পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে ‘কাছের লোক’ হয়ে উঠেছেন সাদিকুল

Spread the love

পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফিরিয়ে রাতারাতি বিখ্যাত সাদিকুল ইসলাম

মীনাক্ষী ভট্টাচার্য,

করোনা প্রকপে লকডাউন শুরু হল সমগ্র দেশ জুড়ে, এই লকডাউন পরবতী এক সকালে বীরভূমের মুরারইয়ের পাইকর থানার অর্ন্তগত কাশিমনগর গ্রামের সাদিকুল ইসলাম নামে ২৮ বছর বয়সী আই টি কম্পানীতে কর্মরত এক যুবক তার দুই বন্ধু নূর আলাম এবং নাসিরউদ্দীন আনসারীকে নিয়ে নিজের গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিকদের খাবার পৌছে দেওয়ার ব্যাবস্থা শুরু করেন, কারণ ব্যাক্তিগত জীবনে কিছু সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে সাদিকুল পরিযায়ী শ্রমিক খাদ্যের সংকটের কথা আনুমান করেন, ভীন রাজ্যে আটকে পড়া শ্রমিকরা যখন ফেসবুকের মাধ্যমে আবেদন জানাতে থাকে, তখনই সাদিকূলরা গ্রামের স্থানীয় একটি ক্লাবে বসে শুরু করে খাদ্য অভিযান। শুরু হয় পুলিশ ও অধিকারীকদের সাথে যোগাযোগ করা,এইভাবে শুরু করে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ ও পরবর্তীতে সমগ্র দেশ ব্যাপী অভিযান চালায় ওই তিন যুবক। ব্যাক্তিগত কোন অর্থ ব্যয় না করে বা কারোর থেকে কোন অর্থ সাহায্য না নিয়ে, এবং কোন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব বা কোন সংস্থার সাথে যুক্ত না থেকেই সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় তারা সক্ষম হয় এক লক্ষের ও অধিক পরিযায়ী শ্রমিককের কাছে খাবার পৌচ্ছে দিতে। এই কাজের জন্য তারা রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারি অধিকারীক (এস পি ও ডি এম) ও আরো অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা গণের সাথে যোগাযোগ করেন। কোন কোন রাজ্যে তারা খুব সহজেই সাহায্য পায়, আবার কোন কোন রাজ্যে তারা ব্যার্থ ও হন, কিন্তু কোন অবস্থাতেই তারা হাল ছাড়েন না। এই বিষয়ে তারা সর্ব প্রথম সহযোগীতা পায় কেরল সরকারের কাছ থেকে, কেরলে অটকে থাকা পশ্চীমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে তারা কেরল সরকারী উচ্চপদস্থ পদাধিকারীদের মোবাইল নম্বর, এবং একই ভাবে তারা পরিযায়ী শ্রমিকদের নামের তালিকা ও মোবাইল নম্বার পৌছে দেন সরকারী ভারপ্রাপ্ত কর্তাদের হাতে। কেরলের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের ব্যাক্তিগত ফোন নাম্বারে তারা কথা বলেন, এই পদ্ধতি উপকার পান কেরলে আটকে থাকা পশ্চিমবঙ্গের অসংখ্য শ্রমিক। প্রত্যেক বার শ্রমিকরা ফোন করে খাবার চায় এবং ঠিক সময় মত তারা খাবার ও পায়। এই পুরো বিষয়টির ক্রমাগত তত্ত্বাবধান করে সাদিকূলরা। এই কাজে তাদের দৃষ্টান্তমূলক সহায়তা করে কেরল ও তেলেঙ্গানা সরকার।

পরবর্তী পর্যায়ে তামিলনাডু,কর্ণাটক ও মহারাষ্টের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের কাছে পৌছাতে ব্যার্থ হলে সাদিকূল যগাযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব তথা দেশের সর্বচ্চ পদাধিকারিক সাথে,এবং সম্পূর্ণ বিষয় তুলে ধরে। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব তাকে সাহায্যের আশ্বাস দেন, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিবের থেকে পাওয়া অন্যান্য আধিকারিক নাম্বরে যোগাযোগ শুরু করে সাদিকূল। তারপর আর পিছনে তাকাতে হয় নি,প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব মিঃ ভাস্কর খুলবে এবং ডি আই,পি পি এর যুগ্ম সচিব রাজেন্দ্র রত্ন এর সাহায্যে কিছু শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সাহায্য পায় সাদিকূল। এক্ষেত্রে তাদের পথটি পরিস্কারই ছিল, শুধুমাত্র পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্য সংকট এর সমস্যাটি তুলে ধরতে হয়ে ছিল। এরপর তিনি তামিলনাডুর আধিকারিক মিথীল রাজেন্দ্রানের (আই এ এস) থেকে ফোন পান। মিথীল রাজেন্দ্রানর সাহায্যে সমগ্র তামিলনাডু রাজ্যের শ্রমিকদের সম্ভাব্য সমস্ত রকম সাহায্য পৌচ্ছে দেওয়ার ব্যাবস্থা করা হয়। চেন্নাই কর্পোরেশেনের রাজস্য বিভাগের কর্মকর্তা সুকুমার চিত্তি বাবু ও তার সহকারি সচিব নটরাজনের সাহায্যে চেন্নাই কর্পোরেশন, বৃহত্তর চেন্নাই কর্পোরেশন এবং তামিলনাডুর অন্যান্য জেলায় জেলায় খাবার পাঠানো সম্ভব হয়। মুম্বাই এর ক্ষেত্রেও সাদিকূল সাহায্য চায় মুম্বাই এম, আই,ডি,সি এমডি অনবাজঘন ও মুম্বাই কর্পোরেশেন সচিব, মহারাষ্টের সমস্ত জেলা সংগ্রাহক অনিল ওয়াংখেরে থেকে, যার ফলে মুম্বাই সহ মহারাষ্টের অন্যান্য জেলাতে ও খাবার অভিযান চালানো সম্ভব হয়।
সাদিকূল নিজের প্রচেষ্টায় এই সমস্ত অফিসারদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের নামের তালিকা (ফোন নম্বর সহ) গঠন করে আধিকারিকদের হাতে তুলে দেন। একই সঙ্গে আধিকারিকদের নাম এবং ফোন নম্বরের তালিকা ও পৌচ্ছে যায় প্রত্যক শ্রমিকের হাতে,যেন প্রত্যক বার প্রয়োজনের সময় শ্রমিকরা সরাসরি আধিকারিকদের কাছে তাদের দাবি জানাতে পারে এবং প্রয়োজনে তাদের নিজেদের দাবি তারা নিজেরাই আদায় করে নিতে পারে। শ্রমিকদের কে ক্রমাগত এই বিষয়টিতে প্রশিক্ষণ দেন সাদিকূল।
পরবর্তীতে যখন শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে আসার জন্য সাদিকূলের কাছে আবেদন জানায়। তখন আবার শুরু হয় তাদের ঘরে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা,এবার সাদিকূল যোগাযোগ করলেন স্বরাষ্ট মন্ত্রালয়ের সচিব অজয় কুমার ভাল্লা (আই এ এস), জাতীয় দুর্যোগ পরিচালনার সচিব এর ভি থিরুপ্পুগাজ এবং সুনামি আঘাতের উদ্দার সচিব ড. জে রাধাকৃষ্ণাণ এর সাথে। পরবর্তীতে আরো অন্যান্য নোডাল অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করে সরকারি অর্থে সাহায্যে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে অসেন ভিন্ন রাজ্যে অটকে থাকা পশ্চিমবঙ্গের ৫৫০০ এর ও অধিক পরিযায়ী শ্রমিককে। সাদিকূলরা তাদের এখন পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। বিগত দুই বছর ধরে সাদিকূল নিজের গ্রামে এবং অনান্য অঞলে সাধারণ মানুষের যে কোন সমস্যায় এই ধরণের পরিষেবা দিয়ে চলেছে।

সাদিকূলের কাজের নতুন দিকটি হল – ১.কি ভাবে সাধারণ মানুষ সরকারের উচ্চ পদস্থকর্তা পর্যন্ত পৌচ্ছে দেওয়া যায়। ২.কি ভাবে ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে গিয়ে কোন নেতা /মন্ত্রী /কোন কর্তাব্যাক্তি না হয়েও কেবলমাত্র শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে এবং তথ্য সম্প্রচারণ কে কাজে লাগিয়ে দেশে সর্বচ্চ স্তর পর্যন্ত যাওয়া যায়,ও তথ্য সরবারহের মাধ্যমে কি ডিজিটাল মাধ্যমেও দাবি জানানো সম্ভব। ৩.সরকার, সরকারী কর্মকর্তারা জনগণের জন্যই, তাই নিজেদের সমস্যায় কাকে বলব?,কোথায় যাব?,কিভাবে বললে কাজ হবে?এই সমস্ত ক্ষেত্রে নিজেদের দাবি আদায়ের একটি নতুন দিক ও প্রতিবাদের একটি নতুন মাধ্যম যথা তথ্য সম্প্রসারণ মাধ্যমের প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই।
তাই আপনার স্থানীয় সরকারি অফিস যেমন পঞ্চায়েত/ কাউন্সিল/ কর্পোরেশন/ব্লক/ মহকুমা/তালুক/ জেলা সদর যদি কাজ না করে বা কাজ না করতে চায় তবে নাম্বার জোগাড় করুন আর নিজেই পৌচ্ছে দিন একদম উপর মহল পর্যন্ত। অন্য কেউ অপনাকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দেবে তার জন্য আর অপেক্ষা নয়। এবার আপনার হাতের স্মার্ট ফোনটিকে কাজে লাগান, সুবিধা নিন ইন্টারনেট পরিষেবার। প্রত্যেক উচ্চ পদস্থ ব্যাক্তিদের নিজস্ব মোঃ নাম্বার তাদের প্রত্যকে জেলার নিজস্ব ওয়েব সাইট পেজে বা গুগুলে একটু খুজলেই পাওয়া যায়। এটিই আমরা সাদিকূলের থেকে শিখি। এই বিষয়ে সাদিকূলের অভিব্যাক্তি হল; সরকার জনগণের পয়সায় চলে, সরকারি কর্মকর্তারা জনগণের কাজের জন্যই মাস মাইনে পান, আপনি শুধু আপনার ফোন ওঠান, নিজের দাবি কোন তৃতীয় মাধ্যম ছাড়াই নিজে জানান। নিজের দাবি আদায় করুন, কাউকে ফোন করতে কোন ভয় পাবেন না,সরকারী অফিসারদের তাদের কাজে সহায়তা করুন। নিজের দাবি নিয়ে সরাসরি নিজেই পৌঁছে যান।
এই কর্মযজ্ঞের বিশেষ দিকটি নজর কাড়ার মত। তাঁরা কিভাবে এই সরকার ও জনগণ কে একে অপরের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মত একটি নতুন পন্থা হিসেবে চিন্তা করা। আমরা অনেক সময় পরিসেবা পেতে ব্যর্থ হয় কারণ আমাদের অভাব ও সমস্যা সরকারের প্রাসঙ্গিক কোনো আধিকারিক এর কাছে পৌঁছায় না। সেখানেই এদের কার্যের অবদান। এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ফোন করার সময় মাথায় রাখতে হয় যেনো অধিকার চাওয়া পাওয়ার সুর টা যেনো কোনো ভাবে আদেশ এর সুর না হয়ে যায়।

গ্রামে ও ব্লকে সুরাহা না পেলে জেলায় জানান, জেলায় যদি অধিকার না বুঝে পান, রাজ্যে সদর দপ্তর নবান্নে জানান। নবান্ন যদি কাজ না করতে চায়, মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিব কে জানান। সেখানে প্রতিকার না পেলে রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতি ভবনে জানান।

আপনার অধিকার ভারতীয় সংবিধান রক্ষা করার দায়িত্ব ও আপনার, নিজের অধিকার বুঝে নিন। কোথায় যেতে হবে, কোন আধিকারিকে ফোন করতে হবে একটু খোঁজ নিন। সামান্য একটু খোঁজ নিলেই জানতে পাবেন। খুঁজে পেলেই নিজের কাজ করিয়ে নিতে পারবেন। বিষয়টি কিন্তু শুধু কাজ করিয়ে নেওয়ার নয়, বিষয়টি আপনার অধিকারে। আর আধিকার বুঝে নেওয়া আমাদের সকলের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *