কী ভাবেন, কী তার অবদান, কেন কেন্দ্রীয় সরকারের তার প্রতি এত আক্রমণাত্মক মনোভাব– এরকম বহু প্রশ্নের উত্তর মিলবে জয়ন্ত সিংহ, গোলাম রাশিদ, একরাম আলির লেখায়। জয় গোস্বামী’র কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে মণিপুরের বর্তমান অবস্থা। তিনি লিখেছেন– বৃদ্ধ শরীরে যে চামড়া অবশিষ্ট/সেটুকু ছাড়িয়ে তোদের দিচ্ছি/তা দিয়েই দেহ ঢাক মা! রবীন্দ্রনাথ ও মোসলেম ভারত পত্রিকার সম্পর্ক নিয়ে চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখেছেন মুহম্মদ মতিউল্লাহ্। জানা যায়, মোসলেম ভারত পত্রিকার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য শান্তিনিকেতনে যাঁরা যেতেন তাদের অনেকের নিকটেই তিনি পত্রিকাটির কথা উল্লেখ করেছেন। ইসলামী দুনিয়ার কয়েকজন মনীষীতুল্য ঐতিহাসিক আল বিরুনী, ইবনে খালদুন ইবন বতুতা, আবুল ফজল, আব্দুল কাদের বদায়নির জীবন এবং সৃষ্টকর্মের বিবরণ দিয়েছেন খাজিম আহমেদ। বাঙালি মুসলিম সমাজের দুই অগ্রনায়ক সাহিত্যিক আবদুল আজীজ আল আমানকে নিয়ে লিখেছেন মহিউদ্দিন সরকার ও শিল্পপতি মোস্তাক হোসেনকে নিয়ে লিখেছেন কাজী খায়রুল আনাম। দুটি মনোজ্ঞ লেখা পাঠক দরবারে দাগ কেটেছে। শঙ্খ ঘোষ ও সুবোধ সরকারের কবিতার ভুবন নিয়ে আলোচনাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
মিশরের সুপ্রাচীন গ্রন্থাগারগুলির নাম করলে প্রথম সারিতেই থাকবে আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের কথা। লোকশ্রুতি আছে, মিশর বিজয়কালে খলিফা হজরত ওমরের নির্দেশ মেনে তার সেনাপতি আমর ইবনুল আস ছয় মাস ধরে আলেকজান্দ্রিয়ার অসংখ্য স্নানাগারের অগ্নিকুণ্ডে গ্রন্থাগারের মূল্যবান বই ফেলে ধ্বংস করেছিলেন। এই লোকশ্রুতি যে সত্য নয়, তার সমর্থনে বিভিন্ন তথ্য ও যুক্তি তুলে ধরেছেন আমিনুল ইসলাম। তাঁর কথায়, আসল ঘটনা হল এই লাইব্রেরী বারবার ধ্বংস হয়েছে, আবার গড়া হয়েছে। বিশ্বে নারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। অথচ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর গণিতের মতো বিষয়ভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে শীর্ষ পদগুলোর অধিকাংশই পুরুষদের দখলে। বিজ্ঞানীদের কাঙ্খিত চূড়ান্ত পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত নোবেল বিজয়ীদের তালিকায়ও দেখা যায় পুরুষদের জয়জয়কার। মুসলিম নারী নোবেলজয়ীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও প্রকট। ১২১ বছরের ইতিহাসে মাত্র তিনজন মুসলিম নারী নোবেল পাওয়াটা সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু কেন মুসলিম নারীরা নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে? সে অনুসন্ধানই করেছেন শাহানা পারভীন লাভলী। রাজনীতি নিয়ে সময়োপযোগী দুর্দান্ত প্রবন্ধ লিখেছেন মইনুল হাসান। কল্যাণী কাজীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন সোমঋতা মল্লিক।
আর রয়েছে একগুচ্ছ সুখপাঠ্য কবিতা। কবিতাগুলি কখনও হাসায়, কখনও কাঁদায়, কখনও ভাবায়। ভালো লাগে, এতগুলো কবিতার কোনটিতেই অহেতুক দুর্বোধ্য শব্দের ঝনঝনানি নেই। পারিপার্শ্বিককে সহজ ভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে সচেতন এই কবিরা। দ্য গ্রেটেস্ট এনিমি অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার শিরোনামে সুভাষচন্দ্র বসুর স্মরণে কবি সুবোধ সরকারের কবিতাটি এই সংখ্যার অনন্য সংযোজন। পত্রিকার গল্প বিভাগটিও শক্তিশালী। আছে ভিন্ন ধারার একগুচ্ছ গল্প। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘাত–প্রতিঘাত, জীবন সংগ্রাম আর প্রতিদিনের জীবনের নানাধরনের অনুভূতিই ধরা রয়েছে গল্পগুলিতে। গল্পগুলি পড়তে ভালোলাগে, প্রায় প্রতিটা গল্প থেকেই পাঠক জীবন সর্ম্পকে নতুন কিছু শিখতে পারবেন, জানতে পারবেন এবং বুঝতে পারবেন। সোনিয়া তাসনিমের ভ্রমণকাহিনী পড়ে মানসচক্ষে সিলেটের লালাখাল ঘুরে আসা যায়। আবার রতন ভট্টাচার্যের লেখা পড়ে আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থার ধরণ সম্পর্কে ধারণা হয়। মননশীল প্রাবন্ধিক একরামূল হক শেখের সাক্ষাৎকারটিও আকর্ষণীয়। একদম শেষে সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় ও খাজিম আহমেদের কলমে যথাক্রমে চুনী কোটালের আত্মহত্যা ও বাবরি ধ্বংসের তিন দশক বই দুটির পর্যালোচনা উঠে আসা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। পত্রিকাটির বাঁধাই, ছাপা খুব ভালো। প্রচ্ছদ মন কেড়েছেন কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত। পত্রিকা নির্মাণে সম্পাদকের শ্রম ও নিষ্ঠা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। উদার আকাশ সংখ্যাটি যে সর্বস্তরের পাঠকদের কাছে সমাদৃত হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
উদার আকাশ, ঈদ–শারদ উৎসব সংখ্যা ১৪৩০। সম্পাদক: ফারুক আহমেদ। ঘটকপুকুর, ভাঙড় গোবিন্দপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা–৭৪৩৫০২। মূল্য: ১০০ টাকা।