‘কেস্টহীন’ মঙ্গলকোটে আগামীকাল   জনসভায় অভিষেক কি বার্তা দেবেন ? চলছে জল্পনা 

Spread the love

মোল্লা জসিমউদ্দিন, 

আগামী সোমবার পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের নুতনহাট সংলগ্ন লালডাঙ্গা মাঠে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জনসভা করতে আসছেন। এই জনসভায় থাকছেন না দীর্ঘদিনের মঙ্গলকোটের তৃণমূল ‘অভিভাবক’ অনুব্রত মন্ডল। তাই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কি বার্তা দেবেন, তা নিয়ে চলছে তুমুল জল্পনা।  বীরভূমের বাসাপাড়া সংলগ্ন সূচপুরের গণহত্যা পরবর্তীতে উঠে এসেছেন অনুব্রত মন্ডল ওরফে কেস্ট মন্ডল।অজয় নদের ওপারে বীরভূম জেলার নানুরের হাটসেরান্ডির বাসিন্দা অনুব্রত অজয় নদের এপারে পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের ‘শেষ কথা’ বলতেন একসময়। ২০০৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ টানা ১৪ বছর মঙ্গলকোটের রাজনীতি আবর্তিত হত অনুব্রত কে ঘিরেই।এমনকি তৃণমূল সাংসদ পদে অনুপম হাজরা এবং রাজ্যের মন্ত্রী তথা সংখ্যালঘু সংগঠক হয়েও সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী পারেননি অনুব্রতের রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে।দক্ষিণবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দানে ‘পিঞ্চ হিটার’ বক্তা হিসাবে অনুব্রত মন্ডল প্রথম সারিতে পড়েন।অনুব্রতের বিভিন্ন মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় যেমন ভাইরাল হয়েছে, ঠিক তেমনি বিরোধী নেতাদের কাছে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সেই অনুব্রত মন্ডল বর্তমানে গরু পাচার মামলায় দীর্ঘ আট – নয় মাস জেলে বন্দি।দিল্লির তিহাড় জেল এখন তাঁর ঠিকানা। সেই ঠিকানায় নবতম সংযোজন হিসাবে তাঁর মেয়ে সুকন্যাও ঠাঁই পেয়েছে।তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব অনুব্রতের প্রতি এখনও সহৃদয়শীল।অনুব্রত কে যেমন বীরভূমের জেলা তৃণমূল সভাপতি পদে আসীন রেখেছে। ঠিক তেমনি সুকন্যা গ্রেপ্তারে ইডির বিরুদ্ধে অমানবিক ভূমিকায় সরব হয়েছে তারা । অনুব্রতের বিরুদ্ধে সিবিআই – ইডির যা মামলা, তাতে আগামী পঞ্চায়েত ভোটে অনুব্রত জামিন পাওয়া বড়ই মুস্কিল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের কি ভূমিকা হবে?  তা নিয়ে দোটানায় রাজনৈতিক মহল।মাস কয়েক হয়েছে এই মঙ্গলকোট অনুব্রত মন্ডলের প্রভাব কিছুটা  মুক্ত হয়েছে বলে স্থানীয় সুত্রে প্রকাশ  । পূর্ব বর্ধমান জেলার দলীয় সভাপতি তথা কাটোয়া বিধায়ক  রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সাংগঠনিক আওতায় পড়েছে এই মঙ্গলকোট।প্রকাশ্যে না স্বীকার করলেও অনুব্রত অনুগামীদের সাথে রবীন্দ্রনাথ অনুগামীদের দূরত্ব  সামন্তরাল রেললাইনের মতো রয়েছে ।দূর থেকে এক,আর কাছে গেলে ফারাক অনেকখানি!  গত ২০১৫ সালে কাটোয়া পুরসভা ভোটের সময় তৎকালীন কাটোয়ার কংগ্রেস  বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় কে উদ্দেশ্য করে  ‘হাতের কবজি কেটে নেওয়া’র হুমকি দিয়েছিলেন অনুব্রত।সেসময় জঙ্গল সেখ নামে এক সশস্ত্র দলের নেতা কে কাজে লাগাবার অভিযোগ উঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।যদিও তৃণমূল সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে থাকে। তবে জঙ্গল সেখের অবস্থা ‘কাজের সময় কাজি,কাজ ফুরালে পাজী’ র মত হয়।জঙ্গল সেখ  বর্তমানে মাদক মামলায় সপরিবারে জেল হেফাজতে। কাটোয়া পুরসভা ভোটের সময় এক খুনের ঘটনাও ঘটে।গত ২০১৫ সালে কাটোয়া পুরসভার ফলাফল তৃণমূল ও কংগ্রেসের ১০-১০ হয়।এরপর বহু টানাপোড়েন কাটিয়ে দীর্ঘদিনের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় একপ্রকার ‘বাধ্য’ হয়ে তৃণমূলে যোগদান করেন বলে রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করে।রাজ্য তৃণমূলের পদ পান রবীবাবু।বর্তমানে তিনি পূর্ব বর্ধমান জেলা তৃণমূল সভাপতি। তাই একদা ‘হাতের কবজি কেটে নেওয়া’র হুমকিদাতা অনুব্রত কে ভূলেন কি করে?? তাই আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে অনুব্রত অনুগামী বনাম রবীন্দ্রনাথ অনুগামীদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছে , বিশেষত দলীয় প্রতীক পাওয়া নিয়ে এক আভ্যন্তরীণ বিবাদ আসন্ন।ইতিমধ্যেই কৈচর ১ এবং ২ নং, শিমুলিয়া ২, ভাল্ল্যগ্রাম, মাঝীগ্রাম, সদর মঙ্গলকোট প্রভৃতি পঞ্চায়েত এলাকায় দুটি গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে শাসক দলের মধ্যে  । যদিও ব্লক কিংবা জেলা তৃনমূল নেতৃত্ব এই আভ্যন্তরীণ বিবাদ কে প্রকাশ্যে স্বীকার করেননি। তারা উন্নয়ন কে সামনে রেখে মুখ্যমন্ত্রীর হাত শক্ত করতে চান বলে জানিয়েছেন ।গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় (২০১৮) তৎকালীন মঙ্গলকোট বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বনাম তৎকালীন ব্লক তৃণমূল সভাপতি (বর্তমান বিধায়ক)  অপূর্ব চৌধুরীর মধ্যে দলীয় প্রতীক পাওয়া নিয়ে বিস্তর টানাপোড়েন চলেছিল।কখনও ফিরহাদ হাকিম, আবার কখনো সুব্রত বক্সীর বাড়িতে দলের প্রতীক নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা হয়।হাতে গোনা কয়েকটি আসনে প্রতীক পেয়েছিলেন সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী ।মনোনয়ন তুলতে কিংবা মনোনয়ন জমা দিতে সশস্ত্র দলের ঘেরাটোপে থাকা ব্লক অফিসের গেট অবধি ঢুকতে পারেননি সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর অনুগামীরা। রাজ্যের মন্ত্রী হয়েও মঙ্গলকোটে নিজে দাঁড়িয়ে থেকেও ব্লক অফিসে অনুগামীদের নিয়ে যেতে পারেননি পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন তুলতে।এমনকি কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে মহকুমা অফিসে বিরোধীরা মনোনয়ন পত্র তুলতে এবং জমা দিতে সূযোগ পেয়েছিলেন। কাটোয়া মহকুমা অফিসের সামনে সেসময় সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর ভাইপো দলেরই একাংশের লাঠিতে রক্তাক্ত হয় মাথা।এইরকম নানান ঘটনাবলি ঘটেছিল এই মঙ্গলকোটে। সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী বর্তমানে কাটোয়ার বিধায়ক তথা জেলা তৃণমূল সভাপতি রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে যথেষ্ট সখ্যতা রয়েছে। প্রসঙ্গত, কাটোয়ার করজগ্রামে পৈতৃক ভিটা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর। এবার পঞ্চায়েত ভোটের ময়দানে  নেই অনুব্রত মন্ডল। ।তিহাড় জেলে বন্দি তিনি । যদিও তিনি বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি পদে আসীন। রাজনৈতিক ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে – ‘বর্তমানে মঙ্গলকোটে অনুব্রত অনুগামীদের একচেটিয়া প্রভাব সেভাবে আর নেই’। বিভিন্ন দলীয় অফিসে অনুব্রত মন্ডলের ছবি উধাও! স্থানীয়  পুলিশ-প্রশাসনও অনেকটা ব্যালেন্স করে কাজ চালাচ্ছে বলে জানা গেছে ।দু তরফকেই গুরুত্ব দিচ্ছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।   গতবারের (২০১৮) পঞ্চায়েত বিনা ভোটেই  প্রতিটি আসনে ( গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ)  জয়লাভ পেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস।এবার বোধহয় সেটি হচ্ছেনা বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল । স্থানীয় বিধায়ক হিসাবে অপূর্ব চৌধুরী যেমন জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন সেটি যেমন অস্বীকার করতে পারছেনা বিপক্ষ শিবির। ঠিক তেমনি জেলা তৃণমূল সভাপতি  রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অনুগামী হিসাবে সদর মঙ্গলকোটের শান্ত সরকারের জেলার সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়ায় এক অন্য অংক দেখছে তাদের বিপক্ষ শিবির। যদিও বিরোধী দলগুলির অভিযোগ – “শাসক দলের আভ্যন্তরীণ বিবাদ লোকদেখানো, নিচুস্তরের কর্মীসমর্থকদের কে ব্যস্ত করে অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে মঙ্গলকোটে নো এন্ট্রি করা হচ্ছে”। তবে এলাকার সাধারণ মানুষ চান মঙ্গলকোটের অতীতের হানাহানির ছবি আর যেন ফিরে না আসে তাদের কাছে। একদা বসন্ত দত্ত,শিশির ঘোষ,ফাল্গুনী মুখার্জি, ডালিম সেখ,অসীম দাসদের মতো রাজনৈতিক নেতারা খুন হয়েছেন এই মঙ্গলকোটেই।অভিযোগ, দলেরই একাংশ এইসব খুনে কোথাও প্রত্যক্ষ আবার কোথাও পরোক্ষ মদত দিয়েছে।ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে আগামী সোমবার মঙ্গলকোটের নুতনহাট সংলগ্ন লালডাঙ্গা মাঠে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জনসভায় কি বার্তা দেন? তার দিকে তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *