‘সোহাগের পাঠশালা’ – গদ্য ছন্দে গড়ে ওঠা কাব্যগ্রন্থ
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
দুর্গাপুরের খাঁটপুকুরের আটপৌরে গৃহবধূ সঙ্গীতা মুখার্জির কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম 'সোহাগের পাঠশালা' দেখলেই কাব্যরসিক পাঠক সহজেই বাৎসল্য সোহাগের ভাবজগতে পৌঁছে যাবেন। তাদের ভাবনার অবচেতন মনে জন্ম নেবে ছোটবেলায় ফেলে আসা পাঠশালার সেই দৃশ্য যেখানে মাস্টারমশাইরা পরম স্নেহে আদরে, সোহাগে অবোধ শিশুদের যেমন পাঠদান করছেন এখানেও হয়তো সেরকম কিছু একটা কবির কলমে ফুটে উঠেছে। অথচ কাব্যগ্রন্থের গভীরে গেলে দেখা যাবে সেখানে থাকা ১২ টি কবিতার মধ্যে ধরা পড়েছে সম্পূর্ণ অন্য চিত্র। এই চিত্র পরিচিত পদ্য ছন্দের পরিবর্তে গড়ে উঠেছে গদ্য ছন্দে। কিন্তু প্রকৃত রস আস্বাদনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যাঘাত ঘটায়নি।
'...আলগা পিরিত আমার মোহনায় আগুন লাগায়...' বলেই হয়তো 'এবার সে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে চায়...' - প্রথমে আগুন, পরে বৃষ্টির মাধ্যমে শান্ত হয় প্রেমিক-প্রেমিকার মনের গভীরে জমে থাকা তীব্র অভিমান! তাকেই 'সোহাগের পাঠশালা' ভেবে নেওয়ার কথা বলা হয়। এভাবেই তো মা তার সন্তানকে সোহাগ করেন। ওদিকে 'হঠাৎ পোড়া গন্ধ' পেয়ে প্রেমিকা ভেবে নিয়েছে ওটা হয়তো 'শুধু সম্পর্ক' পোড়ার গন্ধ। তারপরও তার মধ্যেই শোনা যায় চরম আত্মবিশ্বাসের সুর '... তোমাকেই আসতে হবে একদিন...।' এর মাঝে অদ্ভুত এক বৈপরীত্য দেখা যায়। একদিকে 'আমি পুড়ছি তোমার কল্পনায়', অন্যদিকে 'কল্পিত তুমির আলিঙ্গনে আবদ্ধ' - এই ভাবনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে প্রেমের গভীরতার তাৎপর্য, যার মধ্যে থাকে 'রাসের বাঁশির মতোই তোমার মোহনীয় জোছনা।' রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের ইঙ্গিত স্পষ্ট ধরা পড়ে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলনের আশায় শাড়ির 'আঁচল ক্রমশ ঠিকানা হারিয়ে' প্রেমিকের 'স্বপ্নে আমি বিভোর' ঠিক তখনই এলার্মের শব্দ সব স্বপ্নের জাল ছিন্নভিন্ন করে দেয়। হতাশ প্রেমিকা হয়ে ওঠেন 'সাধন বৈষ্ণবী'। তবুও 'ফিনিক্স পাখির মত' ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় এবং 'সোহাগের সানাই' বেজে ওঠার কল্পনায় 'একাকী অপেক্ষায়' রাই সেজে বসেও থাকেন।
এভাবেই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার মধ্যে ধরা আছে মানব প্রেমের বাস্তব ও কল্পনার এক মিশ্রিত অনুভূতি। গদ্য ছন্দেও প্রেম হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। প্রতিটি কবিতা পাঠককে ভাবনার গভীরে নিয়ে যাবেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শব্দ ও বাক্য বন্ধনী ব্যবহারের কবি যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। কাব্যগ্রন্থটি ছোট্ট হলেও পাঠকের মন আরও কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় রাই সেজে বসে থাকবেন।
কবিতাগুলি পাঠ করে কবি মুনমুন মুখার্জ্জীর ছোট্ট প্রতিক্রিয়া, সময় ও ধৈর্য্য ধরে কবিতাগুলি পড়লে কাব্যরসিক পাঠকের ইচ্ছে পূরণ হবেই। সংসারের সমস্ত কাজ সামলে একজন গৃহবধূর পক্ষে এই ধরনের কাব্য রচনা করা যথেষ্ট কষ্টকর।