কোজাগরী লক্ষ্মী কথা
সুপর্ণা বিশ্বাস (বজবজ)
বাঙালির উৎসবের শেষ নেই। এমনিতেই কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাংলায় শারদীয়া দুর্গোৎসবের পর দশমীতে মা দুর্গা ফিরেছেন মর্ত্য থেকে কৈলাসে এবং সেইসাথে আকাশে বাতাসে বিষাদের সুর। উৎসবের রেশ শেষ হতে না হতেই আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মীর আরাধনা জাঁকজমক ভাবে পালন করা হয়। তবে মাস ভেদে প্রায় প্রতি ঘরেই দেবী লক্ষ্মীর পূজা কম বেশী হয়ে থাকে।
শাস্ত্রীয় পুরান মতে দেবী লক্ষ্মীকে আদিশক্তি ভগবতী দেবী রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। লক্ষ্মী হলেন ধন-দৌলত, অর্থ, সম্পত্তির দেবী। ধন সম্পদের আশায় তাঁর কৃপায় গৃহস্থ আলোকময় হয়ে ওঠে যাতে সেই আশায় বাঙালির ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পূজা হয়ে থাকে। কথায় আছে যে, কোনও মানুষ যদি ভক্তিভরে ব্যাকুলভাবে তাঁর আরাধনা করেন তাহলে তার জীবনে দুর্ভাগ্য কেটে সৌভাগ্যের আগমন ঘটে, সেইসাথে ধনসম্পত্তির সমৃদ্ধিও ঘটে। তবে এই আশ্বিন মাসের কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার বিশেষ তাৎপর্যও রয়েছে ,যার প্রভাব পুরান অন্তর্গত বাঙালিয়ানায় ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত।
“কোজাগরী” শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘কো জাগরী’ থেকে অর্থাৎ যার অর্থ ‘কে জেগে আছো?’- কথাটি থেকে। বলা হয়, যার কিছু (সম্পত্তি) নেই সে পাওয়ার আশায় জাগে। আর যার আছে সে না হারানোর ভয়ে সেই আশায় জাগে। সারারাত জেগে লক্ষ্মীর আরাধনা করাই এই পূজার বিশেষ রীতি। কথিত আছে, কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাত্রে দেবী স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে এসে খোঁজ নেন, কে জেগে আছেন? যে ভক্ত জেগে থেকে তাঁর আরাধনা করে দেবী লক্ষ্মী তাকে দু'হাত ভরে আশীর্বাদ করেন এবং ধন সম্পত্তি দান করেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার ব্রত’ বইতে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা সম্পর্কে বিশদে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই বইতেই তিনি জানিয়েছেন যে, রাত জেগে এই পূর্ণিমার দিন মা লক্ষ্মীর কাছে ভাল ফলের কামনা করাই এই পূজার নৃতাত্বিক কারণ।
সভ্যতার আদিলগ্ন থেকেই হিন্দু ধর্ম ব্যতীত বিভিন্ন ধর্মের মধ্যেই এই দেবীর পূজার প্রচলন কমবেশি ছিল বলা যায় । যেমন - জৈন ধর্মাবলম্বীরা লক্ষী দেবীকে অর্থ এবং কামের দেবীরূপেও চিহ্নিত করেছেন জৈন মন্দিরগুলোতে। আবার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সৌভাগ্যের দেবী অথবা প্রাচুর্যের দেবী হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়াও ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টিপাত করলে লক্ষিত হয় বিভিন্ন পূরণ,উপনিষদ, বেদ, মহাকাব্যতেও প্রাচীনে এই ঐশ্বর্যের দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।