‘সোনার হাতওয়ালা মানুষ’ –
মিডাস ও হুমায়ূন আহমেদ – একটি আলোচনা
- স্নেহাশিস চক্রবর্তী
“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী ।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপূণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখনি গোপন রাত্রি ।
তোমার জ্যোতিষ্ক তা’রে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তা’রে চিরসমুজ্জ্বল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব ।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত ।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে
কিছুতে পারে না তা’রে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরষ্কার নিয়ে যায় সে যে,
আপন ভান্ডারে ।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।”
‘আমি যাহা কিছু স্পর্শ করি, তাহাই সোনাতে রূপান্তরিত হয়’ – শান্তির এই অক্ষয় বাণী নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন সমকালের অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ । গ্রীক পুরাণের রাজা ‘মিডাস’ । এরিস্টটলের ভাষায় অত্যন্ত জলকষ্টে মিডাস মারা গিয়েছিলেন, কারণ শেষ পর্যন্ত তিনি যা-ই হাত দিতেন সবই সোনায় রূপান্তরিত হত, এমনকি তিনি তার তেষ্টা মেটানোর উপায়ও বার করে উঠতে পারেননি । আমাদের সমকালের সাহিত্যে আমরা হুমায়ূন আহমেদের ভাষ্যে হয়তো হুমায়ূন আহমেদকেও পাই এমনভাবে – ‘এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি বারবার দুঃখ পেয়েছি । বারবার হৃদয় হা হা করে উঠেছে । চারপাশের মানুষদের নিষ্ঠুরতা হৃদয়হীনতায় আহত হয়ে কতবার আমার মনে হয়েছে – এই পৃথিবী বড়োই বিষাদময় । আমি এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য পৃথিবীতে যেতে চাই, যে পৃথিবীতে মানুষ নেই ।”
চলুন, দুঃখ বা জীবন-যন্ত্রণা এসব বাদ দিয়ে আমরা দেখি, কি করে রবীন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ অমর হয়ে রইলেন বা কেমন করে তিনি “আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি” ভরিয়ে তুললেন তার মেধা, পরিশ্রম ও কলমের জাদুতে তার সোনার ফসল । সাহিত্য, টেলিফিল্ম, চলচ্চিত্র, নাটক, নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালনা, প্রযোজনাতে তিনি কেমন করে এক অবিসংবাদী মানুষ হয়ে উঠলেন ।
পাকিস্তান সরকারের এক পুলিশ কর্মীর সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন ( পিতা ফয়জুর রহমান আহমেদ, মাতা আয়েশা ফয়েজ ) । জন্মসময়কালে প্রায় বছর দু’য়েক মাতৃ-আদর থেকে বহুদূরে অবস্থান, মাতার টাইফয়েড ও তার কারণে সাময়িক মস্তিস্ক বিকৃতি তাকে মামারবাড়িতে মানুষ হতে বাধ্য করে । পরবর্তীতে পিতার বদলীর চাকুরীসূত্রে বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে থাকতে হয় । ষষ্ঠ শ্রেণীতে ক্লাসে প্রথম স্থান, অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি ও ম্যাট্রিকুলেশান ( ১৯৬৫ ) পরীক্ষায় রাজশাহী বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়নে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, অবস্থান ঢাকা কলেজের সাউথ হোস্টেলের ২০৬ নম্বর ঘর ।
সন্তান প্রসবের সময় একজন মা’য়ের যে যন্ত্রণাবোধ, “বাংলাদেশ” শব্দটি তখন সময়ের সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যে সময়কালে হুমায়ূন, শেফালী ও জাফর ইকবাল এই তিন ভাইবোনই একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন, বাংলা ও পদার্থ বিদ্যার ছাত্র-ছাত্রী । প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যেতে পারে এই সময়কালকে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ধরে রেখেছেন হুমায়ূন আহমেদের মাতা আয়েশা ফয়েজ তার ‘জীবন যে রকম’ পুস্তকে ।
এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে ফয়জুর রহমানের বড়ো ছেলে হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ দেখলেন একদিকে সদ্য প্রসবিত “বাংলাদেশ”, অপরদিকে ব্যক্তিজীবনে এই সময় মে মাসে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে মারা পড়তে হল হুমায়ূন আহমেদের পিতা পাকিস্তানেরই পুলিশকর্মী ফয়জুর রহমানকে। রীতিমতো ঢাকা ও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এই সময়কালে হুমায়ূন আহমেদ, তার ভাইবোনেরা ও তার মাতা আয়েশা ফয়েজকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে। “ভয়াবহ একাত্তরেই আমি আবিষ্কার করেছি যে অসংখ্য সাধারণ মানুষের বুকের ভিতর রয়েছে সোনার হৃদয়। তাদের পায়ের ধূলিতে ধন্য হয়েছে এই পৃথিবী – কার সাধ্যি আছে কলুষিত করবে সেই সোনার পৃথিবী ।“ ( পৃষ্ঠা – ৬৭ । গ্রন্থ – ‘জীবন যে রকম’, লেখিকা – আয়েশা ফয়েজ ) হুমায়ূন, ইকবাল, আহাসান, শেফালী, মমতাজ, রোকসানা এই ছয় ভাইবোন ও মাতা আয়েশা ফয়েজ চোখের সামনে দেখেছেন কেমন করে শেষ খড়কুটো মোহনগঞ্জের শেষ আশ্রয়টুকু পরম আদরের মামারবাড়ি বা দাদুর বাড়িতেও দাদু ও এক মামাকে হত্যা করা হল। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় পিতৃপ্রদত্ত ব্যাংকের বইতে একশত ত্রিশ টাকা ও চার হাজার বই ছাড়া তিনি তেমন আর কিছুই পাননি । পুলিশের রেশন – শৈশব, বাল্য ও সদ্য যৌবনে বাঁচিয়ে রাখলেও এই প্রথম বড়ো ছেলে হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের সামনে এসে হাজির হয়েছিল বাস্তব জীবনের কঠিন নখ-দাঁতের আঁচড়। ১৯৭১ সাল, হুমায়ূন আহমেদের জীবনের আকাশটা অনেকটা রামধনুর মতো, রামধনুর সপ্তরঙে কেমন করে যেন মিশে গেল আরো দুটি রঙ – সাদা ও কালো। সৎ মানুষের সন্তান ও সততার আদর্শে একদিকে যেমন জীবনের সাদাকে উজ্জ্বলতা দান করেছেন, অপরদিকে জীবনে বেঁচে থাকার জন্য ভয়ঙ্করতম কালো রাত্রিগুলিকে অতিক্রম করেছেন মমতাময়ী মা’য়ের হাত ধরেই। সাদা কালোর এমন সহাবস্থান মানুষের জীবনে দুর্লভ বটে ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রধান জনাব খন্দোকর মোকারম হোসেন হুমায়ূন আহমেদকে পাঠান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ও সেখানে স্বল্পসময়ের জন্য হুমায়ূন ৪৫০ টাকার বেতনে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। মোকারম সাহেবের অনুমানই ঠিক ছিল, হুমায়ূন আহমেদের মতো মেধাকে দেশের মধ্যে আটকে রাখতে না পারলে সেটা দেশের ক্ষতি । মাস ছ’য়েকের মধ্যেই ( হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ) হুমায়ূন আহমেদ ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে রসায়ন বিদ্যার প্রভাষক হিসেবে । শুরু হল জীবন সংগ্রামের দ্বিতীয় অধ্যায়।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত, দাঙ্গা বিধ্বস্ত বাংলাদেশের তখনও কোনো কিছুরই পুনর্নির্মাণ হয়ে ওঠেনি । মানুষের অন্ন সংস্থানই তখন এক বিষম দায় । বইপত্র কিনে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর টাকা তখন কই ? এমন এক সময় আহমেদ ছফার পরিচয়ের সূত্র ধরে ‘খান ব্রাদার্স এন্ড কোং ’ প্রকাশকের মাধ্যমে বাজারে প্রকাশিত হল ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ১৯৭৩ সালে । লেখক ? হ্যাঁ, হুমায়ূন আহমেদ । অল্প পরেই এল ‘নন্দিত নরকে’ পুস্তক, যদিও এই ‘নন্দিত নরকে’ সমগ্র লেখাটি ১৯৭০ সালে ‘মুখপত্র’ নামক একটি পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল, যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের এক ছাত্র মাত্র । সময়ের পটে প্রায় অভুক্ত জাতির চেতনায় জ্বালিয়ে দিলেন বই পড়ার ও পড়ানোর নেশা । ‘আমি যাহা কিছু স্পর্শ করি, তাহাই সোনাতে রূপান্তরিত হয়’ । অনুভব করতে পারছেন পাঠক, আপনারাও সকলেই ?
একটা জাতিকে রীতিমতো এক কঠিন সময়ে বই পড়তে ও পড়াতে শেখালেন বাংলাদেশের সাহিত্যের পিতৃসম হুমায়ূন আহমেদ । কঠিন লাগল ? দেখুন পাঠক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক চেতনায় বাঙালি জাতির একটি দেশ হতে পারে, সেই বোধের মধ্যেই বাংলাদেশ মনে রেখেছে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে । আমার যুক্তিবোধ বলে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক চেতনার শিকড় যে প্রোথিত আছে শিক্ষার মধ্যেই, আর সেই শিক্ষাকে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের বাঙালির মধ্যে জাগরিত করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ । তাহলে বাংলাদেশের নিরিখে তাকে কি ‘সাহিত্য বা শিক্ষার পিতা’ বলা যায় না ? সাহিত্য জগতে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি হুমায়ূন আহমেদকে । হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের পাঠকের নাড়ির স্পন্দন বুঝে গেলেন স্বল্প সময়েই । প্রায় চার দশকে সম্ভবত ৩২২ খানা বা তার বেশি পুস্তকের রচয়িতা তিনি । তার কলম থেকে ক্রমশ বেরোতে শুরু করলো – হিমু, মিসির আলি, শুভ্র, রুপা, বাকের ভাই, টুনি প্রভৃতি চরিত্ররা।
যে ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে পড়ার সময় রাস্তায় ঘুরে কাটিয়েছে শুধুই সময় কাটানোর জন্য, অসময়ের খিদে মিটিয়েছেন রাস্তার বিনে পয়সার জল খেয়ে, সেই ছেলে আজ একদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ও অন্যদিকে তার চেতনা সমৃদ্ধ সাহিত্য ক্রমশ বেড়িয়ে এসে বাঙালিকে উদ্বেলিত করে তুলতে শুরু করল । অধরা রইলো না দেশের ভিতর সাহিত্যের কোনো শিরোপাই । ক্রমশ পৃথিবীময় ব্যাপ্ত হতে শুরু করলেন হুমায়ূন আহমেদ । আমার ছেলেবেলা, আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই, হিজিবিজি, হোটেল গ্রোভার ইন, কাঠপেনসিল, নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, বলপয়েন্ট, ফাউন্টেন পেন ইত্যাদি বইতে তুলে ধরলেন এমন লেখনী যেখানে আত্মপ্রক্ষেপণে হুমায়ূন আহমেদকে খুঁজে পাওয়া যায় বৈকি । ময়ূরাক্ষী, দরজার ওপাশে, পারাপার, হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম, তোমাদের এই নগরে, চলে যায় বসন্তের দিন, সে আসে ধীরে, আঙ্গুল কাটা জগলু, কালো র্যাব প্রভৃতি হিমু সিরিজের আরো অসংখ্য পুস্তক । মিসির আলি চরিত্রের বিভিন্নতাকে তুলে ধরলেন – দেবী, নিশীথিনী, নিষাদ, অন্যভুবন, বৃহন্নলা, আমি ও আমরা, তন্দ্রাবিলাস, কহেন কবি কালিদাস, হরতন ইশকাবন, পুফি, যখন নামিবে আঁধার, প্রভৃতি লেখনীর দ্বারা । কল্পবিজ্ঞানের লেখার রীতিমতো জনক তিনি। হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন – তারা তিনজন, ইরিনা, কুহক, ফিহা সমীকরণ, শূন্য, অনন্ত নক্ষত্রবীথি, ওমেগা পয়েন্ট, দ্বিতীয় মানব প্রভৃতি গ্রন্থ । তিনি শুভ্র সিরিজ তৈরি করেছিলেন, যে পুস্তকগুলিও একের পর এক অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে আছে আজও । দারুচিনি দ্বীপ, রুপালী দ্বীপ, শুভ্র, এই শুভ্র এই, শুভ্র গেছে বনে ইত্যাদি হুমায়ূন আহমেদ রচিত অপর কয়েকটি জনপ্রিয় গ্রন্থ । শিশুদেরকেও তিনি নিরাশ করেননি, তিনি লিখে গেছেন – রাক্ষস খোক্কস ভোক্কস, নুহাশ ও আলাদিনের আশ্চর্য চেরাপ, ছোটদের সেরা গল্প, পরীর মেয়ে মেঘবতী, তোমাদের জন্য রূপকথা, কালো জাদুকর প্রভৃতি বহু গ্রন্থ । আসলে জাদু সম্পর্কে হুমায়ূন আহমেদ অল্প বয়স থেকেই বরাবরই একটু বেশিই স্নেহশীল, তাই হয়তো তার কলমের জাদুর ছোঁয়া স্পর্শ করেছে আপামর জনগণকেই । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে তিনি সামনে থেকে দেখেছেন – তার কলম নিঃসৃত শ্যামলছায়া, আগুণের পরশমণি, অনিল বাগচির একদিন, ১৯৭১, জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প ইত্যাদি বইগুলি চোখে দেখা বাস্তবতার মিশেলে জনপ্রিয়তার চেয়েও সাহিত্য ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ ।
সাহিত্যে নিরলস কাজ করে যেতে-যেতেই তিনি ক্রমশ আকর্ষিত হয়েছেন শিক্ষাকে গণমাধ্যমের মধ্যে দিয়েও ছড়িয়ে দিতে । সেই হাত ধরেই এসেছে তার বিভিন্ন গল্পের চিত্রনাট্য ও কল্পনা । কয়েকটি তো রীতিমতো সাড়া জাগানো শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত বা বিশ্বের বাঙালি অধ্যুষিত সমস্ত অঞ্চলেই । এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার, নিমফুল, তারা তিনজন, আমরা তিনজন, মন্ত্রীমহোদয় আগমন শুভেচ্ছার স্বাগতম ইত্যাদি নাটক মানুষের মনে দাগ কেটেছে অনেকখানি ।
প্রায় পনেরোখানা চলচ্চিত্রের সাথে তার সরাসরি সংযুক্তি আমাদের গোচরে আসে । ১৯৯২ সালে শঙ্খনীল কারাগার চলচ্চিত্রের তিনি ছিলেন চিত্রনাট্যকার । পরিচালনা প্রযোজনা ও চিত্রনাট্যের লেখক হিসেবে তিনি তার নির্মাণকে আলাদা মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন । তিনি নিজে বহু গান লিখেছিলেন চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে আবার উল্টোদিকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া থেকে হাসন রাজার গানকে ও গিয়াসুদ্দিনের গানকে তিনি জনমানসে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন এ কথাও বলা যেতেই পারে । ১৯৯৪ সালে আগুনের পরশমণি, ১৯৯৯ সালে শ্রাবন মেঘের দিন, ২০০০ সালে দুই দুয়ারী, ২০০৩ সালে চন্দ্রকথা, ২০০৪ সালে শ্যামলহারা, ২০০৬ সালে নয় নম্বর বিপদ সংকেত, ২০০৮ সালে আমার আছে জল, ২০০৯ সালে প্রিয়তমেষু, ২০১২ সালে ঘেটুপুত্র কমলা চলচ্চিত্রে তিনি একাধারে তার রচনাশৈলীর সাথে সাথে অতি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা ও প্রযোজনাও করেন । এ ছাড়াও ২০০৬ সালে তার লেখা নন্দিত নরকে ( পরিচালক – বেলাল আহমেদ ) ও নিরন্তর ( পরিচালক – আবু সঈদ ), ২০০৭ সালে দারুচিনি দ্বীপ ( পরিচালক – শাহ আলম কিরণ ) চলচ্চিত্র হিসেবে দর্শকমণ্ডলীর জনপ্রিয়তা লাভ করে ।
সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সৃজন সর্বত্রই সোনা ফলিয়েছে এ কথা কি বলা যায় না পাঠকমণ্ডলী ? সাহিত্য রচনার কারণে এক সময় তিনি অধ্যাপনার চাকুরীও পরিত্যাগ করেন। দেখুন শুরুর দিকে যেটুকু বর্ণনা দিয়েছি, তার সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের সাহিত্যের সামগ্রিক অবস্থার বিবেচনায় তাকে কি আমরা স্থপতি বলতে পারি না ? হুমায়ূন আহমেদের মতো বর্ণময় চরিত্র সেই সময় উপস্থিত না থাকলে নতুন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশে’ সাহিত্যের বিস্তার হয়তো হতই কারোর না কারোর হাত ধরেই, কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই হুমায়ূন আহমেদ ‘জাতির শিক্ষক’- রূপে এসে না দাঁড়ালে এত দ্রুত সোনার ফসল ফলত কি না এই প্রশ্নটা থেকেই যায়। কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের ঊর্ধ্বে উঠে ও অগ্রিম রাজনৈতিক আনুগত্য ব্যতিরেকে হুমায়ূন আহমেদ নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন সাহিত্য প্রসারে, এ কথাই মনে হয় বলাটা যুক্তিসঙ্গত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ডঃ আহমেদ শরিফ ১৬/০৬/১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বললেন, “হুমায়ূন আহমেদ বয়সে তরুণ, মনে প্রাচীন দ্রষ্টা, মেজাজে জীবনরসিক, স্বভাবে রূপদর্শী, যোগ্যতায় দক্ষ রূপকার । ভবিষ্যতে তিনি বিশিষ্ট শিল্পী হবেন – এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করব।”
সদ্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, “যারা বলেন, জনপ্রিয়তা সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, তারা ভুল বলেন না । তবে জনপ্রিয়তা লেখকের একটা অর্জন নিঃসন্দেহে। কারো রচনা গুণমানে শ্রেষ্ঠ, কিন্তু পাঠক তা গ্রহণ করতে পারে না আবার কারো রচনা মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে যায় । কোনো লেখকই কেবল নিজের জন্য লেখেন না, দশজনের কাছে নিজেকে প্রকাশ করতেই লেখেন। জনপ্রিয় হলে তার রচনা খেলো বলে গণ্য করতে হবে, এটা একটা কুসংস্কার মাত্র।”
সাহিত্যিক শ্যামসুল হক হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, “তিনি বেঁচে থাকবেন তার লেখায়। লেখার অতিরেকে তিনি অন্য মাধ্যমেও কাজ করেছেন, নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র আর টেলিভিশনের জন্য নাটক । কিন্তু তার মূল কাজ লেখাতেই; চলচ্চিত্র আর টেলিনাটক তার সাহিত্য-সৃজনেরই সম্প্রসারণ বলে আমি মনে করি।”
নন্দিত নরকের ইংরেজি ( ব্লিসফুল হেল ) অনুবাদক বাংলাদেশের অপর সাহিত্যিক জনাব নুরুল হুদা জানালেন, “মরণশীল মানুষের অমরত্ব লাভের একমাত্র উপায় তার সৃষ্টিশীলতা” – “নন্দিত নরকের প্রথম পাঠক আমি আর দিলু । … হুমায়ূন আহমেদ এল, দেখল আর জয় করল। … হুমায়ূনের সাম্রাজ্য মুঘল সাম্রাজ্যের মতো বিশাল হয়ে উঠেছে।…… আশি নব্বুই দশকে আমার নুশা কম্পিউটার্স থেকে কম্পোজ হয়েছে তার ৫০-টির বেশি উপন্যাস । হুমায়ূন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। …… আসলে একজন লেখকের মূল কাজ হল সমাজ-সংসার পরিবার এমনকি শরীর-স্বাস্থ্য সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে সর্বাবস্থায় নিজের কলমটাকে মুক্ত ও সচল রাখা। এই কলমই লেখকের জীবন, এই কলমই লেখকের দৈর্ঘ্য নির্ধারণকারী অব্যর্থ পরিমাপক। এই কলমের খোঁচাতেই লেখক তার শরীর জীবন পার হয়ে অনন্তজীবনে চিরায়ুর স্বাদ পেতে পারেন।”
‘সোনার হাতওয়ালা মানুষ’- এই কথাকে প্রতিষ্ঠা দিতে আরো আরো অনেক প্রাজ্ঞজনের মতামত দিতে পারি, কিন্তু বিষয়বস্তুকে স্বল্পতায় রাখব বলেই দিলাম না। মিডাস যা হাত দিতেন তাই সোনা হয়ে যেত, তাই জলপানের জলভর্তি পাত্রও সোনাতে রূপান্তরিত হওয়াতে তিনি জলকষ্টেই হয়তো মারা গেছেন। গ্রীক মাইথোলজির একটি মিথ হিসেবেই তিনি আজ পড়ে আছেন আমাদের কাছে । কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ ? তিনি কিন্তু অমর স্থপতি, তার স্থাপত্যে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের লেখককুল আজও বিরাজ করছেন, প্রকাশককুল বিরাজ করছেন। একমাত্র কারণ হল হুমায়ূন আহমেদের সৃজন ছিল সোনায় মোড়া, যে সোনাকে স্পর্শ করা যায় না, অনুভব করা যায়, যে সোনাকে দেখা যায় না, পড়ে নিতে হয়।
মিডাস হয়ে নয়, হুমায়ূন আহমেদ আধুনিক বাংলাসাহিত্যের এক নব্য স্থপতি হিসেবে অবশ্যই বিরাজ করবেন আগামী আরো কয়েকশো বছর, এ কথা বলার সময় আজ হয়েছে বৈকি।