কাশ্মীরি দুর্গা – সোমা ত্রিবেদী

Spread the love

কাশ্মীরি দূর্গা,


সোমা ত্রিবেদী,

আমার ছোট্ট খোকনের বড্ড আক্ষেপ তার জন্মদিনে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না বলে। আসলে খোকনের জন্ম এক আশ্বিন মাসের মহালয়ার আগের আগের দিন। প্রতি বছরই এই সময়টা হয় পুজো নয়তো পুজোর রেশ থাকে। আর খোকনের বাবা দুর্গা পুজোয় কোলকাতা কিছুতেই ছাড়তে রাজি নয়। সেই প‍্যাণ্ডেলের বাঁশ পোঁতা থেকে বিজয়ার কোলাকুলি পযর্ন্ত প্রচন্ড উপভোগ করে।

তবুও এক বছর ছেলের মন রাখতে আশ্চর্য ভাবে রাজি হয়ে গেল পুজোর সময় কাশ্মীরে যেতে। সে বার ছেলের জন্মদিন পড়ল অষ্টমীতে। শুরু হলো ব‍্যাগ গোছানোর পালা। তারপর অবশেষে “মিশন কাশ্মীর”। পাঞ্জাবের ওয়াঘা বর্ডার স্বর্ণ মন্দির ঘুরে এগালাম ধরাধামে স্বর্গের পথে।

কাটরায় যেদিন পৌছালাম সেদিন মহাষষ্ঠী, বৈষ্ণদেবী দর্শন হলো সেদিন। কথায় আছে, বাঙালী দুর্গা পুজো শুরু হলেই আর তারিখ বার ঠিক ঠাক মনে রাখতে পারেনা তার বদলে বলে আজ ষষ্ঠী, কাল সপ্তমী। আমরাও তার ব‍্যতিক্রম নই। সপ্তমীর দিন শ্রীনগর পৌছে বিকেলের দিকে যাওয়া হলো মোঘল গার্ডেন। মনে হচ্ছিল যেন কনো ফুলের পর্দশনীতে এসেছি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝেই চলল আমাদের ফটো শেসন। এরপর পরী মহল, কি সুন্দর করে সাজান। অসামান্য অনুভূতির মাঝেই কোথাও বুকের মাঝে কি নেই কি নেই ভাব। সপ্তমী অথচ মায়ের মুখদর্শন হলোনা।

অষ্টমীর দিন সোনমার্গ যাওয়ার কথা। হোটেলের রুম সার্ভিসের থেকে চা জলখাবার দিতে এসেছে। তাঁকেই জিজ্ঞাসা করলাম শ্রীনগরে কোথাও দুর্গাপুজো হয় না। প্রশ্ন শুনে মুখে তার হাজার ভোল্টের আলো জ্বলে উঠলো, ঘুরিয়ে প্রশ্ন রাখলো পুজো দেবেন? আমিও উল্লসিত হয়ে বলে উঠলাম হ‍্যাঁ। ও আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে গেল ওর বাড়ি। বেশ কাছেই ওদের বাড়িটা। ওর ছেলেকে ডাকলো, সব্বির বলে। বছর পনেরোর ফুটফুটে কাশ্মীরি কিশোর। আমাদের দেখে সে আপ‍্যায়ন করে বলে উঠল আসুন আমার মা দুর্গা কে দেখে যান পুজোও দিতে পারেন। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না, কাশ্মীরি মুসলমান… দেবী পুজো… কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছিল।

হোটেলের লোকটি বলে উঠলো, দিদি ও আমার বাচ্চা না আছে, ও আমার বন্ধু কাশ্মীরি পণ্ডিতের ছেলে সুবির। ওর সলামতির জন্য ওকে সব্বির বলে ডাকি। যখন এখানে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হলো ওর বাপ মাকে মেরে দিল, ওদের ঘর জালিয়ে দিল, তখন ও এক সাল কা বাচ্চা ছিল। ওকে আমি লুকিয়ে আমার বাড়ি নিয়ে এসে পেলেছি। এই মুর্তিটা ওদের ঘরে পড়েছিল সেই সময়। ওর বাপ দাদার স্মৃতি মনে করে ওর জন্য এনে রেখেছি। ও পুজো কিছু জানেনা। পণ্ডিতের ছেলে, ভগবান হয়তো ওর খুনে আছে, ও নিজেই ফুল দিয়ে রোজ সাজায় মাকে। ফল দেয়। আমাদের প্রসাদ দেয় মায়ের। ও আমার বন্ধুর বাচ্চা ঠিকই তবে এখন আমার ছেলে। প্রাণ ভরে ছেলেটিকে আদোর করলাম। মনে হলো এমন মানবিকতা যেখানে আছে সেখানে দেবীর সত্যিই অধিষ্ঠান আছে।

এরপর আরও কয়েক দিন ঘোরাঘুরি হলো। তারপর ফিরলাম নিজ নিকেতনে। বড়ো তৃপ্তি হয়েছিল সেদিন মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিয়ে মন্ত্রের আড়ম্বর নয় আলোর চাকচিক‍্য নয় শুধুই ভক্তি আর সমর্পণ দেবীর চরণে। আরও অনেক পুজো এসেছে জীবনে কিন্তু স্মৃতির মণিকোঠায় চিরকাল উজ্জ্বল থাকবে কাশ্মীরি দুর্গা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *