ম্যান মেড বন্যা- চলুক তর্জা, বন্ধ হোক মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী, গুসকরা, পূর্ব বর্ধমান -:
নদীর উৎসমুখে ও অববাহিকা অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে এবং নদীর জল ধারণ ক্ষমতা কম হলে অতিরিক্ত জল নদীর দু'কূল ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকাকে প্লাবিত করে তোলে অর্থাৎ বন্যা হয়। এই বন্যাকে ত্বরান্বিত করতে অনুঘটক হিসাবে কাজ করে সংশ্লিষ্ট নদীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত নদী বাঁধ থেকে অতিরিক্ত ছাড়া জল।
মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, মৎস চাষ, পরিবহন, পর্যটন ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এই বাঁধগুলি তৈরি করা হয়। শোনা যায় বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মেঘনাদ সাহা নাকি বলেছিলেন এই বাঁধগুলি অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করার জন্য একদিন খেসারত দিতে হবে।
দক্ষিণবঙ্গের উপর দিয়ে বয়ে চলা অধিকাংশ নদীর উৎপত্তিস্থল ছোটনাগপুর মালভূমি। এদিকে ভূমির পশ্চিমমুখী ঢাল অনুসরণ করে নদীগুলি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই ঝাড়খণ্ডে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেই জলের চাপ নদী বাঁধের উপর এসে পড়ে। বাঁধ বাঁচানোর জন্য কর্তৃপক্ষ জল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়। একেই বলা হচ্ছে 'ম্যান মেড' বন্যা। এই মুহূর্তে, মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, এই 'ম্যান মেড' বন্যার জন্য দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ বিপর্যস্ত।
নদী বাহিত পলি এসে জমা হয় নদী গর্ভে ও বাঁধের জলধারণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। জানা যাচ্ছে এই কারণে ডিভিসির জলধারণ ক্ষমতা নাকি ৫২℅ কমে গ্যাছে। এরফলে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেই বন্যা অনিবার্য হয়ে ওঠে। ফলে প্রাণহানি যেমন ঘটছে তেমনি ফসলেরও প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। প্রশ্ন হলো - প্রতিবছর বাঁধ সংলগ্ন নদী গর্ভ কি নিয়মিত ড্রেজিং করা হয়? এই একটা ক্ষেত্রে প্রতিটি শাসকদল উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। শাসকদলগুলোর কাছে সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নাই!
সাংসদ দেব নাকি একবার আক্ষেপ করে সংসদে বলেছিলেন, তার বয়স যত হয়েছে তার আগে থেকেই ঘাটাল পরিকল্পনার কথা শুনে আসছেন। অথচ সেটা আজও বাস্তবে পরিণত হলোনা। ভুগছে তো সাধারণ মানুষ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার সমস্ত দলের মানুষ হয়। দলমত নির্বিশেষে এইরাজ্যের সাংসদদের এই বিষয়ে কেন্দ্র সরকারকে চেপে ধরতে দ্যাখা গ্যালোনা। এরাই আবার নির্লজ্জের মত ভোট চাইতে যায়!
মাঝে মাঝে শোনা যায় ড্রেজিংয়ের ফলে নদী গর্ভ থেকে তোলা বিপুল পরিমাণ পলি কোথায় রাখা হবে? এই পলি দিয়ে কয়লা তোলার ফলে খনির মধ্যে যে ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হয় সেগুলো ভরাট করা যেতেই পারে। ফলে খনি অঞ্চলে ধ্বস নামবেনা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নদীর বাঁধ নির্মাণ করা যেতে পারে।
প্রয়াত কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী একবার নদী সংযোগের প্রস্তাব দ্যান। তাঁর বক্তব্য মোটামুটি এরকম ছিল - যেসব নদীতে সারাবছর জল থাকে ও প্রতিবছর বন্যা হয় খাল কেটে সেগুলি যদি শুষ্ক নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হয় তাহলে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। আবার শুষ্ক নদীগুলিতে জল থাকবে ও সেচের সুবিধার পাশাপাশি মৎস চাষ করা যেতে পারে।
খরচের ভয়ে সরকার নাকি পেছিয়ে যায়। অথচ কর্পোরেট সেক্টরগুলোর কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ ও কর মকুব করতে কোনো সমস্যা হয়না। সরকার তার কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য তার কাছে নাই।
একদল তথাকথিত পরিবেশবিদও নদী সংযোগে বাধা সৃষ্টি করে। তাদের বক্তব্য এরফলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হবে। নগরায়নের নামে কংক্রিটের জঙ্গলে পড়ে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার শুকিয়ে যাচ্ছে সেই বিষয়ে তারা নীরব। ওখানে যে ধনী সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে! হতে পারে ওখান থেকে কিছু মুনাফা পাওয়া যায় যেটা সাধারণ মানুষের কাছে পাওয়া যায়না।
একান্ত আলাপচারিতায় বিশিষ্ট ভূগোলবিদ দীনেশ সাঁতরা বললেন, বর্তমান যুগে বিজ্ঞান অনেক উন্নত। প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ না করা গেলেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নদী গর্ভ ড্রেজিং করে ও বাঁধ শক্ত করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যেতেই পারে। দরকার সরকারের সৎ মানসিকতা। এখনো যদি মানুষকে পুরোপুরি প্রকৃতির কৃপার উপর নির্ভর করতে হয় সেটা বড় লজ্জার! সেক্ষেত্রে টেকনোলজি ফর ম্যানকাইণ্ড' অর্থহীন।